ক্রিসমাস শুধুই আর ধর্মীয় উৎসব নয় এখন, বরং তার চেয়েও বড়ভাবে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হয়ে উঠেছে। সেটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। ক্রিসমাসের এই আনন্দ চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে সেকাল থেকেই চলচ্চিত্র, সাহিত্যে ক্রিসমাসের প্রবেশ ঘটেছে। ‘৩০, ‘৪০-এর দশক থেকেই ‘ক্রিসমাস ফিল্ম’ নির্মাণ শুরু হয়েছে। সেকাল থেকে একালে ক্রিসমাস ফিল্মের সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে ঠিক, তবে অধিকাংশই স্রেফ পুঁজির উদ্দেশ্যে, সততা রেখে হচ্ছে কম। ২০২২ সালেও অনেক ক্রিসমাস থিমের সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এবং সেখান থেকে ভালো ৫টি সিনেমা নিয়েই এই নিবন্ধ। ৫ জনরার ভিন্ন পাঁচটি সিনেমা। অ্যাকশন, হরর, মিউজিক্যাল, ফ্যামিলি ড্রামা, রোমান্টিক কমেডি সবই আছে এই মিশেলে।
VIOLENT NIGHT (2022) / জনরা: অ্যাকশন, কমেডি
‘ভায়োলেন্ট নাইট’-এর গল্পে দেখা যায়, ক্রিসমাসের রাতে একদল এলিট মার্সেনারি এক সুপরিচিত বিত্তশালীর ঘরে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে। তাদের উদ্দেশ্য, ওই বাড়ির গোপন ভল্টে ডাকাতি করা। ওদিকে উদাসীন এক সান্তা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিলেন নিউ ইয়র্কের অলিগলিতে। ওই বাড়ির ছোট মেয়ে কোনো একভাবে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হয় সান্তা ক্লজের কাছে। সান্তা কি আর কাউকে ফেরাতে পারে?
তবে এই সান্তা যে এমন মারমুখী, তা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। মার্সেনারিদের দলটা তো কল্পনাই করেনি, কোনো এক কল্পিত সান্তা ক্লজ তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেবে। বিশাল এক আর্মির সাথে একা লড়ে যাবে। রক্তে রাঙাবে ক্রিসমাসের এই রাত!
হোম ইনভ্যাশন সাবজনরার সাথে স্ল্যাশার, অ্যাকশন, কমেডি এবং ক্রিসমাস ড্রামার মিশ্রণে চিত্তাকর্ষক এক জনরা সিনেমা হয়েছে ‘ভায়োলেন্ট নাইট’। কারণ, সিনেমাটি যে নরওয়েজিয়ান পরিচালক টমি উইর্কোলার বানানো (‘ডেড স্নো’ ১ ও ২, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড টু মানডে’, ‘দ্য ট্রিপ’)। জনরা পরিচালক হিসেবে তিনি দুর্দান্ত। জনরার অলংকারগুলো গৌরবের সাথে আলিঙ্গন করে আবার সাবভার্ট করায় দারুণ দক্ষ তিনি। আর যে হিউমার তিনি লুকিয়ে রাখেন তার সিনেমায়, সেটা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। জনরা ম্যাশ করে বানানো এই সিনেমা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা দেয়। ‘ব্যাড সান্টা’, ‘ক্রিসমাস ইভিল’, ‘ডাই হার্ড’ সিনেমাগুলোর এক সরস অ্যামালগ্যামেশন এই সিনেমা। মজার সব চরিত্র, প্রচন্ড ভায়োলেন্স আর পূর্ণ দক্ষতার সাথে ক্রাফট করা সিনেমা। খাঁটি ক্রিসমাস ফান যাকে বলে আর কী!
SPIRITED (2022) / জনরা: মিউজিক্যাল-কমেডি
‘স্পিরিটেড’ ক্রিসমাস স্পিরিটে ভর্তি এবং পুরোপুরি উপভোগ্য সিনেমা। চার্লস ডিকেন্সের ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ এর আরো একটি আধুনিক সংস্করণ। সেকাল থেকে একাল, কত শত সংস্করণ হলো ডিকেন্সের এই মায়াময় সৃষ্টির। সিনেমা, মঞ্চনাটক, টিভি, রেডিও নাটক; বহুমাধ্যমেই অভিযোজিত হয়েছে এই গল্প। হলো আরো একবার। মিউজিক্যাল সিনেমার রূপে।
এই সিনেমা নিয়ে অনেক সমালোচকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় যে অভিযোগ পাওয়া যায় তা হলো, “ডিকেন্সের ক্লাসিক গল্পে অনেক নতুন কিছু যোগ করেনি এই সিনেমা।” যা নিয়ে অভিযোগের খুব শক্তপোক্ত কারণ দেখা যায় না। কারণ, নতুন অনেককিছুই যোগ করেছে এই সিনেমা, টুকরো টুকরো অংশে। মিউজিক্যাল হওয়াতে ট্রিটমেন্টও ভিন্ন হয়েছে। কিছু গান খুবই উপভোগ্য, ছন্দে মেতে উঠবার মতো। সেল্ফ ইন্ডালজেন্ট হিউমার আর রেফারেন্স দিয়ে, এর উদ্দেশ্য আর কোন জায়গায় পৌঁছাবে সেটাও সিনেমাটি প্রথম অংকে বলে দিয়েছে দর্শককে।
এখানে রেনল্ডস অভিনয় করেছেন একজন বিত্তশালী আর আগ্রাসী স্বভাবের মিডিয়া কনসাল্টেন্ট চরিত্রে। যার চরিত্রের আর্কিটাইপ মেলে গল্পের ওই বুড়ো স্ক্রুজের সাথে। ওদিকে আফটারলাইফের কিছু ক্রিসমাস ভূত মিলে প্রতিবছর ক্রিসমাসে একজন খারাপ মানুষের আত্মার পরিশোধন করে; তাকে তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের এক জার্নিতে নিয়ে গিয়ে। এ বছর নাম আসে রেনল্ডসের, যার পরিশোধন আসলে অসম্ভব! কিন্তু সেই দায়িত্ব হাতে নেয় ক্রিসমাস ভূতদের দলনেতা। একটা ব্যক্তিগত কারণও আছে যার পেছনে। শুরু হয় হাস্যরস আর অননুমেয় উপাদানে ভরা এক জার্নির, যার একপর্যায়ে আসল স্ক্রুজের পরিচয় সামনে আসাসহ কিছু টুইস্টের স্বাদও দেওয়া হয় দর্শককে।
শুধুই আশাবাদীতায় ঠেসে থাকেনি এই সিনেমা।। অপরদিক, মানে নৈরাশ্যবাদও তুলে এনেছে রায়ান রেনল্ডসের চরিত্রায়নে। ক্রিসমাস স্পিরিট ঠিক রেখে শেষটাও অমন আনন্দময় আর অনুপ্রাণিত হবার অনুভূতি এবং আবেগের অনুনাদ রেখেই হয়েছে। নির্ভেজাল সিনেমা। পরিচিত সবকিছুই, কিন্তু ওতে মিশে থাকে ভালোলাগাও। হালকাভাবে থাকা বক্তব্য, বার্তা, সাথে হাসি আর আনন্দ, এবং অতি অবশ্যই রায়ান রেনল্ডস আর উইল ফ্যারেলের চনমনে রসায়ন নিয়েই ক্রিসমাসের যথাযথ প্যাকেজ ‘স্পিরিটেড’, যার সিক্যুয়াল পেতে মরিয়া থাকবে বিনোদিত হওয়া যেকোনো দর্শক।
A CHRISTMAS STORY CHRISTMAS (2022) / জনরা: ফ্যামিলি-ড্রামা, কমেডি
ক্রিসমাসের আসল আবহ ফ্যামিলি ড্রামাতেই পাওয়া যায়। কারণ ক্রিসমাস তো সেই একাত্মতার গল্প বলে, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার গল্প বলে। এ তেমনই এক সিনেমা। গল্পের মূল কথক রালফি। এ তারই গল্প। কর্পোরেট চাকরি থেকে এক বছর ছুটি নিয়েছে। কারণ, এই ইঁদুরদৌড়ে সে নেই। সে হতে চায় ঔপন্যাসিক। গত এক বছর ধরে সেই চেষ্টা করলেও ফলপ্রসু হচ্ছে না।
ডিসেম্বরের মধ্যভাগ শেষ হতে চললেও রালফির গল্প এখনও কেউ নিচ্ছে না। হতাশ হয় রালফি। আশা ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে ক্রিসমাসও দরজায়। মা-বাবার আসার কথা। কিন্তু বাবার অকস্মাৎ মৃত্যু তাদের শোকগ্রস্ত করে টেনে নেয় রালফির নিজেদের সেই বাড়িতে যেখানে তার শৈশব কেটেছে। শোক কাটিয়ে রালফির পরিবারও মুখে হাসি ফোটাতে চাচ্ছে এই ক্রিসমাসে। অন্তত রালফির ছোট ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে। এদিকে রালফি এখনও চেষ্টায় আছে তার গল্প প্রকাশের। সেই সাথে পরিবারের কাছেও প্রতিজ্ঞা করেছে শ্রেষ্ঠ ক্রিসমাস উপহার দেবে এবার। কিন্তু সবকিছু বিপরীতভাবেই ঘটতে শুরু করে।
‘অ্যা ক্রিসমাস স্টোরি ক্রিসমাস’ পরিশুদ্ধভাবেই ক্রিসমাসের সিনেমা। মফস্বল শহরের সেটিং, শহরের রঙিন সব চরিত্র রালফির শৈশবের নস্টালজিয়াকে যেভাবে জাগায়, সেই একই স্মৃতিমেদুর অনুভূতিতে আটকায় দর্শককেও। পরিচিত সবকিছু। কিন্তু যে যত্ন আর বিশ্বাসের সাথে বানানো, সেটাই সিনেমাকে কমনীয় করে তোলে। আবার হো হো করে হেসে ওঠার মতোও সব ঘটনা আছে। মূল চরিত্রের সাহিত্যপ্রীতি থাকায় সিনেমা আর সাহিত্যের দারুণ সব রেফারেন্স পাওয়া যায়। আর রালফির কল্পনাপ্রবণতা ন্যারেটিভে আরো মজার বাঁক তৈরির সুযোগ করে দেয়। নানা কমিক ভিনিয়েট দিয়ে সাজানো গল্পটি। এস্টার এগগুলোও সুন্দর করে রাখা চিত্রনাট্যে। তার সাথে আছে যত্নবান পরিচালনা। একদম ক্রিসমাস নস্টালজিয়ার ট্রিপ। উষ্ণ হৃদয় নিয়ে উদযাপন করার মতো মুহূর্ত দেয় এই সিনেমা।
CHRISTMAS BLOODY CHRISTMAS (2022) / জনরা: হরর-স্ল্যাশার
হররে স্বকীয় একজন ফিল্মমেকার হয়ে ওঠা জো বেগোসের নতুন ক্রিসমাস স্ল্যাশার ‘ক্রিসমাস ব্লাডি ক্রিসমাস’। জো বেগোসের হরর মানেই রেট্রো ভাইবে ভরপুর। ‘৭০-এর দশকের গ্রাইন্ডহাউজ সিনেমা, আশির স্ল্যাশার সব একত্রিত করে বানানো খুবই মজাদার ‘বি-মুভি’। এটাও তেমনই। প্লটের দিকে না ঝুঁকলেই ভালো। স্টাইল আর ফিল্মমেকিংয়ের ব্রিলিয়ান্সি দেখানোই উদ্দেশ্য।
‘ব্ল্যাক ক্রিসমাস’, ‘হ্যালোউইন’-এর মতো ক্লাসিক হররগুলোর অনুপ্রেরণায় তৈরি এই সিনেমা। সাথে আবার ‘টার্মিনেটর’, ‘রোবোকোপ’-এর ভাইবওয়ালা এক রবোটিক সান্তা ক্লজকে সাইকো কিলার বানিয়ে একেবারে নিখুঁত ‘আউটরেইজেস বি-মুভি’ হয়েছে। ক্রিসমাসের রাতে মাদক, নেশা আর উদ্দাম যৌনতায় মত্ত থাকা তরুণ-তরুণীদের ধরে ধরে শায়েস্তা করতে বেরিয়েছে এই রবোটিক কিলার সান্তা। যান্ত্রিক ত্রুটিই এই খেলনার দোকানের খেলনা সান্তা ক্লজকে রবোটিক কিলার বানিয়েছে। সাধে কী আর বলেছি “আউটরেইজেস”! জো বেগোস ‘৭০, ‘৮০-র দশকের হরর সিনেমাগুলোর মূল যে প্রকৃতি, মানে প্লটের দিক থেকে একটা ‘আউটরেইজেস’ ভাব থাকা, সেটা নিখুঁতভাবে ধরতে পেরেছেন।
ইমেজের গ্রেইনি ভাব ‘৭০-এর গ্রাইন্ডহাউজ সিনেমার কোয়ালিটিই এতে এনে দেয়। আবার, এই সময়ের লুক এন্ড ফীল আনতে ইমেজারিগুলোকে নিয়ন আলোতে ভেজানো হয়েছে রীতিমতো; চোখধাঁধানো আলোর মতোই। প্র্যাক্টিক্যাল ইফেক্টস আর সেট পিসের মাঝে সেভেন্টিজ, এইটিজের ছোঁয়া আছে। দারুণ পেসে দর্শককে টেনে নিয়ে গেছেন জো বেগোস। আবার একটা পোস্ট মি-টু টোনও আছে এই সময় অনুযায়ী। মূল চরিত্র টরি (রাইলি ড্যান্ডি) দুঃস্বপ্নের মতো যে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেটা পুরুষশাসিত সমাজে বাস করার দুঃস্বপ্নময় বাস্তবকেই রূপক দিয়ে প্রকাশ করে। তা যাক। অনুপ্রেরণা, হোমাজ, বক্তব্য- সব মিশিয়ে সিজনাল হরর হিসেবে ‘ক্রিসমাস ব্লাডি ক্রিসমাস’ আসলেই দারুণ উপভোগ্য। কিংবা বলা যায় “ব্লাডি গুড ফান”!
SOMETHING FROM TIFFANY’S (2022) / জনরা: রোমান্টিক-কমেডি
ক্রিসমাস রোমান্টিক-কমেডি ‘সামথিং ফ্রম টিফেনি’স’। এই গল্প দুই প্রেমিক যুগলের। এক যুগলের প্রেমিক ক্রিসমাসে প্রেমিকাকে উপহার দেবার জন্য কানের দুল কিনে আনছিল। রাস্তায় গাড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর সেদিনের স্মৃতি সে ভুলে যায়। ওদিকে তাকে সহায়তা করা আরেকজনও সেদিন আংটি কিনেছিল তার প্রিয় মানুষের জন্য। দুর্ঘটনার মাঝে এই দুটি জিনিস অদলবদল হয়ে যায়। এবং ঠিকঠাক করে নেবার আগেই একজনের প্রেমিকার হাতে পড়ে যায়। প্রেমিক তো ভুল ভাঙায় না। ওদিকে আরেক যুগলের প্রেমিকও সরাসরি কিছু বলতে না পারায় বন্ধুত্ব করে। এবং সেটাই আরো অনেক ঘটনার জন্ম দিতে শুরু করে।
হালকাচালের, কিন্তু কমনীয় প্রেমের সিনেমা এটি। আরাম আছে সিনেমাটিতে, যার প্রধান কারণ গল্প বয়ানের মাধুর্য এবং সাবলীল অভিনয়। নব্বইয়ের রম-কমের ভাইব আছে। আর এমন সিনেমাগুলো ভালো লাগাতে যেমন সুদক্ষ আর পছন্দসই কাস্টিং এবং রসায়নের প্রয়োজন হয়, সেসব যথাযথভাবেই ছিল। সেই কারণেই এই হলিডে রম-কম আবেদন রাখবে দর্শকদের মাঝে।