Reading is to the mind what exercise is to the body
– Joseph Addison
৩০০ বছর আগে করা এই উক্তির সত্যতা যাচাই হয়েছে আধুনিক যুগে এসে প্রযুক্তিগত বিজ্ঞানের কল্যাণে। ব্যায়াম যেমন শরীরের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত দরকারি, ঠিক তেমনই মনের সুস্থতা, বিকাশ এবং আনন্দের জন্য দরকার শিল্প-সাহিত্য চর্চা বা বিনোদনের। আর শিল্প-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে বিনোদন পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা বই পড়া। বই পড়ার মধ্য দিয়ে মানসিক সুস্থতা এবং শান্তি দুই-ই পাওয়া সম্ভব। একগুঁয়ে জীবন, যান্ত্রিক কোলাহল আর প্রতিদিনকার হাহাকারের ভিড়ে দু-দণ্ড শান্তি দিতে পারে একটি ফিকশন বই। ঘুরে আসতে পারেন কল্পিত এক রাজ্য থেকে কিংবা নিজের আড়াল করা সত্ত্বাটাকে ফিরে পেতে পারেন বইয়ের পাতায়। আবার একইভাবে, জীবনে চলার পথে খাওয়া হোঁচটে কিংবা হতাশা নামক নদীতে তলিয়ে যেতে শুরু করলে একটা নন-ফিকশন বই দিতে পারে জীবনে এগিয়ে চলার প্রেরণা আর উৎসাহ।
বছর ঘুরে গেল। নতুন বছর কড়া নাড়ছে দরজায়। ইতিমধ্যেই গেল বছরের বইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ সব পুরষ্কারও দেয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেসব আর বিশ্বসাহিত্য মিলিয়ে এত বই কি আদৌ এক জীবনে পড়া সম্ভব। সেজন্যেই হয়তো সেরা দশের সূচনা হয়েছে।
২০১৯ সালের ফিকশন আর নন-ফিকশন মিলিয়ে হাজার হাজার বই থেকে সেরা দশটি নির্বাচন করা সত্যিকার অর্থেই বেশ চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। আর এই চ্যালেঞ্জকেই বেশ সাগ্রহে গ্রহণ করে বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সেজন্যেই বিশ্বব্যাপী বইপড়ুয়ারা সারাটা বছর পার করে শেষের মাসটায় এসে চোখ রাখে এই পত্রিকার সেরা দশটি বইয়ের তালিকা দেখার জন্য। আর আজকের আয়োজনে থাকছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর দৃষ্টিতে ২০১৯ সালের সেরা দশটি বইয়ের বিবৃতি।
ফিকশন
১. ডিস্যাপিয়ারিং আর্থ – জুলিয়া ফিলিপস
আগস্টের কোনো এক বিকেলে রাশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপ ঘেষা এক ছোট্ট শহর থেকে ছোট্ট দুটি মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। দুই বোনের মধ্যে বড়জন এগারো বছরের এবং ছোটজন মাত্র আট বছর বয়সী ছিল। পুলিশ আসে, তদন্ত শুরু হয়, কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ বা অগ্রগতি হয় না। মেয়ে দুটো যেন একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সেখানকার কমবেশি সবাই-ই এই মেয়ে দুটির নিখোঁজ হওয়াতে বেশ আহত হয় মানসিকভাবে। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার ভয় এবং বিপদটা এই জনবিচ্ছিন্ন জায়গার মানুষগুলো, বিশেষ করে নারীদের উপর, মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
কামচাটকার সেই বছরটা কাটে বইয়ের পাতায় একেকটা অধ্যায়ে একেকটা মাস হয়ে। উপন্যাসটি একজন সাক্ষী, একজন প্রতিবেশী, একজন গোয়েন্দা এবং একজন মায়ের পরিবর্তিত চরিত্রের গল্প বলে। এই বইতে আরো ফুটে উঠেছে জাতিগত বৈচিত্র্যতা আর বর্ণগত উত্তেজনা। ঘন কাঠের বন, তুন্দ্রার উন্মুক্ত অঞ্চল, আগ্নেয়গিরি এবং বরফের আস্তর পড়া কাচের সমুদ্র থেকেও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে পাঠককে।
ডিস্যাপিয়ারিং আর্থ হচ্ছে নারীদের অন্তঃরঙ্গ জীবনের এক বহুমুখী গল্প- তাদের দুর্বলতা, বিপদ-আপদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং স্বপ্ন। গল্পটা সম্প্রদায়ের সেই জটিল আর সূক্ষ্ম বন্ধনগুলোর কথা তুলে ধরেছে যার মাধ্যমে তারা একে অপরের কাছাকাছি থাকে এবং মাঝেমধ্যে চমকপ্রদভাবে একে অপরকে বাঁচাতেও ফিরে যায়।
বিশ্বের একদমই অন্য প্রান্তের মনোমুগ্ধকর একটা অঞ্চলকে আবির্ভূত করানো এই গা ছমছমে আর টান টান উত্তেজনার গল্পটা একজন দারুণ প্রতিভাবান লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করে।
২. দ্য টোপেকা স্কুল – বেন লারনার
পুরষ্কারপ্রাপ্ত ১০:০৪ এবং লিভিং দ্য অ্যাটোচা স্টেশন বই দুটোর লেখক বেন লারনার এবার, শতাব্দীর শুরুর দিককার স্নিগ্ধ এবং সরল এক পারিবারিক নাটক রচনা করেছেন, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বয়োসন্ধিকাল, সীমালঙ্ঘন এবং এমন এক পরিবেশের কথা যার মধ্য দিয়ে দানব এবং অত্যাচারী শাসকের জন্ম হয় নতুন অধিকারে।
অ্যাডাম গর্ডন টোপেকা হাই স্কুলের ১৯৯৭ সালের ক্লাসের সবচেয়ে সিনিয়র। তার মা জেন, বিখ্যাত নারীবাদী লেখক; আর তার বাবা নিজেদের ‘হারিয়ে ফেলা’ বাচ্চাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অতি দক্ষ একজন। তারা দুজনেই একটা ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করে, যেটা বিশ্বব্যাপী কর্মী এবং রোগীদের আকৃষ্ট করেছে একটি সুপরিচিত মনোরোগ ক্লিনিক হিসেবে। তাছাড়া, অ্যাডাম নিজেও একজন খ্যাতিমান তর্কিক এবং বক্তা; সে আশাবাদী- কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই একটা জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়নশিপে বিজেতা হবে।
সে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবিও বটে। অ্যাডাম এমন একজন যে কি না যেকোনো প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য ইতিমধ্যেই নিজেকে তৈরি করে নিতে শুরু করেছে; যাতে করে তার প্রতিপক্ষ তাকে কখনোই দুর্বল ভাবতে না পারে। অ্যাডামের মাধ্যমেই সামাজিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসে নিঃসঙ্গ ড্যারেন ইবারহার্টকে নিয়ে আসার ফলে, যে কি না অ্যাডামের কাছেও অজ্ঞাত এবং তার বাবার একজন রোগী- যার মাধ্যমে বিপর্যয়মূলক প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
দক্ষতার সাথে পারিপার্শ্বিকতার এবং সময়ের পর্যায়কাল সমূহের পরিবর্তনের মাধ্যমে বেন লারনারের দ্য টোপেকা স্কুল বইটি একটি পরিবারের সংগ্রাম এবং শক্তিমত্তার গল্প বলে। আপত্তিকর এক পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে লালন করা, জোনাথনের বৈবাহিক সম্পর্কের লঙ্ঘন এবং বিষাক্ত এক পুরুষতন্ত্রের সংস্কৃতির মধ্য থেকেও এক সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের গল্প এটি। বর্তমানের আলোকে এক প্রতীকী প্রাগৈতিহাসিক গল্প: জনমতের পতন, নতুন অধিকারের নামে দানব আর অত্যাচারী শাসকের জন্ম এবং শ্বেত চামড়ার মানুষজনের অস্তিত্বহীনতার এক গল্প।
৩. এক্সহ্যালেশন – টেড শিয়াং
পুরষ্কারপ্রাপ্ত কল্পবিজ্ঞানের লেখক (যার ছোট গল্প দ্য স্টোরি অফ ইয়োর লাইফ এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড এর নমিনেশন পাওয়া মুভি এরাইভ্যাল) এর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অত্যাশ্চর্য রকমের মৌলিক, মানবিক এবং ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় একগুচ্ছ গল্পের সঙ্কলন এটি। বহুল প্রতীক্ষিত এই দ্বিতীয় গল্প সংকলনটি টেড শিয়াংয়ের অনন্যতা ধরতে রাখতে সক্ষম হয়েছে সম্পূর্ণভাবে। সর্বমোট নয়টি গল্পে প্রকাশ পেয়েছে উদ্ভাবনী ধারণা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চরিত্রগুলোর।
দ্য মার্চেন্ট অ্যান্ড দ্য অ্যালকেমিস্ট গেট গল্পটিতে উঠে এসেছে এক কাপড় বিক্রেতা ফুয়াদ ইবনে আব্বাসের গল্প। প্রাচীন বাগদাদের বাজারে এক ব্যবসায়ীর সাথে তার পরিচয় হয়, যার দোকানের পেছনের দিকটায় একটা পোর্টহোল আছে, যেটা দিয়ে ভবিষ্যতে যাওয়া যায়। লোকটা ফুয়াদকে তিন ব্যক্তির গল্প শোনায় যারা ভবিষ্যতে গিয়েছিল। লোকটার সাথে কথা প্রসঙ্গে ফুয়াদ আরো জানতে পারে, অতীতে যাবারও একটা পোর্টহোল আছে যেটা কায়রোতে অবস্থিত। ফুয়াদ তখন সিদ্ধান্ত নেয় অতীতে যাবার এবং বিশ বছর আগে করা তার ভুলটা শুধরে নেবার।
পত্রসম্বন্ধীয় এক্সহ্যালেশন গল্পটি আবর্তিত হয়েছে একজন এলিয়েন বিজ্ঞানীকে ঘিরে। বিজ্ঞানী এমন একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেন যা শুধু তার নিজের লোকেদের জন্যেই নয়; বরং সমস্ত অস্তিস্ত্বের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ।
দ্য লাইফসাইকেল অফ সফটওয়্যার অবজেক্টস গল্পে এক মহিলা বিশ বছরের বেশি সময় ধরে একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তদারকি করে। কেবলমাত্র এটা উপলব্ধি করতে যে, যদি একটা খামখেয়ালী ডিজিটাল পোষা প্রাণী পালা হয় তাহলে একটা সত্যিকারের জীবের উপর তা কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে।
এই ভিন্ন ধারার নয়টি গল্প টেড শিয়াং এমনভাবে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করেছেন যে, পাঠকের মনে হবে যেন সে ডিনারের টেবিলে এমন কারো সাথে বসেছে, যে কি না তাকে বিজ্ঞানের দুর্বোধ্য সব সূত্রগুলোও গুলিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে অবলীলায়। প্রতিটি গল্পই যেন একেকটা বিজ্ঞানের যাত্রার পাশাপাশি দার্শনিক যাত্রার অনন্য রূপে রঞ্জিত।
৪. লস্ট চিল্ড্রেন আর্কাইভ – ভ্যালেরিয়া লুইসেল্লি
মেক্সিকান লেখক ভ্যালেরিয়া লুইসেল্লি, পর পর দুবার এনবিসিসির ফাইনালিস্ট, তার তৃতীয় উপন্যাস এটি; আর ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। যে উপন্যাসে তিনি সংকটের একটা নতুন পটভূমি উন্মোচন করেছেন- বাচ্চাদের সীমান্ত অতিক্রম, আটক হওয়া, মৃত্যুমুখে পতিত এবং পিতা-মাতার দ্বারা নির্বাসিত হয়ে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা।
উপন্যাসটি আসলে এক দম্পতি এবং তাদের নামহীন দুই সন্তানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। গ্রীষ্মের এক উত্তাপ দিনে তারা সপরিবারে নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে মেক্সিকান বর্ডারের দিকে একটা সড়ক ভ্রমণে বের হয়েছেন। তাদের গন্তব্য অ্যাপাচেরিয়া, যে জায়গাটি একদা অ্যাপাচেসদের বাড়ি বলে প্রখ্যাত ছিল। তাদের দশ বছরের ছেলেটা জানতে চায়, অ্যাপাচেই কেন ফিরছে তারা? উত্তরে তার বাবা জানায়, তারাই শেষ।
গাড়িতে গেমস খেলতে খেলতে এবং গান শুনতে শুনতে তারা গন্তব্যের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু আচমকাই রেডিওতে “অভিবাসন সংকট” সংক্রান্ত একটা খবর প্রচারিত হয়। খবরে বলা হয়, হাজার হাজার বাচ্চা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, এর মধ্যে হয় তারা আটক হয়েছে আর নাহয় বেশিরভাগই মরুভূমিতে পথভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে গিয়েছে। ভার্জিনিয়া হয়ে টেনেসি এবং ওকলাহামা হয়ে টেক্সাস পাড়ি দেয়ার মধ্য দিয়ে তারা সেই বিপদের দিকেই দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে।
লুইসেলির লেখা ভেতরের উন্মাদনা এবং আবেগকে জাগিয়ে তোলে, কিন্তু এরকম একটা উপন্যাস শেষে পাঠক থ মেরে বসে থাকা বাদে আর কী-ই বা করবে? আমরা কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতাকে স্মৃতির ভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত করি, আর কীভাবে আমরা গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসমূহের কথা চিন্তা করি- সে বিষয়ে একটি দুর্দান্ত বই এটি। বইটি জরুরি অবস্থা এবং সহানুভূতির সাথে এমন একটি পরিবারের কথা বলে যারা আজকের যুগে ন্যায়বিচার এবং সাম্যের প্রকৃতি অনুসন্ধান করে।
৫. নাইট বোট টু তাঞ্জিয়ার – কেভিন ব্যারি
নাইট বোট টু তাঞ্জিয়ার কেভিন ব্যারির তৃতীয় উপন্যাস যা ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশ পায়। ক্রাইম ফিকশন বা আরবান ফিকশন ধারার এই বইটি ২০১৯ সালের বুকার প্রাইজের দীর্ঘ তালিকাতেও নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।
২০১৮ সালের অক্টোবরের ২৩ তারিখের গল্প এটা। স্পেনের ভগ্নপ্রায় এক ফেরী টার্মিনালের ওয়েটিং রুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে – দুজন বয়স্ক আইরিশ – মরিস হের্নে এবং চার্লি রেডমন্ড – যারা মাদক চালানের লাভজনক অথচ বিপজ্জনক ব্যবসায়ের দীর্ঘকালীন অংশীদার – রাতের আঁধারে নির্জনে বসে আছে। কারোরই কোনো তাড়া নেই। তারা আশা করছে মরিসের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তারই মেয়ে (নাকি অন্য কারো) ডিল্লি, হয় তাঞ্জিয়ার থেকে একটা নৌকায় করে এখানে ফিরে আসবে আর নয়তো তারা দুজনে এই জায়গা ছেড়ে সেখানে চলে যাবে।
এই নিশিযাপন অসাধারণভাবে তাদেরকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়; যেখানে তারা স্মৃতির কবর খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসে সহিংসতা, রোমাঞ্চ, পারস্পরিক বিশ্বাসঘাতকতা এবং সিরিয়াল কিলিংয়ের মতো নিজেদের লুকোনো গল্পগুলো। স্প্যানিশ এই নির্জন উপন্যাস এমন কোনো জায়গা নয় যেখানে বসে আপনি ধারালো-ধারার ভাবোচ্ছ্বাস বা রুচিকর দর্শনের কথা আওড়াবেন। কিন্তু কেভিন ব্যারি তার উপন্যাসে ঠিক এই কাজটিই করেছেন, তা-ও আবার দুজন প্রাক্তন গ্যাংস্টারের মুখ দিয়ে।
নন-ফিকশন
৬. সে নাথিং – প্যাট্রিক র্যাডেন কিফি
সে নাথিং: অ্যা ট্রু স্টোরি অফ মার্ডার এন্ড মেমোরি ইন নর্দান আয়ারল্যান্ড বইটি ২০১৯ সালে প্রকাশ পায় প্যাট্রিক র্যাডেন কিফির রচনায়। কিফি ২০১৩ সালে ডোলার্স প্রাইসের মৃত্যুসংবাদটি শোনার পর থেকেই মূলত এই বইটি লেখার জন্যে গবেষণা শুরু করেছিলেন। আর তাছাড়া, কিফি নিউ ইয়র পত্রিকার পুরষ্কারপ্রাপ্ত স্টাফ রিপোর্টার।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে জিন ম্যাককনভিল, দশ সন্তানের মা, আটত্রিশ বছর বয়সী এক নারী, মুখোশধারী অনুপ্রবেশকারীরা তার বেলফাস্টের বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় তার বাচ্চা তার পা আঁকড়ে ধরে ছিল। তাকে এরপরে আর কেউই কখনো দেখেনি। দ্য ট্রাবেলস নামে পরিচিত এ অপহরণটি জঘন্য মতবিরোধের একটা পর্ব ছিল মাত্র। তার প্রতিবেশীদের কমবেশি সবাই-ই এটা জানতো যে, এই কেসে আই.আর.এ এর সংযোগ আছে। কিন্তু ভয় আর অজানা এক আশংকায় এ নিয়ে তেমন কেউই কথা বলতে রাজি ছিল না।
২০০৩ সালে, একটি চুক্তি উত্তর আয়ারল্যান্ডে অস্বস্তিকর হলেও শান্তি বয়ে আনার পাঁচ বছর পরে, সৈকতের ধারে একদল মানুষ একটি কংকালের হাড় খুঁজে পায়। ম্যাককনভিলের সন্তানরা জানলো এটা তাদেরই মা ছিল যখন তাদেরকে বলা হলো যে তার পোশাকের সাথে নীল রঙের একটা সেফটি পিন পাওয়া গিয়েছে। বাচ্চাদের সুবিধার্থে, ডায়পারের জন্য বা ছিঁড়ে যাওয়ার কাপড়ে আটকে দেয়ার জন্য এটা সবসময় তার কাছেই থাকতো।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের উগ্র মতবিরোধী সংঘর্ষের বিষয়ে প্যাট্রিক র্যাডেন কিফির এই বইটিতে ম্যাককনভিলকে উগ্র গেরিলা যুদ্ধ দ্বারা আবদ্ধ এক সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখানো হয়েছে, যে যুদ্ধের কোনো পরিণতিই আজ অবধি গণনা হয়নি।
৭. দ্য ক্লাব – লিও ড্যামরোশ
১৯৭৩ সালের এক বিকেলবেলার কথা। চিত্রশিল্পী জোশুয়া রেনল্ডস তার বন্ধু স্যামুয়েল জ্যাকসনকে প্রস্তাব দেয় যে, লন্ডনের টার্ক হেড ক্লাব নামের রেস্তোরাঁতে প্রতি শুক্রবার কয়েকজন বন্ধুকে মধ্যরাত অবধি খাবার, পানীয় এবং কথা বলার নিমিত্তে তাদের সাথে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হবে। শেষপর্যন্ত এই দলের সদস্যদের মধ্যে এডমুন্ড বার্ক, অ্যাডাম স্মিথ, এডওয়ার্ড গিবন এবং জেমস বসওয়েলের মতো মহারথীরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে এই ক্যাফে ‘দ্য ক্লাব’ নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে অনিশ্চিত, উত্তেজনাপূর্ণ এবং নির্মম এক বিশ্বের কথা নিজের লেখনশৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছনে ড্যামরোশ। এটি এমন একদল লোকের গল্প যাদের চিন্তাধারা কেবল তাদের নিজেদের জন্যই নয়, বরং আমাদের জন্যও বেশ গুরুত্ব বহন করেছিল এবং এখনো করে।
৮. দ্য ইয়োলো হাউজ – সারাহ এম. ব্রুম
দ্য ইয়োলো হাউজ সারাহ এম. ব্রুমের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এটাই তার রচিত প্রথম গ্রন্থ যা ২০১৯ সালে প্রকাশ পায়। আর এরই মধ্যে বইটি নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে তাকে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ পুরষ্কার এনে দিয়েছে।
১৯৬১ সালে সারাহ এম. ব্রুমের মা আইভরি মেই নিউ অরলিন্সে একটা ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি কেনেন এবং নিজের পৃথিবীটাকে গড়ে তোলেন সেই ছোট্ট বাড়ির ভেতরে। বিধবা আইভরি মেই, সারাহর বাবা সাইমন ব্রুমের সাথে আবারো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের যৌথ পরিবারে সন্তানদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় বারোতে। কিন্তু সাইমন মারা যাবার পর, সারাহর জন্মের ছয় মাস পরে, ইয়োলো হাউজটাই আইভরির ত্রয়োদশ সন্তানে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
সারাহ এম. ব্রুমের দ্য ইয়োলো হাউজ বইটি আমেরিকার অন্যতম পৌরাণিক কাহিনীর শহরগুলোর একটির অবহেলিত অঞ্চলে তাদের পরিবার এবং বাড়ির সাথে তাদের সম্পর্কের একশো বছরের ইতিহাস বলে। দ্য ইয়োলো হাউজ আদতে জায়গা, শ্রেণী, জাতি, বৈষম্যের পচা ঘা এবং আভ্যন্তরীণ লজ্জার এক উজ্জ্বল স্মৃতি বহন করছে।
৯. নো ভিজিবল ব্রুজেজ – র্যাচেল লুইজ স্নাইডার
নো ভিজিবল ব্রুজ হচ্ছে ঘরোয়া সহিংসতার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কিত পুরষ্কারপ্রাপ্ত একজন সাংবাদিকের একনিষ্ঠ একটি তদন্ত, যেটাতে প্রকাশ হয়েছে আমেরিকার জরুরি সংকটগুলোকে কীভাবে গলা টিপে বদ্ধ দরজার পেছনে সমাহিত করা হয়ে থাকে।
আমরা একে ঘরোয়া সহিংসতা বলি। অনেক সময় ব্যক্তিগত সহিংসতাও বলে থাকি। কখনো কখনো একে আমরা গুপ্ত সন্ত্রাসবাদ নামেও অভিহিত করি। তবে একে আমরা যে নামেই ডাকি না কেন, আমরা আসলে বিশ্বাস করি না যে এই ব্যাপারে আমাদের আদৌ কিছু করার আছে কি না। আর সেজন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘বিশ্বব্যাপী মহামারী’ নামে আখ্যায়িত করেছে।
আমেরিকাতে ঘরোয়া সহিংসতা অন্য সব ধরনের সহিংস অপরাধের মধ্যে ১৫% জায়গা দখল করে আছে, অথচ এই ব্যাপারটিকে এখনো নীরবে নির্জনে চেপে রাখা হয়। অর্থনীতি থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা, হত্যা-রাহাজানি থেকে চূড়ান্ত জাতীয় ইস্যুতে এসব ঘরোয়া সহিংসতা চাপা পড়ে যায়। যার জন্য এই সমস্যার সঠিক মাপকাঠি নির্ধারণ কখনোই সম্ভব হয়নি। আর এই ব্যাপারগুলোকেই বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন র্যাচেল লুইজ স্নাইডার।
১০. মিডনাইট ইন চেরনোবিল – অ্যাডাম হিগিনবোথাম
সত্যিকারের রিপোর্ট এবং নতুন করে করা গবেষণার উপর ভিত্তি করে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপর্যয়ের চূড়ান্ত, নাটকীয় এবং অনুচ্চারিত আর অকথিত গল্পগুলো প্রকাশ পেয়েছে মিডনাইট ইন চেরনোবিল বইটিতে অ্যাডাম হিগিনবোথামের রচনায়।
বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত হচ্ছে ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ। এই বিপর্যয়টি কেবল পারমাণবিক শক্তি এবং একে আবিষ্কার করা বিজ্ঞানের সম্পর্কেই বিশ্বকে উপলব্ধি দেয় না, বরং আমাদের এই গ্রহের নাজুক বাস্তুসংস্থান সম্পর্কেও আমাদেরকে এক উপলব্ধি দিয়েছিল। ঘটনাস্থলে ৩০ কিলোমিটার জুড়ে কাঁটাতারের বেড়ার ওপাড়ে পরিত্যক্ত বাড়িঘর, খেলার মাঠ, মরচে পড়া দূষিত ট্রাক আর হেলিকপ্টারের জঙ্গল; এসবের মধ্যে থাকা অদৃশ্য হত্যাকারী সেই বিকিরণের ঘটনাটিকে চিরকালের জন্য স্থির করে দেয়া হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনের অন্যতম বড় কারণ বলে ধরা হয় এই চেরনোবিল বিপর্যয়কে। মস্কোর জন্য এটা যতটা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছিল ঠিক ততটাই পরিবেশগত আর বৈজ্ঞানিক পর্যায়েরই ছিল। সর্বমোট ১৮ বিলিয়ন রুবলসের চেরনোবিল বিপর্যয় ইতিমধ্যেই টলায়মান অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে দেয় এবং এর জনগণের কাছে প্রকাশ হয়ে যায় যে মিথ্যা আশ্বাস আর আস্থার উপর টিকে আছে তাদের রাষ্ট্র।
মিডনাইট ইন চেরনোবিল বইটি পুরষ্কারের যোগ্য একটি নন-ফিকশন যেটা পড়তে অনেকটাই সাই-ফাই জনরার বইয়ের মতোই মনে হবে। এটা কেবল মৃতের সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত মহাকাব্যই রচনা করেনি, বরং বীরত্বগাথার অমলিন আর অনুচ্চারিত এক অকথিত ইতিহাসের কথাও প্রকাশ করেছে।
সেরা দশ বইয়ের মধ্যে একটি বই- “এক্সক্যাভেশন” বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন।