কে আমি? কোথা থেকে এলাম আমরা? এ মহাবিশ্বে আমদের অবস্থান কী? আমাদের বিশেষত্ব কী? প্রশ্নগুলো একদমই ভাববাদী হয়ে গেল। কিন্তু এগুলোকে কোনোভাবেই ফেলে দেয়া যাবে না। নিজেকে বুঝতে হলে নিজেদের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে হলে নিজের ও নিজেদের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিজ জাতির হাজার হাজার বছরের ঘটনাবহুল অতীত পর্যবেক্ষণ করলে নিজের সত্যিকার স্বরূপের দেখা মিলবে। যদি হাজার হাজার বছর পেরিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর কিংবা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।
হ্যাঁ, আজকের আমি আপনি যে দিব্যি খেয়ে বর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তার পেছনে লুকিয়ে আছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস। সেই বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে আজকের হোমো স্যাপিয়েনস পর্যন্ত লম্বা এক ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের গল্প তুলে ধরেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার সাম্প্রতিক বই বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েনস নামের বইতে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন আগাগোড়া বিজ্ঞানের মানুষ। শিক্ষকতা করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে, গবেষণা করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে, লেখালেখি করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে। সকল কিছু নিয়ে ব্যক্তি জাফর ইকবালও পুরোদস্তর বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির হাতও অত্যন্ত চমৎকার, বিজ্ঞানের লেখা যখন লিখেন তা হয় একদম অমৃত। তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো একটুখানি বিজ্ঞান ও আরো একটুখানি বিজ্ঞান নামের দুটি চমৎকার বই। কিন্তু লেখালেখির বেশির ভাগ সময়টা প্রদান করেন সায়েন্স ফিকশন কিংবা কিশোর উপন্যাসে। এ নিয়ে বিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকদের মাঝে একটা স্থায়ী আক্ষেপ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেন আরো বেশি বেশি করে বিজ্ঞানের বই লিখেন না।
বিজ্ঞান কিংবা গণিতের বই যে তিনি একেবারেই কম লিখেছেন এমন না, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা কিশোর উপন্যাসের পরিমাণের সাথে বিজ্ঞানের বইয়ের পরিমাণ তুলনা করলে দেখা যাবে বিজ্ঞানের বই আসলেই পড়ে রয়েছে তলানিতে। চমৎকার লেখনীতে বিজ্ঞান সবাই লিখতে পারে না, অল্প কয়েকজন যারা পারে তাদের মাঝে জাফর ইকবাল অন্যতম। সে দিক থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমারও দাবি- মুহম্মদ জাফর ইকবাল আরো বেশি করে বিজ্ঞানের বই লিখুন।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর এবার ২০১৮-র বইমেলায় প্রকাশিত হলো বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েনস নামে জাফর ইকবালের একটি বিজ্ঞানের বই। খুব খুশি হয়েছিলাম নন-ফিকশন ঘরানার বিজ্ঞানের এই বইটি প্রকাশ হয়েছে দেখে।
তবে বই হাতে নিয়ে খুশি অনেকটাই কমে গেছে। প্রথমত বইয়ের কালেবর একদমই ছোট। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে হোমো স্যাপিয়েনস পর্যন্ত আসতে হলে চারশো থেকে পাঁচশো পৃষ্ঠা লাগবে সচরাচর। সৃষ্টির শুরুর মুহূর্ত থেকে এগোতে এগোতে আজকের এই মুহূর্তটি পর্যন্ত আসতে আসলেই অনেক বড় কালেবরের দরকার। এমনিতে কেউ যদি নিজের উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা ব্যবহার করে আড়াইশো থেকে তিনশো পৃষ্ঠায় তা উপস্থাপন করতে পারে তাহলেও চলে যায়।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো কেউ লিখলে সেটা দুইশো পৃষ্ঠার মাঝে শেষ হয়ে গেলেও বলা যায় সমস্যা নেই। কিন্তু এই বইয়ে এত বিস্তৃত প্রসঙ্গের আলোচনা শেষ হয়ে গেছে মাত্র পঞ্চান্ন পৃষ্ঠায়। তা-ও আবার বইয়ের আকার সাধারণ উপন্যাসের বইয়ের মতো না। পকেট বইয়ের মতো ছোট। ফলে হয়েছে কি, মূল বিষয়গুলোতে শুধুমাত্র একটুখানি করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়েই শেষ।
এমনিতে যদি ধরে নেই বইটি একদমই ছোটদের জন্য লেখা, ছোটদের জন্য বলে ইচ্ছে করেই লেখক বিস্তারিত আলোচনায় যাননি, তাহলে মন্তব্য কোন দিকে যাবে? তাহলেও বলতে হবে এখানে আলোচনা যথোপযুক্ত হয়নি। ছোটদের জন্য আগ্রহী করে তুলতেও তো আগ্রহের উপাদান লাগে। বইটি একটি চমৎকার কিছু হতে গিয়েও হয়নি। বিজ্ঞানের এই বিষয়গুলোতে নিঃসন্দেহে মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য অনেক। তিনি চাইলেই একটু সময় নিয়ে বইটিকে চমৎকারভাবে সাজিয়ে লিখতে পারতেন।
বইয়ের অবস্থা দেখে যা বোঝা যায়, কোনো লেকচার বা প্রেজেন্টেশনের জন্য এটির একটি খসরা বক্তব্য তৈরি করেছিলেন। প্রেজেন্টেশন শেষে বানানো স্লাইড এবং টেক্সটগুলো কিছু এদিক ওদিক করে একটি বই করে ফেলেছেন। কিছুদিন আগে শাবিপ্রবিতে এরকম একটি প্রেজেন্টেশন বা ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়েছিল। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে আজকের পৃথিবী এবং ১৯৭১ হয়ে আজকের বাংলাদেশের টাইমলাইন নিয়ে ছিল আলোচনা। হতে পারে সেখান থেকেই জন্ম হয়েছে এই বইটি।
প্রামাণ্যচিত্রে বা প্রেজেন্টেশনে ছবি ও টেক্সট দেখানোর পাশাপাশি মুখেও কথা বলা হয়। কিন্তু বইতে এই সুযোগটি নেই। ফলে বই থেকে যায় অসম্পূর্ণ। এরকমটিই হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েনস বইয়ের ক্ষেত্রে। এরকম অবস্থা হয়েছিল প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত চর্চা করুন খবর লিখুন নামের বইতে। লেখক নবীন সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের জন্য কতগুলো প্রেজেন্টেশন স্লাইড তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে সেগুলো নিয়েই বই প্রকাশ করে ফেলেছেন। ফলে সেটি বিশেষ কিছু পাঠক বাদে অন্যান্য পাঠকদের জন্য নেতিবাচক হয়েছে।
এমন না যে প্রেজেন্টেশনকে পরবর্তীতে বইয়ে রূপান্তর করা যাবে না। অবশ্যই যাবে, তবে তা হতে হবে বইয়ের মতো। দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় লেখক করেছেন, তাদের বেলায় লেকচার বা প্রেজেন্টেশন থেকেছে লেকচার বা প্রেজেন্টেশনের মতো, বই হয়েছে বইয়ের মতো। তবে জাফর ইকবালের লেখার হাতে অসাধারণত্ব আছে। তার লেখা বিজ্ঞানের কোনো বিষয় মন্দ হতে পারে না। ভালো’র মাত্রা কম হতে পারে, কিন্তু কখনোই মন্দ হয় না।
সেজন্য এই বইটিকেও কেউ খারাপ বলতে পারবে না। আমরা লেখকের একটুখানি বিজ্ঞান, আরো একটুখানি বিজ্ঞান ইত্যাদি পড়ে লেখক সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে রেখেছি বলে বর্তমান বই দেখে সামান্য মন খারাপ হতে পারে। কিন্তু এই পূর্ব-ধারণার প্রভাব বাদ দিলে বলতে হবে বই অবশ্যই ভালো হয়েছে।
তার উপর বই সম্পর্কে চমৎকার একটি বিষয় উল্লেখই করা হয়নি। বইটি সম্পূর্ণ রঙিন। বিজ্ঞানের বই রঙিন হলে এর আনন্দই বেড়ে যায় অনেকগুণ। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের রঙিন বলতে গেলে হয়ই না, সেক্ষেত্রে এটিকে রঙিন দেখে ভালো না লেগে উপায় নেই।
রাতের আকাশ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে গ্যালাক্সিতে গমন। সেখান থেকে বিগ ব্যাংয়ের বর্ণনা। তারপর ইনফ্ল্যাশন, দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, বর্তমানের চোখ দিয়েই মিলিয়ন মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের মিলিয়ন মিলিয়ন বছর অতীতের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার অবতারণা। এর ধারাতে এসেছে মহাবিশ্বের চার প্রকার শক্তি, পদার্থ ও প্রতি-পদার্থ, মহাবিশ্বে সর্ব প্রথম আলো, ডার্ক ম্যাটার ডার্ক এনার্জি ইত্যাদি। এরপর এসেছে নক্ষত্রের জন্মের ঘটনা, সূর্য ও সৌরজগত গঠন, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের জন্ম, পৃথিবীতে পানির আগমন ও মহাদেশের উদ্ভব ইত্যাদি।
এরপর পৃথিবীর জলজ পরিবেশে প্রথম প্রাণ তৈরি হওয়া, প্রাণের উপযোগী প্রাথমিক প্রাকৃতিক পরিবেশ, এককোষী প্রাণের জন্ম, বিবর্তন, অক্সিজেন, ইউক্যারিওটিক কোষ এবং বহুকোষী প্রাণী। বহুকোষী প্রাণী থেকে উন্নত প্রাণী, প্রাণের বৈচিত্র্য তৈরি হওয়া, লজ থেকে ডাঙ্গায় প্রাণের উঠে আসা, ডায়নোসরের নাটকীয় আগমন ও বিলুপ্তি, ডায়নোসরের অনুপস্থিতিতে স্তন্যপায়ীর বিশ্ব বিজয়, প্রাইমেটের আগমন এবং মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি।
এগুলোর পাশাপাশি চার প্রকার মানুষ হোমো ইরেক্টাস, হোমো ফ্লোরোসিয়েন্সিস, হোমো নিয়ানডারথাল, হোমো স্যাপিয়েনস নিয়েও সামান্য আলোচনা আছে। আরো আছে হোমো স্যাপিয়েনসের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কথা। সব মিলিয়ে নাদুসনুদুস এই বইটিকে চমৎকার বইলেই মনে হবে।
বইয়ের ছোট একটি অংশ-
“এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের চাইতে বিস্ময়কর প্রাণী আর কী হতে পারে? মহাবিশ্বের বিলিওন বিলিওন গ্যালাক্সির মাঝে সাধারণ একটা গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথ (মিক্লি ওয়ে), সেই গ্যালাক্সির সাদামটা একটা নক্ষত্রের নাম সূর্য, সেই সূর্যের ছোট একটি নীল গ্রহের নাম পৃথিবী। সেই পৃথিবীর বাসিন্দার নাম মানুষ, তাদের মাথার দেড় কেজি ওজনের মস্তিষ্কটি ব্যবহার করে তারা বের করে ফেলেছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেমন করে সৃষ্টি হয়েছে! কেমন করে গ্যালাক্সির জন্ম হয়েছে, কেমন করে নক্ষত্র আমাদের রাতের আকাশ আলোকিত করেছে। কী আশ্চর্য!”
বইটি প্রকাশ করেছে জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, মুদ্রিত মূল্য ১৭৫ টাকা।
ফিচার ছবি- পিকাবু