ওসামা বিন লাদেন; দুনিয়াব্যাপী আলোচিত ও সমালোচিত এক নাম। এই নামের ব্যক্তিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। সেদিন নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে এবং ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে আচমকা আছড়ে পড়ে বিমান। এই বিমান হামলায় সুউচ্চ সেই ভবন মুহূর্তেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। টুইন টাওয়ারেই ২,৭৪৯ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৪০০ জনই পুলিশ ও অগ্নিনির্বাপণ কর্মী। কে বা কারা এই সন্ত্রাসী হামলা চালায়- সেই বিষয়ে আমেরিকা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। অভিযোগের তির যায় সৌদি আরবে জন্মগ্রহণকারী আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের দিকে। সেই ২০০১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজছিল। অবশেষে ২০১১ সালের ২০ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়িতে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রশিক্ষিত বাহিনী ও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আমেরিকা সেখানে হামলা পরিচালনা করে। আর পুরো ঘটনা হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে বসে দেখভাল করছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও হর্তাকর্তারা। কর্মকর্তারা অ্যাবোটাবাদের বাড়ির উপরে ড্রোনের ভেতর সেট করা ক্যামেরা থেকে ঘটনার লাইভ ভিডিও দেখছিলেন। মার্কিন কমান্ডোদের ‘অপারেশন জেরোনিমো’ নামের এই অভিযানে ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। অবশেষে শেষ হয় তৎকালীন বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তির পেছনে মার্কিন সেনাবাহিনীর ছুটোছুটি।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু নিয়ে সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের গণমাধ্যমে যে বয়ান তুলে ধরেছিল তা অনেকের কাছেই সন্দেহের উদ্রেক করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেভি সীলসের সবচেয়ে দক্ষ ক’জন সৈনিক ও ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার নিয়ে হামলা করে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, রাডার, প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে পৌঁছানো, শহর অন্ধকার করে গোপনে অপারেশন চালানো- এসবের পেছনে মানুষজন কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এই সন্দেহগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সিমর হার্শ একটি পুরো বই লিখে ফেললেন, নাম ‘দ্য কিলিং অব ওসামা বিন লাদেন‘। বইটিতে গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য তথ্যের পসরা সাজিয়ে তিনি নিজের মতো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন অ্যাবোটাবাদের ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছের যেভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, তার বেশিরভাগই ছিল ধোয়াশায় পূর্ণ। এমনকি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কেও যে মিথ্যাচার করেছে তারও কিছুটা তিনি খতিয়ান তুলে ধরেছেন।
সিমর হার্শের বইটি বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন সোহেলী তাহমিনা। বইটি ২০১৯ সালে প্রজন্ম পাবলিকেশনের ব্যানারে প্রকাশিত হয়। এর সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছেন ওয়াহিদ তুষার। মলাটে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের ছবি বইকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। মূল লেখক সিমর হার্শ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জগতে এক পরিচিত নাম। স্বীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পাঁচবার জর্জ পোল্ক পুরস্কার, দুবার ন্যাশনাল ম্যাগাজিনে অ্যাওয়ার্ড ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট, এলএ টাইমস বুশ পুরস্কার ও ন্যাশনাল বুশ ক্রিটিক সার্কেল পুরস্কার অর্জন করেন।
আমাদের এই পৃথিবীর অনেক মানুষের পশ্চিমা বিশ্বাস ও প্রচারের প্রতি অনাস্থা রয়েছে৷ এই অনাস্থার জায়গা আরো পাকাপোক্ত করবে এই বই। যেমন- আমরা সবাই জানি যে বিন লাদেনের মরদেহ মার্কিন কমান্ডোরা প্রথমে আফগানিস্তানে এবং পরবর্তীতে মার্কিন রণতরী কার্ল ভিনসনে নিয়ে যায়। তার পরিচয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। শেষে কার্ল ভিনসন রণতরীতে ইসলামী প্রথানুসারে মরদেহ আরব সাগরে সমাহিত করা হয়। কিন্তু লেখক বলছেন ভিন্ন কথা,
“স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের সাথে দীর্ঘ সময় পরামর্শদাতা হিসেবে কর্মরত এবং বর্তমান সময়কার গোপন তথ্যাবলি সম্পর্কে অবগত দুজন ব্যক্তি, বিন লাদেনের অভিযানের দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাকে জানায় যে কার্ল ভিনসনে কোনো সমাধি ক্রিয়া করা হয়নি”
পত্রপত্রিকা যা বলে, যা প্রকাশ করে, আমরা সাধারণত তা-ই সরল মনে বিশ্বাস করি। ছাপার অক্ষরে কোনো খবর পড়লে তা সত্য বলে ধরে নিই। অবশ্যই তাদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদে আমরা উপকৃত হই, কিন্তু বিশ্ব মিডিয়া কোনো প্রপাগান্ডা চালায় কিনা সেক্ষেত্রেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর রাতে যা ঘটেছে এই গ্রন্থে লেখক বলছেন তার সকল প্রমাণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি শুধুমাত্র সিরিয়ার সেনাবাহিনীর কাছেই সারিন গ্যাস রয়েছে- ওবামার প্রশাসন থেকে প্রচারিত এই তথ্যও ভুল ছিল। তাছাড়া, ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা করার আগে জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন- ইরাকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, কিন্তু এই গ্রন্থের লেখক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলছেন- ইরাকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। জর্জ ডব্লিউ বুশকে এই সন্ত্রাসবাদ দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় বসতে সহায়তা করে। ক্ষমতার পালাবদলে রাজনীতিবিদগণ সবসময় তাদের রাজনীতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। বিন লাদেনের মৃত্যুও বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রন্থটিতে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে: ভূমিকা, দ্য কিলিং অব ওসামা বিন লাদেন, দ্য রেড লাইন এন্ড দ্য রেট লাইন, সারিন কার, এবং মিলিটারি থেকে মিলিটারি।
বইয়ের বিন্যাসে সবকিছুকে ছাপিয়ে ওসামা বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে কাহিনির গাথুনিতে মন্থর ভাব চলে আসবে। এই বইয়ের প্রতিটি তথ্য-উপাত্তের কারণে একজন সাধারণ পাঠকের মনে আমেরিকার প্রচলিত তথ্যের উপর বিশ্বস্ততায় চিড় ধরবে। লেখক অনেক জায়গায়ই বলেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে এবং বিশ্বের কয়েকটি বড় ধরনের ঘটনার পেছনে নাকি এই ভুল তথ্যই দায়ী।
পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাড়িতে ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে ছিলেন, অথচ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে তার কোনো হদিস ছিল না! আ্যাবোটাবাদে লাদেনের ওই বাড়ির পাশেই ছিল পাকিস্তানের সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০১১ সালের ২ মে আমেরিকার সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে আক্রমণ শুরু করে, তখন প্রচার হতে থাকে যে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানায়নি। বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার দিয়ে মাটি থেকে কয়েক ফুট উপর দিয়ে পাকিস্তানি রাডার ফাঁকি দিয়ে অভিযান সম্পন্ন করেছে। কিন্তু লেখক এই গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন,
“আমি জানতে পেরেছিলাম যে বিন লাদেন ২০০৬ সাল থেকেই অ্যাবোটাবাদের আইএসআইয়ের একজন বন্দি হিসেবে আছে।”
স্বাভাবিকভাবেই এই তথ্যগুলো সবার মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে। দ্বন্দ্ব নিরসনে পাঠক কোনো এক পক্ষকে বেছে নেয় অথবা নিজেই সমাধানের পথ খুঁজতে থাকে। আলোচ্য গ্রন্থে বিশেষ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলের সমালোচনাই বেশি উঠে এসেছে। সর্বোপরি, গ্রন্থটি পাঠকদের একটি বার্তা দেয়, আর তা হলো- পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের কাছে অনেক কিছুই কূটনৈতিকতার আড়ালে নিপুণভাবে লুকিয়ে রাখে। অনেকের আস্থার এই জায়গা নড়বড়ে অবস্থায় রেখেই বইটি শেষ হয়।