বক্স অফিস কাঁপাচ্ছে সঞ্জু: মিশ্র প্রতিক্রিয়া সমালোচকদের

একের পর এক বক্স অফিস রেকর্ড ভেঙে চলেছে রাজকুমার হিরানি পরিচালিত বলিউড তারকা সঞ্জয় দত্তের বায়োপিক ‘সঞ্জু’। হিন্দি ছবির ইতিহাসে একদিনের সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ডে বাহুবলী ২-কে হটিয়ে নতুন নামটি এখন সঞ্জুর! মুক্তির তৃতীয় দিনে বাহুবলী ২ এর আয় ছিল ৪৬.৫০ কোটি রুপি, সেখানে সঞ্জুর আয় ৪৬.৭১ কোটি রুপি।

সঞ্জু সিনেমার পোস্টার © Vinod Chopra Films

সোমবার, অর্থাৎ মুক্তির চতুর্থ দিনে এসেও জয়যাত্রা অব্যহত রেখেছে ছবিটি। এদিনও এটি আয় করেছে ২৫.৩৫ কোটি রুপি। এ নিয়ে চার দিন শেষে ছবিটির আয় গিয়ে দাঁড়ালো ১৪৫.৪১ কোটি রুপিতে। এ বছরের শত কোটির ক্লাবে ‘সিনিয়র সদস্য’ রেস থ্রি ও পদ্মাবতের প্রথম দিনের আয়কে শুরুতেই টপকে গিয়েছিল সঞ্জু। প্রথম দিনে এটি আয় করেছিল ৩৪.৭৫ কোটি রুপি। এমনকি দ্বিতীয় দিনের আয় (৩৮.৬০ কোটি) এর দিক থেকেও ২০১৮ সালের সেরা এই ছবিটিই।

১৯৮১ সালে বাবা সুনীল দত্তের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘রকি’ মুক্তি পাবার পরেই রাতারাতি তারকা বনে যান সঞ্জয় দত্ত। মাদকাসক্তি, নারী-আসক্তি, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হর্তাকর্তাদের সাথে যোগসাজশসহ বহু বিতর্কে ঠাসা এই সুপারস্টারের জীবন। ১৯৯৩ সালে মুম্বাই বোমা হামলায় সংশ্লিষ্টদের অস্ত্র নিজ মজুদে রাখার অভিযোগ ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিতর্ক। ভয়াবহ এ বোমা হামলায় নিহত হয়েছিল প্রায় আড়াইশো মানুষ। পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিলো সঞ্জয়ের। ট্রেইলারেই যেমনটি দেখানো হয়েছিল, মানুষ একজন কিন্তু জীবন যেন অনেকগুলো, চলচ্চিত্রটিও সেটির বুনিয়াদেই নির্মিত। মায়ের মৃত্যু শোক, দেবতুল্য বাবার আজন্ম ছায়া হয়ে পাশে থাকা, স্ত্রী মান্যতা আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরেশের নিঃস্বার্থ সাহচর্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে সঞ্জয়ের বর্ণিল জীবন কীভাবে বারবার আক্রান্ত হয়েছে খারাপ সঙ্গের দ্বারা, দুর্ভাগ্যের দ্বারা।

সঞ্জু সিনেমার একটি দৃশ্য; Image Source: India Today

সিনেমাটিতে রণবীরের বাবা সুনীল দত্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরেশ রাওয়াল, মা নার্গিসের চরিত্রে মনীষা কৈরালা, স্ত্রী মান্যতা দত্তর চরিত্রে দিয়া মির্জা, বন্ধু পরেশ গিলানির চরিত্রে ভিকি কৌশল, প্রেমিকা রুবি চরিত্রে সোনম কাপুর, সঞ্জুর বায়োগ্রাফার চরিত্রে আনুশকা শর্মা ও ড্রাগ-ডিলার বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জিম সর্ভ।

হিরানিকে বলা হয় বলিউডের ‘হিট-ম্যাশিন’। সেই সঙ্গে ছবির গল্প যার জীবন থেকে নেওয়া, জীবন যেন তার এক রোলার কোস্টার রাইড। বলিউডের প্রিয় এই ব্যাডবয়ের জীবনের রংকে সেলুলয়েডে তুলে ধরতে হিরানির তুরুপের তাস ছিলেন রণবীর কাপুর। ট্রেইলারেই সঞ্জুবাবার লুকে রণবীরকে দেখে ভক্তদের চোখ ছানাবড়া হবার যোগাড়! ব্যস, সিনেমা সুপারহিট কেন হবে না?

বাঁয়ে আসল সঞ্জু, ডানে পর্দার সঞ্জু; Image Source: Youtube

সঞ্জয় দত্ত একবার এই রণবীরকেই বলেছিলেন, “তুমি তো বালক। আমার চরিত্রে অভিনয় করতে হলে পুরুষ হতে হবে।” বলিউডের চকোলেট-বয় রণবীর এরপর যা করলেন, তা ইতিহাস। ব্যায়ামাগারে ঘাম ঝরিয়ে চওড়া বক্ষ-কাঁধের পেটা শরীর বানালেন। সাথে মেকআপ শিল্পীদের অনবদ্য ছোঁয়ায় ঠিকই বনে গেলেন ‘পুরুষ’। হাঁটা-চলায় আর মুখের বলনীতে ঠিক যেন সঞ্জয়ের ক্লোন! এমনকি মাথা দুলিয়ে কথা বলা, আরেক হাত দিয়ে বাহু চেপে ধরার মুদ্রাদোষগুলোও রপ্ত করেছেন রণবীর। রণবীরের ক্যারিয়ারের সেরা কাজ রকস্টারের জর্ডান আর বরফির মারফির সাথে এটিও থাকবে নিঃসন্দেহে, কেউ কেউ তো একেই এগিয়ে রাখতে চাইছেন।

আইএমডিবি-তে আমজনতা ও বোদ্ধাদের মিলিত রেটিং-এ এখন অবধি বেশ ‘স্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় আছে সঞ্জু, পেয়েছে ৯.১। টাইমস অব ইন্ডিয়াও করেছে ভূয়সী প্রশংসা, ৪ রেটিং দিয়েছে তারা। ওদিকে রোটেন টমেটো সাইটের সিনেমাবোদ্ধাদের কাছ থেকে গড়ে ৬.৩ রেটিং পেয়েছে সঞ্জু। চলচ্চিত্র সমালোচনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মধ্যে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে অনেকেই মানেন সেরা। মাত্র দুই রেটিং দেওয়া হয়েছে সঞ্জুকে সেখানে। কী বলছে গার্ডিয়ান? মাইক ম্যাককাহিলের সেই রিভিউতে তীর্যক খোঁচা দিয়ে বলা হয়েছে-

“…যেন তিন ঘণ্টার এক আত্ম-সাফাই। বাবার নিয়ন্ত্রণ থেকে পালানো আর মাকে সরিয়ে দেবার জন্য মাদকের আশ্রয় নিলেন সঞ্জু। নারী? তিনি ছিলেন অস্থিরচিত্ত আর ভগ্ন-হৃদয়ের মানুষ। অস্ত্র? আত্মরক্ষার জন্য। বদনামী? সব দোষ মিডিয়ার।”

সঞ্জু-কমলেষের বন্ধুত্বের রসায়ন আর কমলেষ চরিত্রে ভিকিও নজর কেড়েছেন আলাদা করে; Image Source: Indian Express

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রাজীব মাসান্দের মোটের ওপর মন্দ লাগেনি ‘সঞ্জু’-কে। ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রত্যেক অভিনেতা, মেকআপ ও পোশাক শিল্পীর। বিতর্কিত জীবনের ধারাবিবরণীতে স্বচ্ছতা আছে কি নেই, সে প্রশ্ন ফিকে হয়ে গেছে চিরচেনা ‘হিরানিসুলভ’ মেলোড্রামা, আবেগ আর কমেডির আয়োজনে। গার্লফ্রেন্ডের (সোনম কাপুর) বাড়িতে মাঝরাত্তিরে মদ চাইতে গিয়ে যে ‘ভাষণ’ দিয়েছেন সঞ্জু, তাতে রাজীবের মনে পড়ে গেছে থ্রি ইডিয়টসে চতুর রামালিঙ্গমের সেই ‘বলাৎকার’-এর কথা, সঞ্জয়ের সে ‘ভাষণ’ নাকি তার চেয়েও ভালো ছিলো! ‘সঞ্জু’কে রাজীব দিয়েছেন সাড়ে তিন রেটিং। তার মতে, চলচ্চিত্রটিতে বায়োপিকের পুঁথিগত ছক মানা হয়নি, পুরো জীবনের বদলে জীবনের একটি দিক বেছে নিয়েছেন নির্মাতা; সেই সঙ্গে মূল ব্যক্তিটির নিজের জায়গা থেকে গল্পটি বর্ণনা করে বিতর্কিত তারকাকে দেখাতে চেয়েছেন অধিকতর মানবিক হিসেবে। তবে সঞ্জয় ‘বেচারা’ নাকি ‘ব্যাড বয়’, ছবিটি দেখবার পর সেই সিদ্ধান্ত নেবার দায় দর্শকদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। ওদিকে অদ্ভুত কারণ দেখিয়ে সঞ্জুর রিভিউ লিখবেন না বলে জানিয়েছেন আরেক নন্দিত সমালোচক অনুপমা চোপড়া।

সবচেয়ে ক্ষুরধার ও বিস্তারিত সমালোচনা করেছে সম্ভবত হিন্দুস্তান টাইমস। তারা রেটিং দিয়েছে মাত্র আড়াই! বলা হচ্ছে-

“সঞ্জুতে হাস্যরসসমৃদ্ধ যুক্তি দেখিয়ে হিরানি আপনাকে একটি পক্ষ নিতে বাধ্য করবেন ঠিকই, তবে তাতে গভীরতা থাকে সীমিতই।… … রণবীরের অসাধারণ নৈপুণ্যে এই গভীরতার অভাব ঢাকা পড়ে গেছে অনেকটা।”

বাবা-ছেলের সম্ভবত সবচেয়ে আবেগঘন দৃশ্য গোটা সিনেমায়; Image Source: The First Post

চলচ্চিত্রটিতে সঞ্জুর বিগত দুই স্ত্রী ও কন্যা ত্রিশলা ছিলেন অনুপস্থিত, এমনকি মান্যতার সাথে পরিচয়-রসায়নের দিকটিও ছিল অনুপস্থিত। সঞ্জুর কারামুক্তির জন্য দ্বারে দ্বারে যে মানুষ দুটি ছুটেছেন, তারা হলেন দুই বোন নম্রতা ও প্রিয়া। সেই বোনেদের সাথে আজ সঞ্জুর মুখ দেখাদেখি বন্ধ কেন, তার জবাব নেই ছবিটিতে, কেননা বোনেরাও এই ছবিতে অনুপস্থিত। মাধুরী দীক্ষিতের সাথে প্রেম, সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান, পরিচালক সঞ্জয় গুপ্তের সাথে ২০ বছরের বন্ধুত্ব শেষ হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকও উপেক্ষিত হয়েছে ছবিটিতে। এসবের বাইরে কেবল সঙ্গদোষে মাদকাসক্তি ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মুম্বাই বোমা হামলাকাণ্ডে নাম জড়িয়ে যাওয়াই মূলত ছবিটিতে মুখ্য হয়েছে। সঞ্জয় এসবের পাল্লায় পড়ে আর মিডিয়ার বাড়াবাড়িতে কেবল ভুক্তভোগীই হয়েছেন বলে দাবি করে ছবিটি। একজন সাধারণ দর্শক এ প্রসঙ্গে ফোড়ন কেটেছেন, “চলচ্চিত্রটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘মাই নেম ইজ সঞ্জু এন্ড আই অ্যাম নট আ টেরোরিস্ট’!”

ছবির একটি দৃশ্যে মান্যতা ও সঞ্জু; Image Source: NewsBytes

তবে ছবির একটি দৃশ্যে সঞ্জুকে মান্যতা বলেন, “খারাপ চয়েস ভালো গল্প তৈরি করে। আর তুমি হচ্ছ সেই খারাপ চয়েসের রাজা।” সুতরাং নির্মাণ নিয়ে যত আপত্তিই থাকুক বোদ্ধাদের, গল্পের জমাটি রসায়ন আপনাকে আড়াই ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে সক্ষম। গল্পটি কেবলই একতরফা সাফাই নয়, গল্পটি একজন বাবার, যার সামাজিক অবস্থান পাহাড়সম চাপ হয়ে দাঁড়ায় কিশোর সন্তানের মাথায়। গল্পটি একজন বাবার, যিনি শত অভিঘাতেও নিজের পুত্রকে নিয়ে তিনি আশা হারাননি। বাবার সাথে পুত্রের কৈশোর-তারুণ্যে তৈরি হওয়া চিরাচরিত্র দূরত্ব কীভাবে ঘুচে যায় জীবনের অভাবনীয় নাটকীয়তায়, তাও পাবেন এই গল্পে। মা হারাবার শোক কতখানি শক্তি হতে পারে যে তা একজন ভয়াবহ মাদকাসক্তকেও নিজের বুনো সত্তার সাথে চরমতম লড়াইয়ের প্রেরণা দেয়, তাও আছে এই গল্পে। যদি ভেবে থাকেন নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বও পৃথিবী থেকে উঠে গেছে, তাহলেও গল্পটি আপনার জন্য, আপনার ভুল ভাঙানোর জন্য। রণবীরের সঙ্গে সুনীল দত্তের চরিত্রে পরেশ রাওয়াল ও কমলেষ (পরেশ গেলানি) চরিত্রে ভিকি কৌশল আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সুতরাং দেখে ফেলতেই পারেন বি-টাউনের ব্যাড বয়ের এই সেলুলয়েডীয় উপাখ্যান।

Featured Image Source © Vinod Chopra Films

Related Articles

Exit mobile version