গত বছরের মে মাসে মুক্তি পেয়ে গেলো মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ১৩তম সিনেমা ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার। চলচ্চিত্র অনুরাগী সবারই ইতোমধ্যে জানার কথা যে, ২০০৮ সাল থেকে মারভেল নিজেদের কমিক বইয়ের গল্প দিয়ে শুরু করেছে নতুন মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স। তবে সিনেমাগুলোকে কমিকস বই থেকে কিছুটা ভিন্নধর্মী করার খাতিরে কাহিনীগুলোতে আনা হয়েছে নিজস্ব কিছু পরিবর্তন এবং এই সিভিল ওয়ার সিনেমাটি পুরোপুরি কমিক বইয়ের সিভিল ওয়ারের মতো নয়। আমাদের আজকের আলোচনা মারভেলের এই সিভিল ওয়ার নিয়েই।
নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, সোকোভিয়া এবং লাগোসে সংঘটিত কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ অ্যাভেঞ্জারস সদস্যদের নিয়ে আসতে চায় ‘সোকোভিয়া অ্যাকর্ডস’ নামের একটি চুক্তিপত্রের আওতায়।
সোজা কথায় সামরিক বা অন্যান্য আইন রক্ষীবাহিনীর মতো অ্যাভেঞ্জারসদেরও জাতিসংঘের এই নিয়ম কানুনের অধীনে থাকতে হবে। দ্বন্দ্বটা শুরু হয় এখানেই। আয়রন ম্যান/টনি স্টার্ক চুক্তির পক্ষে থাকলেও ক্যাপ্টেন আমেরিকা/স্টিভ রজার্স তাতে সই করতে অসম্মতি জানায়। এতে করে অ্যাভেঞ্জার্সরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল টনির পক্ষে আরেক দল ক্যাপ্টেন রজার্সের। এই দু’দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়েই মারভেল সাজিয়েছে তাদের সিভিল ওয়ার। তবে আপাতদৃষ্টিতে যতটুকু সাধারণ মনে হচ্ছে, আসলে ছবির কাহিনী এতটা সাধারণ ছিলো না। দু’দলরেই পক্ষে/বিপক্ষে রয়েছে ভিন্ন রকমের দুই উদ্দেশ্য।
ক্যাপ্টেন আমেরিকা: উইন্টার সোলজারের পর আবার আমাদেরকে আরেকটি চমৎকার ছবি উপহার দিলেন রুশো ব্রাদার্স, তাদের পরিচালনার প্রশংসা করতেই হবে। বরাবরের মতো আয়রন ম্যান চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র এবং ক্যাপ্টেন আমেরিকা হিসেবে ক্রিস ইভানস অনবদ্য অভিনয় করেছেন। স্পাইডার-ম্যান চরিত্রে টম হল্যান্ডের অভিনয় ছিল দারুণ। আমাদের দেখা অন্য দুই স্পাইডার-ম্যান থেকে ভিন্ন তিনি। হল্যান্ড যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিলেন, দুর্দান্তভাবে অভিনয় করে গেছেন। তার পাশাপাশি ব্ল্যাক প্যান্থার/টি’চালা চরিত্রে চ্যাডউইক বসম্যানের অভিনয় সত্যি প্রশংসনীয়। রীতিমত সংশয়ে ছিলেন সমালোচকেরা, ব্ল্যাক প্যান্থার হিসেবে তিনি কতোটুকু ভালো অভিনয় করবেন; তার অভিনয় দেখে সে সংশয় দূর হয়ে গেছে। বাকি চরিত্রগুলোর সব অভিনেতা অভিনেত্রীরাও বরাবরের মতো নিজ নিজ চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন।
একদিক থেকে বলা যায়, ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার এখন পর্যন্ত এই দশকের সেরা সুপারহিরো চলচ্চিত্র। তবে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সেই ব্যাপারে। তাদের ধারণা, সিনেমাটি পরিপূর্ণ ছিল না এবং প্রশ্ন তুলছেন দু’দলের মোটিভ নিয়ে। আমরা এখন সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করবো।
সামনে সামান্য স্পয়লার আছে!
ছবির প্রথমাংশে দেখা যায়, ‘হিউম্যান রিসোর্সে’র একজন নারী নিজের ছেলের মৃত্যুর জন্যে দায়ী করছে টনিকে (অ্যাভেঞ্জারস: এজ অব আলট্রন সিনেমায় সোকোভিয়ার ব্যাটলে প্রাণ হারায় তার ছেলে)। সেই দৃশ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ দেখা যায় টনির চেহারায়। তাছাড়া তার ভেতরে যে একধরনের অপরাধবোধ তৈরি হচ্ছে, সেটা পূর্বের দুই ছবিতেও (আয়রন ম্যান ৩ এবং অ্যাভেঞ্জারস: এজ অব আলট্রন) দেখানো হয়েছিল। সে মনে করতে শুরু করে, অ্যাভেঞ্জারসরা হয়তো মাঝে মধ্যে নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং তাদের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন। সে কারণেই সে সোকোভিয়া চুক্তির পক্ষে, আর তার সহকর্মীরা যদি সেই আইনের আওতায় আসতে না চায়, তাহলে জাতিসংঘের কথায় সে তাদের গ্রেফতার করতেও রাজি।
তাছাড়া টনি এবং রজার্সের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও, টনি প্রথমদিকে রজার্সকে কখনও সেভাবে সমীহ করতো না। প্রথম অ্যাভেঞ্জারস ছবিতে ক্যাপকে লক্ষ্য করে টনিকে বিদ্রূপ করে বলতে দেখা যায়,
“এর কথাই তাহলে বাবা সারাক্ষণ বকবক করতেন? আমার তো দেখে মনে হচ্ছে, হিমায়িত অবস্থায়ই রেখে দিলেই ভালো হতো।”
আর রজার্স নিজেও টনিকে সেভাবে পছন্দ করেনি। সে মনে করে, টনি একজন চরম স্বার্থপর মানুষ, যে সবকিছুতে আগে নিজের ভালো দেখে। অ্যাভেঞ্জারসের দ্বিতীয় ছবিতে রজার্স ও টনির মধ্যে কথোপকথনের এক পর্যায় রজার্স টনিকে বলে,
“আমাকে পুরনো আমলের মানুষ ভাবতে পারো, কিন্তু কারও কোনো অন্ধকার দিক না থাকলে কেন যেন আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারি না।”
ঘটনা যত উদঘাটিত হচ্ছিল, ততই টনি মনে করতে শুরু করে, তাহলে এই হচ্ছে ক্যাপের অন্ধকার দিক? তার পুরনো বন্ধুর জন্য তার দুর্বলতা, যার বিষয় আসলে সে সঠিক চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া জিমোর পরিকল্পনার ব্যপারে স্টার্ক কিছুই জানতো না। তাই যখন সে পার্কারকে নিজের দলে ভেড়াতে যায়, তখন ক্যাপ্টেনের সম্পর্কে সে পার্কারকে বলে,
“সে (রজার্স) ভুল করছে, কিন্তু সেটা সে জানে না এবং এজন্য সে বিপজ্জনক।”
অন্যদিকে, ক্যাপ্টেন আমেরিকার ভাষ্য হচ্ছে,
“আমাদের কাজ হচ্ছে মানুষের জীবন বাঁচানো। কিন্তু সবসময় সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।”
তাই সে মনে করে, জাতিসংঘের এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা মানে হচ্ছে নিজেদের অধিকার আত্মসমর্পণ করা। কারণ, হয়তো তাদেরকে এমন কোথাও যেতে বলা হবে, যেখানে তাদের যাওয়া উচিৎ নয় অথবা তাদের এমন কোথাও যাওয়া দরকার, যেখানে জাতিসংঘ তাদের যেতে দেবে না। তাদের সব কাজ হয়তো ত্রুটিহীন না, তবে সেই কাজে নিজেদের স্বাধীনভাবেই থাকাটাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। পরে ভিয়েনার জাতিসংঘ সম্মেলনে এক বোমা বিস্ফোরণ হলে তার জন্য মিথ্যেভাবে দায়ী করা বাকি বার্নসকে যখন গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া হয়, তখন ক্যাপ্টেন নিজেই যায় বাকিকে গ্রেফতার করতে। কারণ, সে মনে করে বাকিকে গ্রেফতারের জন্য সে-ই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।
সোকোভিয়া চুক্তি নিয়ে হয়তো তাদের বিতর্ক চলতে থাকতো, হয়তো তর্কের এক পর্যায়ে রজার্স অবসরের সিদ্ধান্ত নিতো কিংবা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হতো, কিন্তু বাকিকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার পর যখন ড. থিও ব্রোসার্ডের ছদ্মবেশে হেলমুট জিমো বাকির উইন্টার সোলজার রূপ সক্রিয় করে তাকে মুক্ত করে দেয়, বাকি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন বাকিকে সেখান থেকে গোপন এক জায়গায় নিয়ে যায় এবং সেখানে বাকি ক্যাপ্টেনকে বলে যে, সে ক্যাপকে চিনতে পারছে এবং তাকে জিমোর পরিকল্পনার কথা জনায়। সময়মত বাধা না দিলে, জিমো ভয়ংকর কিছু একটা ঘটিয়ে বসবে। ক্যাপ্টেন প্রথমে টনিকে ডাকার কথা ভাবলেও, চুক্তির চাপে টনি কতটুকু সাহায্য করতে পারবে এই ভেবে পরে সে আর টনিকে কিছু বলেনি। এরপর সে ফ্যালকনের সাহায্যে একটি টিম গঠন করে জিমোকে থামানোর জন্যে। অন্যদিকে আয়রন ম্যান দল প্রস্তুত করে ক্যাপ্টেন আমেরিকা আর তার সহকারীদের থামানোর জন্যে। ব্যাপার হচ্ছে দু’দলেরই কেউই জানতো না পরস্পরের উদ্দেশ্য। যার কারণে, তারা ভাগ হয়ে যায় দুই ভিন্ন দলে এবং লিপ্ত হয় এই গৃহযুদ্ধে।
টিম আয়রন ম্যান: আয়রন ম্যান, ওয়ার ম্যাশিন, ব্লাক উইডো, ভিশন, ব্লাক প্যান্থার এবং স্পাইডারম্যান।
টিম ক্যাপ: ক্যাপ্টেন আমেরিকা, উইন্টার সোলজার, ফ্যালকন, স্কারলেট উইচ এবং অ্যান্ট-ম্যান।
“শত্রুর থাবায় ভেস্তে যাওয়া সাম্রাজ্য নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে,
কিন্তু যে সাম্রাজ্য অন্তঃর্দ্বন্দ্বে ভঙ্গুর, সেটা অনেক আগেই পচে গেছে। আজীবন সেভাবেই থাকবে।”
সিনেমাটির IMDb রেটিং: ৭.৯/১০
রটেনটম্যাটোস: ৯০% ফ্রেশ।