নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা…
তিনি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল এবং প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। ‘নায়করাজ’ এই উপাধির উপরে একচ্ছত্র আধিপত্য তার। বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাকে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পকে ইন্ডস্ট্রিতে রূপান্তর করার পেছনে এই গুণী শিল্পীর অবদান একনিষ্ঠ এবং অপরিহার্য।
রাজ্য তৈরি থেকে শুরু করে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর রাজত্বের গল্পটাও বেশ সিনেমাটিক। ১৯৬৪ সালের দিকে পূর্ব বাংলার নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় ওপার বাংলাসহ ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে শুরু হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই উত্তাল সময়ে ছেলে বাপ্পা আর স্ত্রী রাজলক্ষীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় পা রাখলেন রাজু ওরফে আবদুর রাজ্জাক নামের বছর বাইশের এক স্বপ্নবাজ যুবক।
১৯৪২ সালে তিনি জন্মেছিলেন কলকাতার টালিগঞ্জে। অভিনয়ের হাতেখড়ি ছিলো মঞ্চ। এজন্যই হয়তো অভিনয়টা ছিল বেশ পাকাপোক্ত। টালিগঞ্জের সিনেমাশিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিতদের জয়জয়কার। সেখানে আর সবার মতো সাধারণ ছেলে রাজুর অভিনয় সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তার উপর শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। শেষমেশ পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়লো এই যুবকের জন্যে। এক সুহৃদের পরামর্শে পরিবার নিয়ে চলে এলেন পূর্ব বাংলায়।
ঢাকার চলচিত্রে তখন হিন্দি আর উর্দুর প্রভাব। পরিচিত একজনকে ধরে কোনরকমে কাজ শুরু করলেন ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার পরিচালক আবদুল জব্বারের প্রোডাকশন হাউজ ইকবাল ফিল্মজ লিমিটেডে। বেশ কিছু সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করে চলছিলেন, এর মধ্যে সু্যোগ এলো জহির রায়হানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার, ভাগ্যটা প্রসন্ন হলো তখনই।
জহির রায়হানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমাতে সহকারী হিসেবে কাজ করলেন। জহির রায়হান লোককাহিনী অবলম্বনে ‘বেহুলা’ বানাবেন, কিন্ত লখিন্দরের চরিত্রে মনের মতো কাউকে পাচ্ছেন না। পুরো সিনেমায় কঙ্কাল হয়ে শুয়ে থাকতে কোনো নায়কই রাজি হচ্ছিলেন না। অবশেষে জহির রায়হানের কাছ থেকেই প্রস্তাবনা এলো, “রাজু, আপনিই আমার ছবির নায়ক”। পরিচালকের হাতের সুনিপুণ ছোঁয়ায় বাংলা সিনেমার পর্দায় জন্ম হলো নায়ক রাজ্জাকের।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই কিংবদন্তীকে। স্বাধীনতার পর থেকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে ছিল রাজ্জাকের একচেটিয়া রাজত্ব। রোমান্টিক সিনেমা করে নিজের প্রেমিক ইমেজ তৈরি করেছেন, আবার রংবাজের মতো সিনেমায় অভিনয় করে নিজের হাতে সেই ইমেজ ভেঙেচুরে নতুন ইমেজের জন্ম দিয়েছেন। কখনও নীল আকাশের নিচে হেঁটে চলা মিষ্টি চেহারার প্রেমিক, আবার কখনও হার্টথ্রব নায়ক থাকা অবস্থায় রূপালী পর্দায় হাজির হয়েছেন লুঙ্গি পরে! ছুটির ঘন্টা সিনেমায় স্কুলের দপ্তরী হিসেবেও নিজের অভিনয়ের বহুমুখীতা দেখিয়েছেন।
একের পর এক নায়িকাদের সাথে জুটি বেঁধেছেন এবং প্রতিটি জুটি প্রায় সমান তালে দর্শকনন্দিত হয়েছে। তবে নায়করাজ রাজ্জাক এবং মিষ্টি মেয়ে কবরী বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে আলোচিত ও সফল জুটি। পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ সময়ে পেশাদারিত্বের এক দারুণ পরিচয় দিয়ে গেছেন তিনি। এতটা সময় ধরে কাজ করা সত্ত্বেও কখনও তার নামে কোনো নেতিবাচক গুজব শোনা যায়নি। সত্যিকারের পেশাদারিত্ব এবং অভিনয়ের প্রতি যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়ে গেছেন তা আসলেই প্রশংসনীয়।
অভিনয় জীবনে তিনি ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’ এবং ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সহ মোট ৩০০টি বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।
ক্যামেরার সামনে তিনি ছিলেন মিষ্টি প্রেমের এক সুদর্শন নায়ক। যখন ক্যামেরার পেছনে গেলেন, হলেন দক্ষ পরিচালক। শুধু তা-ই নয়, প্রযোজনা করেও বের করে আনলেন বেশ ভালো কিছু ছবি। রাজলক্ষী প্রোডাকশান হাউজ থেকে নির্মিত হয়েছে বিশটি ছবি। পরিচালনা করেছেন আঠারোটি। দর্শক যেন কখনো একঘেয়েমি অনুভব না করে এবং গল্পের নতুনত্ব যেন বজায় থাকে- এ ব্যাপারে অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তিনি। চরিত্র এবং গল্পের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলেই তিনি হতে পেরেছেন বাংলা সিনেমার আইকন ‘নায়করাজ রাজ্জাক’।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
শুধু নায়কই নন, তিনি ব্যক্তি হিসেবেও বেশ কৃতজ্ঞ এবং দূরদর্শী ছিলেন। পরিবারের প্রতি ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। রিফিউজি থেকে অজানা শহরে নিজের নামকে অমর করা, অচেনা একজন থেকে সকলের নয়নের মণি হবার পরেও রাজ্জাক ভুলে যাননি যাঁদের কারণে তাঁর সেদিনের অবস্থান, সেই দর্শকদের কৃতজ্ঞতা জানাতে। ব্যক্তিজীবনে পাঁচ সন্তানের জনক তিনি এবং স্ত্রী লক্ষ্মীর সাথে বিবাহিত জীবন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। সুখী দাম্পত্যজীবনের এক আদর্শ এই দম্পতি। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধা দিয়ে বাংলা সিনেমা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন রাজ্জাক আর লক্ষ্মী ছিলেন সর্বদা ছায়া হিসেবে। এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি তিনি সোনার সংসারে। নায়করাজের রাজ্জাক হয়ে ওঠার পেছনে লক্ষ্মীর অবদানটা না বললেই নয়, আর সেটা রাজ্জাকও সবসময়ই স্বীকার করেন। জীবনে সফলতার জন্য লক্ষ্মীর অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসাকে তিনি সবসময় কদর করেছেন।
২০১৬ সালে ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে বিবিসিকে রাজ্জাক বলেন, “আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি।”
বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে সবচেয়ে ঝলমলে তারা নায়করাজ রাজ্জাক নিজের জীবনের সকল চরিত্রের পাট চুকিয়ে পাড়ি গত বছরের অগাস্ট মাসে চলে গেছেন পরপারে। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ছ’টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী এই স্তম্ভ। বিকেল পাঁচটার দিকে নিজ বাসস্থানে অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে গুলশানের এই হাসপাতালে নেয়া হয়। এখানেই শেষ হয়ে যায় এই কিংবদন্তীর জীবনের গল্প।
একজন শরণার্থী আবদুর রাজ্জাক থেকে তিনি হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। নিজের ভাগ্যকে নিজ মেধাগুণে পরিবর্তন করে তিনি বাংলা সিনেমার যে প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন, তা বর্ণনাতীত এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণাস্বরূপ। ভক্তমনে তিনি আজীবন তারুণ্যদীপ্ত এক যুবক হয়ে থাকবেন, বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের আকাশে থাকবেন সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।