ক্যাফেটেরিয়ায় বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে মহামায়া, সুদেষ্ণা ও অমিতাভ। হঠাৎ চশমা পরা রোহিত মেহতা এসে দাঁড়াল তাদের কাছে। পরনে নীলরঙা টি-শার্ট আর হলুদরঙা একটি প্যান্ট। মহামায়াকে উদ্দেশ্য করে মুখ খুলল রোহিত।
– এক্সজিউজ মি!
– ইয়েস।
– আপকে ছাত… মাতলাব… আপনার ছাথে ইকটু কোথা ছিলো।
– টেল মি!
– নট হেয়ার, আপনি জোদি ইকটু বাহার আশেন…
– ইংরেজিটাই থাক, হিন্দিটা আমার পোষায় না, আর বাংলাটা আপনার আসে না।
এই বলে রোহিতের সাথে বাইরে গেল মহামায়া। রোহিত ভাঙা ভাঙা বাংলা, হিন্দি, আর ইংরেজির সংমিশ্রণে কোনোরকম বোঝালো যে, সে মহামায়ার প্রতি দুর্বল। রোহিতের পরিবার গুজরাটি হলেও তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষার সবই কলকাতায়। কিন্তু তবুও সে সঠিকভাবে বাংলা রপ্ত করতে পারেনি। অপরদিকে, মহামায়া রোহিতের সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তের, যে আপাদমস্তক বাঙালী। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অগাধ টান ও ভালোবাসা তার। স্বভাবতই, একজন গুজরাটির মুখে ভাঙা ভাঙা ভুল বাংলায় প্রেম নিবেদন শুনলে রেগে যাবার কথা। তাই সে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল,
আমাদের কিছু মিলে না। প্রেম তো দূরের কথা, বন্ধুত্বেরই কোনো অবকাশ নেই। আপনারা সকালে উঠেই ধোকলা খেতে বসেন, আর আমাদের প্লেটে থাকে সাজানো মাছের বাহার।
তবুও রোহিত বোঝানোর চেষ্টা করল, সে বাংলাকে অনেক ভালোবাসে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সত্যজিৎ রায়কে পড়ে, এমনকি বাংলা গানও জানে। তখন মহামায়া রোহিতকে বলল,
আমাকে নিয়ে পুরাদস্তুর একটা বাংলা গান লিখে, তা পরিষ্কার উচ্চারণে গেয়ে শোনাবেন। তারপর নাহয় আপনার কথা ভেবে দেখব!
মহামায়ার পর্বত-কঠিন ভালোবাসাকে জয় করতে দুরূহ এক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় রোহিত, ভাঙা ভাঙা বাংলা জানা রোহিত গ্রহণ করে নেয় সেই চ্যালেঞ্জ।
এর কিছুদিন পর উচ্চশিক্ষার জন্য পর্তুগালে পাড়ি জমায় সে। বিষয় হিসেবে বেছে নেয় সঙ্গীত। বাঙালী বন্ধু বোধির সহায়তায় বাংলাচর্চার পাশাপাশি, গিটার নিয়েও টুংটাং সময় কাটাতে থাকে রোহিত। গ্রন্থাগারে পড়াশোনার ফাঁকে হঠাৎ একটি বই তার নজর কেড়ে নেয়।
সেই বই থেকে সে জানতে পারল হেন্সম্যান অ্যান্টনির কথা। এক পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর ঘরে ভারতীয় উপমহাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা কবিগানের এই দিকপাল। অ্যান্টনির প্রতি দারুণ আগ্রহ জন্মাল তার। কারণ, অন্য ভাষার লোক হয়ে তিনি বাংলা ভাষাকে জয় করে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন, এবং রোহিতের অবস্থাও প্রায় একই। মহামায়ার পাণিপ্রার্থী হতে হলে যে ভালো বাংলা শিখতে হবে!
তাই গবেষণার জন্য সে চলে আসে পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গায় (বর্তমানে চন্দননগর), যেখানে বসেই অ্যান্টনি তার জীবনে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মসমূহ নির্মাণ করেন। কিন্তু প্রাচীন ফরাসডাঙ্গা আর বর্তমানের চন্দননগরের মধ্যে বিরাট তফাৎ। সেখানের প্রায় সকলেই অ্যান্টনিকে ভুলে বসেছে। কেউই অ্যান্টনি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারল না। তাই হতাশ হয়ে শেষমেশ রোহিত দ্বারস্থ হয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের। সেখানে গিয়ে সে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সংস্কৃতির উপর কিছু বইয়ের নাম বলে। কিন্তু লাইব্রেরিয়ান কুশল হাজরা জানায়, এই বইগুলোতে অ্যান্টনিকে খুঁজে কোনো লাভ নেই। অ্যান্টনি সম্পর্কে জানতে চাইলে রোহিত যেন রাত আটটায় স্যাক্রেড হার্ট চার্চের পেছনে অবস্থান করে। আটটায় ঐ জায়গায় উপস্থিত থাকলে কুশল হাজরা নিজের কক্ষে নিয়ে যায় রোহিতকে। সবকিছুর শুরু মূলত ওখান থেকেই।
পরিচালক সৃজিত মুখার্জি শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পের তালিকা করলে ‘জাতিস্মর’ একেবারে সামনের কাতারেই থাকবে। নব্যনির্মাতা হিসেবে ‘অটোগ্রাফ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘মিশর রহস্য’, ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মতো মাস্টার-ক্লাস সিনেমা উপহার দিয়ে টলি পাড়ায় তিনি তখন তুঙ্গে। ‘জাতিস্মর’ সিনেমা গ্রন্থনে নামার আগে তাকে যে কোমরে গামছা বেঁধে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়েছে, এর ছাপ ছবির প্রতিটি ফ্রেমেই সুস্পষ্ট। চলচ্চিত্রটি তিনি ব্রিটিশ ভারত ও বর্তমান ভারত; মোট দুই সময়ে বিভক্ত করেছেন। হেন্সম্যান অ্যান্টনি বা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বর্তমান সময়ের রোহিত ও মহামায়ার ঘটা প্রণয়কাব্যের পরতে পরতে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাকে স্থান দিয়েছেন। যে সময়টা আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয় অ্যান্টনি ও ক্ষয়ে যাওয়া বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে।
ফিল্মের মূল চরিত্র অ্যান্টনির দিকেই শুধু ছবির মূল ফোকাস নয়। রোহিত ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি দুটো আলাদা চরিত্র অথচ দুজনের ন্যারেটিভ মূলত একই। ওই যুগের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এবং এই যুগের রোহিত অভিন্ন দুই সত্ত্বা। কাহিনী এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে উঠে আসে কবিগান, খেউর, লালনগীতি, সতীদাহপ্রথার সচিত্র বর্ণনা। আমাদের অপরিচিত হেন্সম্যান অ্যান্টনির বর্ণনা দিয়ে যায় আমাদের পরিচিত কুশল হাজরা। অ্যান্টনির পুরো জীবনের গল্প সে গড়গড় করে বলে যায়, অ্যান্টনির আনন্দ-বেদনা, সুখ–দুঃখের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কুশলের খুব চেনা, খুব পরিচিত। সৃজিত কুশলা হাজরার সাহায্য নিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সেকালের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিকে। দুই সময়ের দুই কাহিনীকে দুই জন্মের মাধ্যমে মানানসই মিশ্রণে ব্যক্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথিতযশা সৃজিত তা সঙ্গতিপূর্ণভাবেই করে দেখিয়েছেন। সেলুলয়েডের পর্দায় উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার আবহ-চিত্র সৃষ্টিতে তার পরিচালনা ছিল অনিন্দ্য সুন্দর ও মনকাড়া।
অভিনয়ের দিক দিয়ে সকলেই উতরে গেছেন ঠিকঠাকমতো। কারণ, কুশীলব নির্বাচনে সৃজিত সাধারণত ভুল পদক্ষেপ নেন না। ‘জাতিস্মর’ মুভি সেই ধারণাকে আরও একবার প্রতীয়মান করে তোলে। অভিনয়ের কথা আলোচনায় আসলে প্রথমেই আসবে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি ওরফে বুম্বাদার কথা। সৃজিতের মতে, জাতিস্মরের বুম্বাদা তুলনাহীন! তিনি নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা পারফরম্যান্সই নাকি ওই সিনেমায় করেছেন। সাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছেন সিনেমার আরেক মাথা কবির সুমনও। সৃজিত যে অতিরিক্ত কিছু বাড়িয়ে বলেননি, এর সাক্ষী দর্শকরা নিজেই। প্রসেনজিৎ ওই জন্মের সাহেবি পোশাকে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আর এই জন্মের সাদামাটা পরিচ্ছদের কুশল হাজরা- দুই চরিত্রেই এমন সাবলীল ও প্রাঞ্জল অভিনয় উপহার দিয়েছেন, যাতে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। শক্তিশালী অভিনয়শৈলীতে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন তিনি, যেন দু’শত বছর আগের অ্যান্টনি নিজে এসে ধরা দিয়েছেন রূপালী পর্দায়।
দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে আটকে যাওয়া, নিজের পুনর্জন্মের কাহিনীর কুড়ে কুড়ে খাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণায় প্রতিচ্ছবি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা, বা ভোলা ময়রার সাথে কবিগানের লড়াই চালিয়ে যাওয়া- এ যেন বুম্বাদার এক অনন্য রূপ। কাঁধ-এলানো চুল, সাধক অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সংস্কৃত আয়ত্তে মগ্ন। পার হচ্ছেন বাংলার মাঠ-ঘাট-বন্দর-নদী। শোভাবাজারের দেবেদের ঠাকুরদালান পুড়িয়ে দিচ্ছে দাপুটে সবুজ-মেরুন বেনারসি। তার দেমাকি উপস্থিতিও শান্তভাবে গুঁড়িয়ে দিল অ্যান্টনি। অ্যান্টনির গলায় ভোলা ময়রা পরিয়ে দিল জয়ের মালা। বাংলার মেঠো বুকে বুম্বাদা প্রস্ফুটন ঘটালেন একটুকরো সোনালি ভেলভেটের।
স্বস্তিকা মুখার্জির অভিনয় নিয়েও নতুন করে কিছু বলার নেই। অবহেলা এবং মিষ্টতা- দুটোই তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন কাহিনীর প্রয়োজনে। রোহিতকে ফিরিয়ে দেওয়ার যুক্তিযুক্ত কারণ উপস্থাপনের সময় স্বস্তিকাকে মহামায়ার চরিত্রকে একজন আপাদমস্তক অভিনেত্রী হিসেবেই দেখা যায়। এ জন্মের মহামায়া এবং গত জন্মের সৌদামিনী- মোট দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
তবে অভিনয়ের খাতিরে যাকে সবচেয়ে বেশি অনুশীলন ও চর্চা চালিয়ে যেতে হয়েছে, তিনি যীশু সেনগুপ্ত। ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। তার অভিনয়ের পুরোটাই ছিল গোছানো। গুজরাটি, ইংরেজি, হিন্দি, ও বাংলা- তাকে সর্বমোট চারটি ভাষায় কথা বলতে হয়েছে চলচ্চিত্রে। পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারার কী যে আক্ষেপ, তা যীশু নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধো আধো বাংলা বলা বা সকল কথার শেষে ‘আছে’ লাগানোতে মোটেও বেমানান লাগেনি তাকে। বরং দর্শকরা গভীরভাবে অনুভব করেছে- তিনি সত্যি সত্যি একজন গুজরাটি, যিনি ভালো বাংলা বলতে পারেন না। এমনভাবে তিনি এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, যেন রোহিত মেহতা চরিত্র মূলত তার জন্যই। এছাড়াও অনেক ডায়লগে তিনি “না মানে”, “ইয়ে”, “আসলে” এরকম ভঙ্গির মাধ্যমে দৃশ্যতে যোগ করেছেন অধিক বিভ্রান্তি। তবে যীশুর সবচেয়ে নজরকাড়া দিক ছিল, প্রতিমুহূর্তে তার নিজস্ব অভিব্যক্তি। দৃশ্যের প্রয়োজনে সেটা পাল্টেছেনও। যেমন, প্রথম জাতিস্মরের কাহিনী শোনার পর একরকম অভিব্যক্তি, মহামায়ার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একরকম অভিব্যক্তি, স্টেজে গান পরিবেশনের সময় একরকম অভিব্যক্তি, প্রতিটিই দর্শককে গল্পের সাথে একাগ্রতার বন্ধনে বাধতে সাহায্য করেছে।
ছোট চরিত্রে রিয়া সেন (সুদেষ্ণা), মমতা সরকার (মহামায়ার মা), রাহুল ব্যানার্জি (অমিতাভ) বেশ চমৎকার। বোধি চরিত্রে অল্প সময় স্ক্রিনে থেকে ভালো অভিনয় করেছেন আবির চ্যাটার্জি। সৃজিত নিজেও বিক্রম চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। ভোলা ময়রা চরিত্রে খরাজ মুখার্জী, যোগেশ্বরী চরিত্রে অনন্যা চ্যাটার্জি, ঠাকুর সিংহের ভূমিকায় বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, রাম বসুর চরিত্রে সুজন মুখার্জি- প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে ছিলেন যথাযথ ও মানানসই।
গানগুলো এই ফিল্মের প্রাণ। বলতে গেলে পুরো ‘জাতিস্মর’ সিনেমা জন্মের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে কবির সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানটি। একটি গানকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে ইতিহাস-খচিত পুরাদস্তুর এক বাংলা ছায়াছবি। ইন্দ্রদ্বীপ দাসকে সাথে নিয়ে সুরঘর সামলেছেন কবির সুমন নিজে। তবে খেটেছেন সৃজিতও। চিত্রনাট্যের ফাঁকে ফাঁকে দেয়া কবিগানগুলো বাছাইয়ের কাজ করেছেন তিনিই। ইতিহাসে বেঁচে থাকা অসংখ্য গানের মধ্য থেকে যুতসই তেরটা গান বেছে নেওয়া ছিল সাগর থেকে মুক্তো সেঁচে আনার মতো দুষ্কর। এই দুঃসাহস সৃজিতের সুরুচির পরিচয় দেয়।
কবিগানগুলো মূলত বইয়ের সাদা পাতায় কবিতা আকারে লিখা ছিল। এতে না ছিল কোনো সুর, না ছিল কোনো ভাব-ভঙ্গিমা। আবার এখানে কিছুটা বেঁকে গিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। কবিগানের খেউর অংশে দর্শকদের অনুপযোগী অনেক অশ্লীল বাক্য থাকায় সেগুলো দিতে রাজি হননি তারা। শুধু বেছে বেছে ভদ্র ভাষার লাইনগুলোই তুলে দিয়েছেন। সিনেমায় অ্যান্টনির লিখা মোট সাতটি গান স্থান দেওয়া হয়েছে। সিনেমায় প্রতিটি গান সেট করা হয়েছে এই জন্মের রোহিতের ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করে। কবির সুমন গানগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। খুঁড়ে এনে প্রতিটি গান সমান্তরালে জোড়া দিয়েছেন। কবিতাগুলোতে ছিল না কোনো সুর। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ওই সময়ের ঠিক কী মেজাজে গান গেয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী করতে হয়েছে গবেষণা। গানের সুরগুলোও বোনা হয়েছে সেই গবেষণার ছন্দ অনুসরণ করেই। যেমন, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির একটা গান ছিল এরকম,
“যে শক্তি হইতে উৎপত্তি, সে শক্তি পত্নী;
কী কারণ…কহো দেখি ভোলানাথ, এর বিশেষ বিবরণ!”
এখানে ভোলানাথ দিয়ে শিবকে নয়, বোঝানো হয়েছে ঐ সময়ের বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রাকে। এখানে অ্যান্টনির মেজাজটা ঠিক কী রকম ছিল? এই ছন্দে কী রাগ খাটবে? এসব জিনিসই সূক্ষ্ম সূক্ষ্মভাবে বসাতে হয়েছে কবির সুমনকে। তিনি এই গানের আবহ অনুযায়ী কাওয়ালী ও বাউল গানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন।
একদিকে গানের লিরিক বর্তমান সময়কে নির্দেশ করছে, আবার খরস্রোতা নদীর মতো পুরাতন সময়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ের একেক শিল্পীর গান (অনুপম, রূপম, সিধু) একেকটা সাব প্লট নিয়ে হাজির হচ্ছে, যা আবার ওই সময়ের হরু ঠাকুর, রাম বসু, ভোলা ময়রাদের সাথে সম্পৃক্ত। জাতিস্মর একটা প্রেমের গল্প, এবং এই প্রেমের উৎপত্তি জাতিস্মর গান থেকে। জন্মান্তরের ভালোবাসার যে প্রত্যয়, সেখান থেকে মূল গল্পের জন্ম। সেখান থেকে অ্যান্টনি ঢুকছে আলাদা আলাদা চ্যাপ্টার বা সাব টেক্সট হয়ে, যেগুলো একেকটা বাংলা গানের বিবর্তনের চ্যাপ্টারকেই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে পরিচালক ও সঙ্গীত নির্মাতার কোলাবোরেশান ছিল দুর্দান্ত গোছের।
ছবিতে ছোট-বড় মিলিয়ে সর্বমোট ২২টি গান রয়েছে। নির্মাণশৈলীতে একটি গান যেন আরেকটা গানকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে শেষভাগের চমক ছিল ‘এ তুমি কেমন তুমি’ গানটি, যা দুই জন্মের কাহিনীর মাঝে অনুপম মিশ্রণ ঘটিয়েছে। এছাড়াও গানটি ওই সময় চার্টবাস্টার লিস্টে জায়গা করে নিয়েছিল, বর্তমানে যা কাল্ট-ক্লাসিকে পরিণত হয়েছে। এর মিউজিক অ্যালবাম সমালোচক ও বাণিজ্যিক, দু’দিকেই ছিল সফল।
তবে ‘জাতিস্মর’ গানটি কবির সুমনের নিজের অ্যালবাম ‘জাতিস্মর (১৯৯৭)’ থেকে নেয়া হয়েছে। ‘সৃজিত-সুমন’ জুটি ছাড়া এমন কবিতার লাইনকে বিশুদ্ধ তার সপ্তকে বাঁধতে পারতেন আর কে? কীর্তন থেকে তরজা, আখড়াই থেকে কবিগান, আধুনিক বাংলা থেকে বাংলা রক, বেহালা থেকে চেলো- রূপালী পর্দায় যেন এক চূড়ান্ত সুরের কার্নিভাল।
সৃজিত মুখার্জি নিজ হাতেই গেঁথেছেন গল্পমালা। চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদারকে সাথে নিয়ে সেটা একটু একটু করে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন সেলুলয়েড ফিতায়। পুরো সিনেমায় একটা প্রাচীন বাংলার আবহাওয়া বজায় ছিল, যা ওই সিনেমার মূল উপজীব্য। ছবিতে ড্রোনের শট সৃজিতের অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আবার কিছু কিছু ক্লোজ শট এবং লং শট এত দুর্দান্ত ছিল যে, যা ছবিতে একটা আলাদা ‘পুনর্জন্ম’ আইডিয়ার সাথে মিশে এক হরর থিমের স্বাদ দিয়েছিল। আর এই উপজীব্যের কাঁধে ভর দিয়েই এগিয়ে গেছে সৌমিক হালদারের বোনা চিত্রনাট্য। কখনো কুশল হাজরা ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষের গা ছমছমে আবহমণ্ডল, কখনো বা পুরনো পশ্চিম বঙ্গের হালচাল- সবকিছুতে যেন নিখুঁত শৈলী ও মননশীলতার স্পষ্ট ছাপ। পুনর্জন্মের আইডিয়াকে পুঁজি করে আলো-আঁধারির দুরূহ লুকোচুরি খেলা দর্শক মনোযোগ হরণ করতে বাধ্য। রূপালি পর্দায় ক্যামেরার পেছনে থেকে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন আঠারো ও উনিশ শতকের বাংলাকে, যেখানে পুরাতনের সাথে তাল মিলিয়ে নতুনত্ব ছুটে যায় সমান্তরালভাবে।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্টের প্রযোজনায় ভারতে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। দর্শক-সমালোচক উভয় মহলে তা ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়। তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির জন্য চলচ্চিত্রটির স্পেশাল স্ক্রিনিং হয় নয়া দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে। ‘টাইমস অভ ইন্ডিয়া‘র মতো জনপ্রিয় পত্রিকা সিনেমাটির রেটিং দিয়েছে ৪/৫। প্রায় আড়াই হাজারেরও অধিক ভোট নিয়ে এর IMDB রেটিং বর্তমানে ৮/১০, এবং রোটেন টম্যাটোজ-এ সিনেমাটি ৭৯% ফ্রেশ।
ছায়াছবির পুরষ্কারের ঝোলাও বেশ ভারী। ‘৬১ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার’- এ সিনেমাটি মোট চারটি ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার বাগিয়ে নিয়েছিল। শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কবির সুমন, শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে (এ তুমি কেমন তুমি) রূপঙ্কর বাগচী, শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জায় সাবর্নী দাস, শ্রেষ্ঠ পোশাক পরিকল্পনায় বিক্রম গায়কোয়াড়- এই ক্যাটাগরিগুলোতে চলচ্চিত্রটি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে।
জাতিস্মরে হেন্সম্যান অ্যান্টনি আওড়ে যান এক বিচিত্র জীবনের উপাখ্যান, যে উপাখ্যানে জড়িয়ে আছে জ্বলন্ত চিতা থেকে বেঁচে যাওয়া সৌদামিনীর গল্প, ক্রমে ক্রমে এক ভিনদেশির বাংলা সংস্কৃতির উপর নিখাদ ভালোবাসা উৎপত্তির গল্প, বাংলা কবিগানের একজন অনন্য অসাধারণ দিকপাল হয়ে ওঠার গল্প, বাংলা সংস্কৃতিতে মিশে যাবার গল্প। পরের জন্মে এই গল্প কখন যে রোহিতের ভালোবাসার গল্পের সাথে মিলে যায়, তা থেকে যায় সকলের অগোচরেই। কিন্তু বিচিত্র শোভায় মণ্ডিত এই গল্প অ্যান্টনির অবতার কুশল হাজরাকে দাঁড় করিয়ে দেয় কল্পনাতীত এক সত্যের সামনে। জন্ম-জন্মান্তরেও এ সত্যের পীড়া শাশ্বত বিরহে পুড়িয়ে যায় হৃদয়ের চারপাশ।
‘জাতিস্মর’ দর্শকমনে দাগ কেটে থাকবে নিজ মহিমায়, নিজ শিল্পগুণে। অসম্ভব চমৎকার কিছু গানের পাশাপাশি এ যেন অনন্তবিস্তারী বিরহগাঁথার পূর্ণ প্রতিফলন। যে বিরহ মুদ্রার একপিঠে ছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার অদ্ভুত সুন্দর এক পরিণয়। আর অপরপিঠে বিস্তৃত ছিল জন্ম-জন্মান্তরের নিশ্চুপ আর্তনাদের অসীম আক্ষেপ। ভালোবাসা অনুভূতিটাই এমন। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার যে আক্ষেপ- তা জন্মজন্মান্তরেও ফুরোবার নয়। সেজন্যই ওই জন্মের অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ভালোবাসা প্রাপ্তির জন্য এই জন্মে ফিরে আসেন কুশল হাজরা হয়ে।