খোলা জানালা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে ঘরের মাঝখানে। বাইরের আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে। কোথাও মেঘের রঙ কালো, কোথাও সাদা, কোথাও ঈষৎ লাল। এখন শেষ বিকেল। লাল সূর্যটা হারিয়ে গেছে উঁচু দালানের ওপাশে। ওটাকে এই জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দূরের দিগন্তে কোথাও যেন আগুন লেগেছে। তার উত্তাপ থেকে বাঁচবার জন্যে টুকরো মেঘগুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে আরেক দিগন্তের দিকে…
বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কথা উঠলেই একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির নাম চলে আসে। যিনি কাগজে-কলমে কোনো ঘটনাকে যেমন বাস্তব রূপ দিতে পারতেন, তেমনি কোনো ঘটনাকে জীবন্ত ফুটিয়ে তুলতে দক্ষ ছিলেন সিনেমার পর্দায়। তার লেখন ছিল সাবলীল এবং ঝরঝরে, যা বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকে মাঝেই দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিভাধর এই সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই পাক সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।
বলছিলাম জহির রায়হানের কথা। ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ উপন্যাস হিসেবে জহির রায়হানের প্রথম সৃষ্টি। প্রেমের উপাখ্যান হিসেবে উপন্যাসটির জুড়ি মেলা ভার। বাংলা সাহিত্যে যতগুলো প্রেমের উপাখ্যান রয়েছে তার মধ্যে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থটি সম্ভবত পাঠক প্রিয়তার শীর্ষের দিকেই অবস্থান করছে। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে থেকেই উপন্যাসটি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আসছে। আর প্রথম উপন্যাসের এই সফলতা জহির রায়হানকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে জনপ্রিয়তার আসনে বসায়।
পুরো উপন্যাসে ষাটের দশকে, পূর্ববঙ্গে কেরানি তথা মধ্যবিত্ত জীবন সংগ্রামের অধুনা রূপটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। স্বপ্ন তখন সংগ্রামের শর্ত। উপন্যাসটি ঠিক এই প্রেক্ষাপটে তরুণ কেরানি কাসেদের গল্প বলে, যার কাছে স্বপ্ন তখনও সংগ্রাম থেকে দূরে। স্বপ্নকে সংগ্রামের গ্রাস থেকে বাঁচাতে সে তখনও নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
পুরো গল্প জুড়ে নায়কের দোদুল্যমান ভাব খুবই বাস্তবিক। জহির রায়হানের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও মানবিক আবেদনগুলোর চমৎকার বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে। একজন পাঠক সাহিত্য পড়ার পর এর চিন্তাধারা যদি নিজের মধ্যে অনুকরণ করে এবং এতে যদি লেখকের সার্থকতা নিহিত থাকে, তবে বলতেই হয় এক্ষেত্রে জহির রায়হান পূর্ণ সার্থক।
লেখক কাসেদকে নায়কের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে বেশি মাত্রায় মার্জিত ও রুচিবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কাসেদ ভালোবাসে জাহানারাকে। অবশ্য ভালোবাসার কথা জাহানারাকে কখনোই জানাতে পারেনি সে। কিন্তু সে স্বপ্ন দেখে একদিন বিয়ে করবে জাহানারাকে। তাদের ছোট্ট একটি বাড়ি হবে, শহরে নয় শহরতলীতে। যেখানে আছে নীল সবুজের সমারোহ। নিরালা পথে দুজনে গল্প করবে, কথা বলবে। রাতের বেলা বাঁকানো বারান্দায় বসে দুজনে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোয়াবে। কিন্তু মধ্যবিত্ত কাসেদের কাছে উচ্চবিত্ত ঘরের জাহানারা শুধু স্বপ্নই থেকে যায়।
কাসেদের খালাতো বোন নাহার। ছোটবেলায় বাবা-মারা যাওয়ার পর মেয়েটিকে নিজের কাছে রেখে কাসেদের মা আদরে বড় করেছেন। নাহারকে আপন ছোট বোন হিসেবেই দেখে কাসেদ। কিন্তু পুরো গল্প জুড়ে নাহারের মনোপ্রবৃত্তির কোনো খবর লেখক পাঠককে জানাননি। কাসেদ কি শুধু জাহানারাকে আড়ালেই ভালোবেসে যাবে? নাকি কখনো জানাতে পারবে? নাহারের মনো প্রবৃত্তির প্রকাশ কি কখনো ঘটবে? প্রণয় রসায়নের এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে বইটি পড়তে হবে।
যেহেতু জহির রায়হান গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি চিত্রনাট্যও লিখতেন, তাই তার গল্প কিংবা উপন্যাসে একটু অন্যরকম ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়, যাকে বলে একেবারে ‘তরল ভাষা’। ছোট ছোট বাক্য এবং দৃশ্যাবলির সহজ সরল বর্ণনা। নির্ঝঞ্ঝাট এবং সরল বর্ণনার কারণে পড়তে গিয়ে কোথাও থেমে যেতে হয় না। ছোট কলেবরের এই বইটি কেউ চাইলে নির্দ্বিধায় একটানা পড়ে শেষ করে ফেলতে পারবে।
গল্পে দেখা যায়, কাসেদ খুব দ্রুত ভাবনা থেকে বাস্তবতার জগতে এবং বাস্তবতা থেকে ভাবনার জগতে আসা-যাওয়া করছে। এই আসা-যাওয়াটা এত দ্রুত ঘটছে যে, অনেকক্ষেত্রেই কোনটা বাস্তব আর কোনটা ভাবনা সেটা বুঝে উঠতে হিমশিম খেতে হয়। দ্রুত ভাবনা এবং বাস্তবতার এই আদান-প্রদান ‘Stream of Consciousness‘ নামে পরিচিত। এজন্য গ্রন্থটিকে সাইকোলজিক্যাল উপন্যাসও বলা যেতে পারে। লেখক ভালোবাসা এবং বাস্তবতা নিয়ে মানব-মানবীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর চমৎকার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
কেরানি কাসেদের জীবনে আসা তিনজন নারী জাহানারা, শিউলি এবং সালমা কাউকেই তিনি ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধতে পারেনি। সালমা যখন কাসেদের কাছে দূরে কোথাও নিরুদ্দেশে হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় তখনও কাসেদ নির্বাক ছিল। এমনকি জাহানারাকেও স্ত্রী বানাতে ব্যর্থ হয় সে। বিতাড়িত হয় শিউলীর কাছ থেকেও। এ সকল দিক কাসেদ চরিত্রটি পাঠকের হৃদয়ে হতাশার ছাপ ফেলেছে। জাহানারা এবং শিউলি দুজনেই উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক মেয়ে। কিন্তু কাসেদের প্রতি তাদের দুর্বলতা পাঠককে বিস্মিত করে।
উপন্যাসের নাহার চরিত্রটি সবচেয়ে ব্যতিক্রম এবং রহস্যেঘেরা। স্বল্পভাষী এই মেয়েটির কথা সমগ্র উপন্যাস জুড়ে খুব কম জায়গায়ই এসেছে। আবার কোনো প্রাসঙ্গিক জটিল ঘটনাতেও তার অনুপস্থিতি রয়ে গেছে। লেখক ইচ্ছা করলে জাহানারাকে কাসেদের ঘরের স্ত্রী করে দিতে পারতেব। কিন্তু তিনি এই সরল সমীকরণে যাননি, যা উপন্যাসকে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করেছে এবং পাঠকের মনে একধরনের ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।
সমগ্র উপন্যাসে জাহানারা, শিউলী, নাহার এবং সালমাদের ভিড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কে হবে শেষ বিকেলের মেয়ে? কিছু গল্প আছে যার শেষাংশের দুই-একটি কথা সমগ্র গল্পের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করে দেয়। এই উপন্যাসেও শেষের দুটি বাক্যের মধ্যে এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যা পাঠকের আবেগকে তাড়িত করবে। অতি সুখপাঠ্য এই বইয়ে পাওয়া যাবে চিন্তার খোরাক। শেষ মুহূর্তের অচিন্ত্যনীয় বিষয় চরম উপভোগ্য এবং অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। কিন্তু কী সেই ‘শেষ স্পর্শ’? সেটা না হয় এখানে না-ই বললাম!
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনীর সোনাগাজীতে। তার পরিবার পূর্বে কলকাতা থাকলেও দেশভাগের পর চলে আসে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৫৮ সালে এখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন তৎকালের অন্যান্য সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্রকারদের তুলনায় অগ্রগামী। ফলে তার কর্মগুলো যুগে যুগে মানুষের দ্বারা প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান। তিনি শুধু প্রখ্যাত সাহিত্যিকই নন। তিনি ছিলেন একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তার ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পাঠকনন্দিত গ্রন্থ। এছাড়া আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, সোনার হরিণ, মহামৃত্যু, ম্যাসাকার গ্রন্থগুলো বাংলা সাহিত্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
১৯৭২ সালে তিনি তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। এবং এরপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি কখনো। ধরে নেয়া হয়, পাকবাহিনী ও আল বদরদের হাতে তিনি নিহত হয়েছেন।
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে
বই: শেষ বিকেলের মেয়ে
লেখক: জহির রায়হান
প্রকাশনা সংস্থা: অনুপম প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬০ সাল
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৮০ পৃষ্ঠা