রুপালি পর্দায় বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু উপস্থাপনে ধীরে ধীরে ওস্তাদ হয়ে উঠছে ভারতীয় সিনেমহল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জাতপাতকে মিশিয়ে সাথে হাস্যরস যোগ করে দর্শকের সামনে এক অদ্ভুত মনোরঞ্জক উপস্থাপন করেছেন নির্মাতা ম্যাডোনে অশ্বিন। তামিল সিনেমা ‘ম্যান্ডেলা’ (২০২১) দিয়ে নির্মাতা হিসেবে অভিষেক ঘটে অশ্বিনের। ট্রেইলারে গল্প সম্পর্কে ধারণা দেওয়া থাকলেও এই এক গল্পের হাত ধরেই বিভিন্ন কুসংস্কার ও পারিবারিক কোন্দলের সুন্দর চিত্রায়ন দেখতে পাওয়া যায় ম্যান্ডেলা সিনেমায়।
ম্যান্ডেলা নাম শুনলেই মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলওয়ালা এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে যিনি আফ্রিকার গণমানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করেছেন দীর্ঘকাল। সিনেমার মূল চরিত্র ‘স্মাইল’ এর চেহারাও অনেকটা এমনই। নিচু জাতের নাপিত স্মাইলের ঠাঁই হয় গ্রামের এক গাছের নিচে। গ্রামের তথাকথিত উঁচু জাতের লোকেদের বাড়িতে চুল-দাঁড়ি কামানোর পাশাপাশি তাদের বাসন মেজে দেওয়া, কড়া রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য চাল-ডাল কিনে আনাও ছিল তার দৈনন্দিন কাজ। সাইড কিক নামের ১৫ বছর বয়সী এক ছেলের সাথে এক গাছের নিচে খেয়ে-পরে কোনোভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল স্মাইলের।
স্মাইল চরিত্রে যোগি বাবুর অভিনয় ছিল বেশ সাবলীল। প্রায় দেড়শ সিনেমায় সাপোর্টিং রোলে অভিনয় করার পর যোগি বাবু তার প্রথম লিড রোলে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। শাহরুখ খানের চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমাতেও ছোটখাট একটি রোলে দেখা যায় তাকে। ম্যান্ডেলা সিনেমার কাহিনী একটি গ্রামকে ঘিরে। কিন্তু এই এক গ্রামের গল্পের মধ্যেই স্বাস্থ্য সচেতনতা, জাতপাত, মাদকাসক্তি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহ এবং ভোট ব্যবসাসহ আরো বিভিন্ন বার্তা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় তামিলনাড়ুর অজপাড়াগাঁ সুড়াগুন্দির পুরুষ বাসিন্দারা ভোরবেলায় নিজেদের নিত্যকর্মের অংশ হিসেবে খোলা স্থানেই মলত্যাগের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে এই কাজ ভোর হওয়ার আগেই সমাপ্ত করতে হয়। কিন্তু একদিন গ্রামবাসী জানতে পারে, তাদের একমাত্র নেতা তাদের জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা করেছেন। বিপত্তি শুরু হয় এই শৌচাগার উদ্বোধনের সময়।
নেতার দুই স্ত্রী, যারা দুই জাতের এবং এই দুই স্ত্রীর ঘরে দুই ছেলে। দুই ছেলেই তাদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির হয় শৌচাগার উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে। একদল সুড়াগুন্দির উত্তরের প্রতিনিধি, আরেকদল দক্ষিণের। এর মধ্যেই শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক এবং একপর্যায়ে লেগে যায় সংঘর্ষ। সৎ ভাইদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়েও এই সিনেমায় আছে সুন্দর বর্ণনা। দুই ভাইয়ের মধ্যেই তাদের বাবার উত্তরাধিকারী হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্ন শুধু ঐ গদিতে বসার, এর দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় দুজনই ভীষণ উদাসীন। তাই একজন নেতা ও বাবা হিসেবে দুই ছেলের কারো হাতেই নিজের গদি ছাড়তে পারেননি তিনি।
ভাইয়ের চরিত্রে, পঞ্চাশেরও বেশি শর্ট ফিল্ম ও ওয়েব সিরিজ এবং কাইথি (২০১৯) ও ভিরা (২০১৯) এর মতো সিনেমায় অভিনয় করা কান্না রভি তার শতভাগ অভিনয়দক্ষতা ঢেলে দিয়েছেন। আরেক ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জি. এম সুন্দর, যাকে বিভিন্ন তামিল সিনেমায় দেখা যায় প্রায়ই। শুধু তারাই নন, ম্যান্ডেলা সিনেমার সবচেয়ে ক্ষুদ্র চরিত্রও অভিনয়ের অগ্নিপরীক্ষায় দশে দশ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। সিনেমার এক অংশে দেখা যায় গ্রামের উত্তর ও দক্ষিণ এলাকার দুই লোক একই বাসে উঠেছেন। একজন সিটে বসেছেন এবং তার পাশে সিট খালি থাকা সত্ত্বেও আরেকজন বসেননি। একসাথে বসলে জাতের অবমাননা হবে যে! এর চেয়ে পুরো রাস্তা বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই সম্মানজনক। তবে দুজনের মিলন হয় যখন মদ কিনতে গিয়ে পকেটে অর্থের টান পড়ে। একই বোতল দুজন চুপচাপ ভাগাভাগি করে খেয়ে যে যার রাস্তায় চলে গেল!
সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র থেনমোজি, যিনি একজন নারী ডাকপিয়ন। বিখ্যাত মালায়লাম সিনেমা কুম্বালংগি নাইটসের সাথি চরিত্রে অভিনয় করা শীলা রাজকুমার এই সিনেমার মূল গল্পে প্রবেশের সিঁড়ি হিসেবে ছিলেন। চুল-দাঁড়ি কামিয়ে যখন একটু একটু করে জমানো অর্থগুলো স্মাইলের বাসস্থান অর্থাৎ সেই গাছে গুঁজে রাখা পুটলি থেকে হারিয়ে যায়, তখনই সে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য পোস্ট অফিসের দরজায় কড়া নাড়ে। তবে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য দরকারি কাগজপত্রের কিছুই নেই তার কাছে। নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দাবী করার সামান্য পরিচয়পত্রও নেই।
এমনকি নিজের আসল নামও তার জানা নেই। আশেপাশে লোকে যা বলে, সে তাতেই সাড়া দেয়। ভাল মতো মুখ বন্ধ করে রাখতে পারে না বলে লোকে নাম দিয়েছিল স্মাইল, এটা নিয়েই সে সন্তুষ্ট। তবে কাগজপত্রের খাতিরে নতুন নাম দরকার। সাইড কিক আর ডাকপিয়ন আপা মিলে ঠিক করে, তার নতুন নাম ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’! যাবতীয় কাগজপত্রের জন্য এই নামেই সই করানো হয়। এভাবেই গ্রামের নাপিত স্মাইল হয়ে যায় ম্যান্ডেলা।
একটি সিনেমা দেখে তখনই চোখের আরাম পাওয়া যায় যখন সিনেমাটোগ্রাফি হয় সুন্দর। ম্যান্ডেলা সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি ছিল দৃষ্টিনন্দন। সেই সাথে মানানসই গান ও আবহসংগীত দর্শককে গল্পের সাথে বেঁধে রাখে। তেলেগু ভাষা না বুঝলেও সুর, তাল ও গানের টাইমিং দিয়েই ভাবানুবাদ অনেকটা বুঝতে পারবেন দর্শক। সিনেমায় গল্পের পাশাপাশি শক্তিশালী আরেকটি দিক ছিল সংলাপ। হাস্যরস ও ব্যঙ্গাত্মক সংলাপ পুরো সিনেমাজুড়ে সামান্য বিরক্তিও আসতে দেয়নি। সিনেমার এডিটিংও ছিল প্রশংসনীয়।
সিনেমা যেহেতু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত, তাই এই অংশ নিয়েও কিছু আলোচনা হয়ে যাক। দুই ভাইয়ের কাউকেও যখন উত্তারাধিকারী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় না, তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। যদিও নির্বাচন সম্পূর্ন সুড়াগুন্দির নেতার পদের জন্য, তবে এই দুই প্রার্থীর উত্তর ও দক্ষিণের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। নির্বাচনের আগেই গ্রাম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শুরু হয় ভোট নিশ্চিতের খেলা। শুধু এলাকা নয়, শহরের বাইরের ভোটার, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও ভোটার সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। কখনো ২০ রূপির টোকেনের লোভ, কখনো ২,০০০ রূপির, কখনো বা স্বামীর দিব্যি- এই দিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে ভোট নিশ্চিত করতে থাকে দুই ভাই। সবেমাত্র হওয়া ভোটার থেকে শুরু করে মৃত্যুশয্যায় শায়িত বৃদ্ধকেও ছাড়েনি তারা। তবে শেষমেষ দুই নেতারই ম্যান্ডেলার শরণাপন্ন হতে হয়। তৎক্ষণাৎ, আমূল পরিবর্তন আসে ম্যান্ডেলার জীবনে। চিত্রায়িত হয় নির্বাচনের কটু সত্য।
দুই প্রার্থীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলাকে নিতে হবে একটি সিদ্ধান্ত যা প্রার্থীদের জীবন বদলে দেবে মূহুর্তেই। কিন্তু কীভাবে? কী সেই সিদ্ধান্ত আর এর সাথে তারই বা কী সম্পর্ক? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন। আড়াই ঘন্টার কাছাকাছি এই সিনেমা চুম্বকের মতো টেনে ধরে রাখবে স্ক্রিনের দিকে। আর সেই সাথে চমৎকার ক্লাইম্যাক্স তো আছেই।
মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্র ম্যাডোনে অশ্বিনের সিনেজগতে পদার্পণের রাস্তা ছিল বেশ বন্ধুর। ছোটখাট শর্ট ফিল্ম থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে তামিল ইন্ডাস্ট্রির দিকে পা বাড়াতে থাকেন এই নির্মাতা। সপ্তাহে ৬ দিন পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত কাজ সেরে ছুটির দিনে ডুব দিতেন সিনেমার জগতে। অশ্বিন কেবল ম্যান্ডেলার নির্মাতাই নন, তিনি এই সিনেমার চিত্রনাট্যকারও। প্রথম সিনেমা হিসেবে ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। শুধু দর্শকের ভালবাসাই নয়, পেয়েছেন সমালোচকদের বাহবাও।
সিনেমাটি সর্বপ্রথম স্টার বিজয় নামক চ্যানেলে টেলিভিশন প্রিমিয়ার করা হয়, পরবর্তীতে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার মাধ্যমে মুক্তি পায়। বলিউডের বিভিন্ন বেশি বাজেটের সিনেমার চেয়ে ম্যান্ডেলা গল্প, অভিনয় ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে।