কে যেন একবার লিখেছিল, যুক্তির অসাধ্য যা, তা-ই নরক। এ জায়গাটা সাক্ষাৎ নরক। বুঝলে দাদীমা, এখানে এসেছি মাত্র এক সপ্তাহ হলো, তাতেই জায়গাটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। আমার মনে হয়, এখন পর্যন্ত আমার করা সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো পেট্রোলের সামনের দিকে থাকা, সবার আগে। এ সপ্তাহে তিনবার পয়েন্টম্যান হতে হয়েছে আমাকে। আমি জানিই না আমি আসলে কী করছি। আমার সামনে তিন ফুট লম্বা একটা ভিয়েতনামী সেনা দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি টের পাব না। আমার সারা শরীরে তীব্র ক্লান্তি জেঁকে বসেছে। ভোর পাঁচটায় আমাদের উঠে পড়তে হয়। তারপর সারাদিন বোঁচকা-বুচকি নিয়ে হাঁটা। বিকেল চারটা কী পাঁচটার দিকে ক্যাম্প করি, পরিখা খুঁড়ি, খাই।… আমি এখানে নতুন বলে আমাকে কেউ কিছু শেখায় না। নতুনদের নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই, তারা আমাদের নামটাও জানতে চায় না। …
ক্রিস টেইলর। ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে এসেছে নিজের ইচ্ছেতেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আমেরিকায় নিজের দাদীর কাছে চিঠিতে এমন কথাগুলোই লিখেছে সে। অলিভার স্টোনের প্লাটুন সিনেমাটিতে টেইলরের বর্ণনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে ভিয়েতনামের যুদ্ধের করুণ পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি শুধু ভিয়েতনামী কৃষকদের জন্যই করুণ নয়, বরং খোদ মার্কিন সেনাদের জন্যও যথেষ্ট পীড়াদায়ক। ১৯৮৬ সালে বানানো এই অ্যান্টি-ওয়ার সিনেমায় যুদ্ধকে মহৎ করে দেখানো হয়নি, মার্কিন সৈন্যদের বীরবেশে উপস্থাপন করা হয়নি, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে মার্কিন ফ্যান্টাসির যোগসাজশে কোনো প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়নি। প্লাটুন-এ বরং দেখানো হয়েছে যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সেনাদের মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং একইসাথে মার্কিন বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, যুদ্ধকালীন নৈতিকতার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি ইত্যাদি।
১৯৬৭ সালে ২৫ পদাতিক ডিভিশনের একটি প্লাটুনের সাথে দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সীমান্তে পৌঁছায় তরুণ ক্রিস টেইলর। এই দলটির অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট উলফ, সাথে আছেন আরও দুজন– সার্জেন্ট বার্নস ও সার্জেন্ট এলিয়্যাস। ভিয়েতনামের জঙ্গলে টহল দিয়ে বেড়ায় তারা। মোকাবেলা করতে হয় গেরিলাদের অ্যামবুশ ও বুবি ট্র্যাপ। এরকম একটি টহলের সময় বুবি ট্র্যাপের মুখে পড়ে কয়েকজন মার্কিন সৈন্য মারা যায়। এই ঘটনার জেরে একটি গ্রাম আক্রমণ করে বসে মার্কিন ট্রুপাররা। সেই গ্রামে অনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালায় সার্জেন্ট বার্নস। তার প্রতিবাদ করে সার্জেন্ট এলিয়্যাস। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় পুরো প্লাটুন। শুরু হয় বিবেক ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব। একদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে নীতিস্খলনের কারণে বিবেকের দংশন, অন্যদিকে যেকোনো উপায়ে ভিয়েতনামী গেরিলাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা– এই দুয়ের মধ্যে নিজেকে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করে টেইলর।
ভিয়েতনামে আক্রমণ চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মতাদর্শকে সাধু প্রমাণের চেষ্টায় আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো দলিল নয় প্লাটুন। এটি বরং এই রাজনীতির বলির পাঁঠা হওয়া মার্কিন তরুণ আর ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষদের শোকগাথা। নির্মাতা অলিভার স্টোন নিজে ছিলেন একজন ভিয়েতনামফেরত যোদ্ধা। ভিয়েতনামে বাস্তবে কী ঘটেছিল, তা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তার সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সিনেমাটি বানিয়েছেন তিনি। ফলে সিনেমায় প্রকাশ পেয়েছে ভিয়েতনামের আসল হাহাকার- যুদ্ধের প্রতি মার্কিনীদের অনীহা, নিজেদের রাজনীতির ঘুঁটি বলে মেনে নেয়া অনন্যোপায় সৈনিকদের সরল স্বীকারোক্তি, রুলস অভ অ্যাঙ্গেজমেন্ট না মেনে চলা মার্কিন তরুণদের ভিয়েতনামী গ্রামবাসীদের প্রতি নৃশংসতা, মার্কিন বাহিনীর নিজেদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।
ক্রিস টেইলর এমন একজন তরুণ, যে নিজের ইচ্ছাতেই এই নরককুণ্ডে পা বাড়িয়েছে। কারণ যুদ্ধটাকেও তার কাছে বৈষম্যপূর্ণ মনে হয়েছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রথমদিকে অন্ধকারেই ছিল মার্কিনীরা। তারা ভেবেছিল, এই যুদ্ধ একটি যথাযথ যুদ্ধ (Just war), কারণ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে এমনটাই বুঝিয়েছিল। অনেক তরুণ নিজেদের শিক্ষাজীবন, পরিবার, দেশের মায়া ত্যাগ করে এই যুদ্ধে পা বাড়িয়েছিল স্রেফ একটি বিভ্রান্তিকর আদর্শের ওপর ভর করে। ক্রিস টেইলরও তাদের একজন।
-কিং: টেইলর ভায়া, তুমি কী করে এই নরকে এসে জুটলে? তোমাকে দেখে তো পড়ালেখা জানা বলে মনে হয়।
–টেইলর: আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, ভলান্টিয়ার হিসেবে।
-কিং: (অবাক কণ্ঠে) কী হিসেবে?
–টেইলর: ভলান্টিয়ার হিসেবে। আমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি ওদেরকে বলেছি, আমি সৈনিক হতে চাই, যুদ্ধ করতে ভিয়েতনাম যেতে চাই।
-ক্রফোর্ড: (অবাক কণ্ঠে) তুমি যেচে পড়ে এখানে এসেছ!
–টেইলর: বিশ্বাস হয়?
-কিং: কলেজ ছাড়ার মতো বোকামি করতে গেলে কেন?
–টেইলর: তাতে আর কী যায় আসে! এমন তো নয় যে কলেজে থাকতেও আমি পড়ে ফাটিয়ে দিচ্ছিলাম। আসলে আমার মনে হচ্ছিল, কেন সবসময় শুধু গরীব ছেলেরা যুদ্ধ করতে যাবে আর ধনীর দুলালরা নির্ঝঞ্ঝাটে থাকবে!
-কিং: বাহ! তুমি তো একজন ক্রুসেডার (ধর্মযোদ্ধা), ভাই।
টেইলরের এই স্বীকারোক্তি শুধু তার নিজস্ব নয় বরং সে সময়কার অসংখ্য তরুণেরও বটে। মার্কিন তরুণরা তাদের দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে ভিয়েতনামে এসেছিল যুদ্ধ করতে। কিন্তু এখানে এসে তাদের ভুল ভাঙে। কারণ, ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে সবক্ষেত্রে মার্কিন আদর্শ সঠিক নয়। তার ওপর ভিয়েতনামের পরিবেশের সাথে তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। টেইলরকে আমরা দেখি জঙ্গলে চলতে চলতে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতে। কিন্তু তখন তো আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সবকিছু মেনে নিতে হয় তাকে। ক্রমশ টেইলরও হয়ে ওঠে একজন পোড় খাওয়া সৈনিক।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ অনিবার্য পরিবর্তন শুধু শারীরিক নয়, বরং মানসিকও। প্লাটুন সিনেমার অন্যতম নির্যাস হলো মার্কিন বাহিনীর ভেতরকার দ্বন্দ্ব। ভিয়েতনামে মার্কিনীরা শুধু যে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তা নয়, কিছু ক্ষেত্রে তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে অনেক সৈনিকরাই তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গুপ্তহত্যা করেছিল। প্লাটুন সিনেমায় এই অন্তর্দ্বন্দ্ব যুদ্ধ সম্পর্কে দর্শকের সামনে বেশকিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছে। নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করার কারণে দুই সার্জেন্টের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তা একসময় ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্লাটুনের ভেতর।
যুদ্ধের সময় কোন কাজটি সঠিক আর কোনটি ভুল, তার বিচার করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সেজন্য সার্জেন্ট বার্নসের সন্দেহবশত গ্রাম্য বৃদ্ধাকে খুন করা আদৌ ঠিক না ভুল, তা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নীতি ও মানবতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসে। তার রেশ ধরে বেঘোরে মারা পড়তে হয় সার্জেন্ট এলিয়্যাসকে। এলিয়্যাসের মৃত্যুর জন্য বার্নসকে দায়ী করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না টেইলর। একসময় যে টেইলর বৈষম্যের প্রতিবাদে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দেয়, বর্তমানে সেই টেইলরই বার্নসের এই অপকর্মের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। কারণ, বার্নস যা করেছে, তা নিজেদের স্বার্থেই, ভিয়েতকংদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর নিরন্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।
সুতরাং এখানে তৈরি হয় দুটো মতাদর্শ। এক দল ভাবে, যুদ্ধে সবই ঠিক, এখানে স্বাভাবিক সময়ের ন্যায়-অন্যায় দেখার অবকাশ নেই। আরেক দল তখনো তাদের নৈতিক আদর্শে স্থির থাকে। গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পর কয়েকজন মার্কিন সৈনিক কিছু ভিয়েতনামী বালিকাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে টেইলর বাঁধা দেয়। তাদের মধ্যকার কথোপকথন নিম্নরূপ:
-টেইলর: (চেঁচিয়ে) হারামজাদার দল, বেরো এখান থেকে। ওঠ। এরকম করিস না, এরকম করিস না। এসব কী, হ্যাঁ?
–সৈন্য ০১: তুই কি সমকামী নাকি রে, টেইলর?
—সৈন্য ০২: তোর সমস্যা কী টেইলর? এটা একটা ভিয়েতনামী মেয়ে (Dink)।
-টেইলর: মেয়েটা একটা মানুষ।
পার্থক্যটা এখানেই। একদল ভিয়েতনামীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করছে না। আর আরেক দল শত্রু হলেও তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করছে না।
বার্নসের বিশ্বাস আর এলিয়্যাসের বিশ্বাসে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বার্নসের কাছে তার সৈনিক সত্ত্বাই সবার আগে। সেখানে দয়ামায়ার বালাই নেই। বার্নস তার কাজে বিশ্বাস করে। আর এই বিশ্বাসটাই একজন সৈনিকের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। কারণ একজন সৈনিক যদি তার অফিসারদের কথা না শোনে, তাহলে ওই সেনাবাহিনী একটি ব্যর্থ সেনাবাহিনীতে পরিণত হবে। অনেক ক্ষেত্রেই একজন সৈনিককে তার দেশ, দল বা এমনকি নিজের স্বার্থেই এমন সব কাজ করতে হয়, যা স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ অনৈতিক।
যদি সৈনিকরা যুদ্ধের ময়দানে দয়ামায়া প্রদর্শন করতো, তাহলে পৃথিবীতে বিভিন্ন যুদ্ধে এত এত নিরীহ মানুষ মারা যেত না। যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু যুদ্ধের সময় সব নিয়ম মেনে চলা যায় না কারণ, “যুদ্ধ ও প্রেমে সবই ন্যায্য” বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বার্নসের কাছে এটাই যুদ্ধ, এটাই তার আদর্শ। আর যাই হোক দয়ামায়ার শরীর নিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না, শত্রুকে পরাস্ত করা যায় না। সুতরাং বার্নসকে দোষারোপ করার আগে আমাদের দু’বার ভাবতে হবে।
বার্নস আর এলিয়্যাসের এই মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের আবর্তনের চক্করে পড়ে দিশাহারা বোধ করে টেইলর। ভিয়েতনামে যা ঘটেছে, তা মন থেকে দূর করে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। একধরনের মানসিক ট্রমায় ভুগতে থাকে টেইলরসহ বাকিরা। তারা না পারে ভুলে থাকতে, না পারে নিজেদের কৃতকর্মকে বৈধতা দিতে। টেইলর বুঝতে পারে, ভিয়েতনামের এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুস্থদেহে বেঁচে ফিরলেও তার বিবেকের সাথে যে দ্বন্দ্ব, তা কখনো শেষ হবে না। আমৃত্যু তাকে তাড়া করে বেড়াবে ভিয়েতনামের অন্তর্দ্বান্দ্বিক দিনগুলো।
এই যুদ্ধটা হয়তো আমার জন্য এখন শেষ হলো, কিন্তু বাকি জীবনটা আমাকে এর সাথেই যুঝতে হবে।
চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট প্লাটুন-কে ওই বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে স্বীকার করেছেন। স্টোনের সিনেমাটির সাফল্যের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, স্টোন ওয়ার-ফিল্মের গতানুগতিক কোরিওগ্রাফির ধার ধারেননি। তিনি কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি। একজন ভিয়েতনাম ভেটেরান হওয়ার পরও স্টোন তার সিনেমায় মার্কিনীদের পক্ষে কোনো বার্তা দেননি। ভিয়েতনামের রণক্ষেত্রে স্টোন যা যা দেখেছিলেন, তার বয়ান প্লাটুন। সেদিক থেকে দেখলে প্লাটুন সিনেমাটা পুরোপুরি স্টোনের দৃষ্টিভঙ্গি, ওই যুদ্ধ সম্পর্কে তার পরোক্ষ মতামত। আর এই মতামত প্রদশর্নের সময় স্টোন অন্ধ দেশপ্রেমের ঠুলি আঁটেননি চোখে, হলিউডের সনাতনী প্রোপাগান্ডাকে প্রশ্রয় দেননি- এটাই প্লাটুন সিনেমার মূল শক্তি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি: