জলসা: নীতি বনাম স্বার্থের উপাখ্যান

ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান, বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের তারকাখচিত সিনেমাগুলোর ঘন ঘন মুক্তিসহ নানা কারণে বিনোদন জগতের বড় ধরনের মেরুকরণ হয়েছে। এখন বেশিরভাগ সময় মশলাদার সিনেমা মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহে আর তথাকথিত গল্পনির্ভর বা আর্টফিল্মগুলো মুক্তি পায় ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মগুলোতে। এই অবস্থার শুরু হয়েছে সম্ভবত হলিউড থেকেই, অনেক প্রযোজকই হলে মুক্তি দিয়ে লোকসানের সম্ভাবনা না নিয়ে সরাসরি ওটিটিতে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছেন সিনেমা। যার হাওয়া বলিউডেও লেগেছে, বেশিরভাগ কাহিনী-নির্ভর সিনেমাই সরাসরি, নয়তো প্রেক্ষাগৃহে অবমুক্তকরণের কিছুদিনের মধ্যেই ওটিটিতে মুক্তি পাচ্ছে। এর ফলে যা হয়েছে- যেসব অভিনেতা বা অভিনেত্রী সাধারণত গল্পনির্ভর সিনেমায় কাজ করে বেশি অভ্যস্ত দর্শকেরা বড় পর্দায় তাদের কম দেখছেন। বিদ্যা বালান ও শেফালী শাহ তেমনই দুজন অভিনেত্রী, তারা সবসময়ই কাজের ক্ষেত্রে গল্পকেই অধিক প্রাধান্য দেন। এই দুজনেই একইসাথে কাজ করেছেন সুরেশ ত্রিভেণীর নির্মিত জলসা সিনেমায়।

সিনেমার গল্পটি যে একেবারেই আনকোরা তেমন বলা যাবে না, একদমই চেনা একটি গল্প। তবে এই সিনেমার অনন্যতা হচ্ছে এর উপস্থাপনে, চেনা গল্পেরই নতুন উপস্থাপনের সাথে বিদ্যা বালান ও শেফালী শাহের দুর্দান্ত অভিনয় সিনেমার আবেদন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রধান দুই চরিত্রই অনেক টানপোড়নের মধ্য দিয়ে যায়, Image:PinkVilla

একটা সময় ছিল যখন সিনেমায় ভালো-খারাপ অর্থাৎ নায়ক ও ভিলেনের মধ্যকার বিভেদরেখা ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে এখন আর সেই দিন নেই। যত দিন যাচ্ছে ততই এই বিভেদরেখা অস্পষ্ট হয়ে আসছে। উদাহরণ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল সিনেমা ‘অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার’ এবং ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’-এর কথাই ধরা যাক। এখানের যে অ্যান্টাগনিস্ট (যার বিরুদ্ধে গল্পটি লেখা হচ্ছে), থ্যানোস, তাকে কি পুরনো সব ক্লিশে ভিলেনের সাথে তুলনা করা যায়? হ্যাঁ, সে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ মারছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, কিন্তু তবুও আমরা তাকে প্রথাগত ভিলেনের কাতারে ফেলতে পারছি না, কারণ তার উদ্দেশ্য। সে মানুষ ও সম্পদের সমতা চায়, যাতে যারা বেঁচে থাকবে তারা সকলে সমৃদ্ধির সাথে বাঁচতে পারে।

তেমনি জলসা সিনেমাতেও অমন সুনির্দিষ্ট কোনো ভিলেন বা নায়ক নেই। সবার নীতির মধ্যেই সাদা-কালোর মাঝে এক ধূসর জায়গা আছে যেখানে নীতির চেয়ে, ভালো-মন্দের চেয়ে স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে।

সিনেমার পোস্টার, Image: The Indian Wire

সিনেমায় বিদ্যা বালান হলেন মায়া মেনন নামের এক জাঁদরেল সাংবাদিক, যিনি একদম ন্যায়পরায়ণ বলে তার দর্শকের কাছে পরিচিত, কাজ করেন এক নামকরা অনলাইন সংবাদ সংস্থায়। তার সেরিব্রাল পালসিতে (নড়াচড়া ও পেশী সমন্বয় সম্পর্কিত স্নায়ু সংক্রান্ত সমস্যা) আক্রান্ত এক ছেলে রয়েছে, যাকে দেখাশোনা ও ঘরের রান্না-বান্নার কাজ করে রুকসানা মোহাম্মদ, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শেফালী শাহ। মায়ার ছেলে ও রুকসানার মধ্যে বেশ আবেগপূর্ণ এক সংযোগ দেখানো হয়েছে, যা পরবর্তীতে সিনেমার গল্পে বেশ শক্ত ভূমিকা রাখে।

তো, এই নীতিবাগিশ মায়াই একদিন ঘুমকাতুরে অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ফাঁকা রাস্তায় এক মেয়ের উপর গাড়ি উঠিয়ে দিল, এবং মেয়েকে হাসপাতালে না নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা না করে পিঠটান দিয়ে বাসায় চলে এলো। বড়লোক ফুটপাতে গরীবের উপর গাড়ি উঠিয়ে মেরে দিচ্ছে— এমন গল্প আমরা হরহমেশাই দেখি। কিন্তু, এখানে ব্যাপারটা একটু জটিল। মায়া যে মেয়ের উপর গাড়ি তুলে দিয়েছে সে হচ্ছে রুকসানার বড় মেয়ে। সেই রুকসানা আবার তার ছেলেকে নিজের ছেলের মতো করে দেখাশোনা করছে। এখান থেকেই মূলত সিনেমার শুরু। ন্যায়পরায়ণ মায়া কীভাবে এই ব্যাপার সামলায় ও রুকসানা যখন জানতে পারে তার মেয়েকে কে মৃত্যুশয্যায় পাঠিয়েছে, তখন সে-ই বা কী করে— এই নিয়েই সিনেমা এগিয়ে যায়।

পরিচালক মানবচরিত্রের জটিল দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, চেয়েছেন দেখাতে সুবিধা, পরিস্থিতি ও অনুভূতির খাতিরে মানুষ কীভাবে নিজের ন্যায়ের প্রসঙ্গ কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারে।

যেকোনো চরিত্রে স্বাচ্ছন্দ্য বিদ্যা; Image Source: PinkVilla

মায়া প্রথমে চেষ্টা করে যেকোনোভাবে নিজেকে বাঁচানোর, ঘটনা ধামাচাপা দেবার। কিন্তু পরে আবার ঠিকই সিদ্ধান্ত নেয় সব স্বীকার করে নেবার, মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরার; যদিও ঘটনাক্রমে সেটা করা হয় না। এবং এই পুরো সময়টা সে বার বার নিজের সাথে, নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। সে রুকসানার মেয়েকে সস্তা মিউনিসিপ্যাল হসপিটাল থেকে উন্নত ও বিলাসবহুল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে— মায়া যদি অন্য কারও উপরে গাড়ি উঠিয়ে দিত, তাহলেও কি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা সে করত, যেটা সে নিজের প্রতিবন্ধী ছেলের পরিচর্যাকারীর মেয়ের উপরে গাড়ি তুলে দিয়েছে বলে করছে? অথবা রুকসানার মেয়ে যদি অন্য কারো গাড়ির নিচে পড়ত তাহলে? তখনও কি সে সেই সবকিছুই করত যা সে করছে? পরিচালক আমাদের কাছে প্রশ্ন রেখে দেন আমাদের করা কাজগুলোর কতটুকু উদ্দেশ্যহীন ভালো কাজ, আর কতটুকু নিজের স্বার্থ বা অপরাধবোধ থেকে করা।

তবে এই সিনেমার মূল আকর্ষণ রুকসানার চরিত্র। আমরা দেখি তার মেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এবং মেয়ের খুনী কে সেই মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য সে পুলিশের সাথে দরকষাকষি করতে থাকে। তার কাছে কিন্তু তখন মেয়ের ন্যায়বিচারের চেয়ে, মেয়ের এই অবস্থা যে করেছে তার শাস্তির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে অর্থ। এবং এটাই কি স্বাভাবিক না? মেয়ে ন্যায়বিচার পেলে হয়তো সে সাময়িক শান্তি পাবে। কিন্তু ২৫ লাখ রুপি পেলে তো জীবন অন্যরকম হয়ে যাবে; একটু প্রাচুর্য আসবে, মেয়েকে আরো ভালোভাবে রাখা যাবে। কিন্তু তার এই বৈষয়িক চিন্তাই চুরমার হয়ে যায় যখন সে জানতে পারে, তার মেয়ের এই অবস্থার জন্য মায়াই দায়ী। তখন সে প্রতিশোধ নিতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত সে জানত না ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু সে অর্থের প্রতিই আকৃষ্ট ছিল, যখনই সে জানল যে মায়াই এই কাজ করেছে, এবং তার মেয়েকে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছে, তখন কিন্তু সে ঠিকই প্রতিশোধ নিতে চাইল।

এই প্রেক্ষাপট মানবমনের অদ্ভূত আচরণ উন্মোচিত করে। কোনো অপরিচিত মানুষ কাজটা করায় তার যেখানে শুধু অর্থ নিতে সমস্যা ছিল না, কিন্তু মায়া কাজটা করায় সে এমন ধাক্কা পায় যে— সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। কীভাবে প্রতিশোধ নিতে চায় সে? মায়ার প্রতিবন্ধী ছেলেকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে, যদিও সে সেটা করতে পারে না। এখানেও প্রশ্ন ওঠে- যদি মায়ার ছেলের সাথে রুকসানার ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক না থাকত তাহলে কি রুকসানা তাকে মেরে ফেলত?

দুটি চরিত্রকেই পরিচালক এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন যেন দর্শক তাদের চিন্তা, বিবেক নিয়ে প্রশ্ন করতে ভাবতে বাধ্য হয়, ও এই কাজে পরিচালক শতভাগ সফলও হয়েছেন। সিনেমা দেখে দুজনের কাউকেই একচ্ছত্রভাবে ভুক্তভোগী বা দোষী বলার সুযোগ নেই।

দুই শক্তিশালী অভিনেতাই নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন; Image Source: BizAsia

এই সিনেমায় সবার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। পার্শ্ব-অভিনেতা সকলেই অত্যন্ত ভালো কাজ করেছেন। আর টেকনিক্যাল দিক দিয়েও এই সিনেমা বেশ ভালোভাবে উৎরে গিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক একটু চড়া মনে হলেও বেশিরভাগ সময়েই সেটা সীমার মধ্যে ছিল এবং গল্পকে খুব ভালোভাবে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে শেষ পাঁচ মিনিটের বিজিএম একদম স্নায়ুক্ষয়ী ছিল। এছাড়াও সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিছু কিছু দৃশ্য ছিল একদম চোখে লেগে থাকার মতো। বিশেষ করে মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালের জানালা দিয়ে দেখা রাস্তার ওপাশের বিলাসবহুল দালানগুলো ও এরপরেই ভাঙাচোরা হাসপাতাল দেখিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের প্রকাশের দৃশ্যটা বেশ ভালো ছিল। সিনেমায় সরাসরি না বলা হলেও বিভিন্ন দৃশ্যে, চরিত্রগুলোর মধ্যকার কথা-বার্তা, আচার আচরণে বারবার প্রকাশ পেয়েছে ধনী-গরীবের মাঝের বিভেদ, আবার সুযোগ পেলে যে কেউই যে তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না— সেটাও দেখিয়েছেন মায়ার ড্রাইভারের চরিত্রের মাধ্যমে।

বিদ্যা বালানের অভিনয় নিয়ে না বললেই নয়, দুর্ঘটনার পর তার ভয় পাওয়া, স্টিয়ারিং হুইলে কম্পনরত হাত, ভীত চাহনিতে বার বার পেছনে তাকানো থেকে লিফটে ওঠার সময় ক্লস্ট্রোফোবিয়া, রুকসানার চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলতে না পারা, মিছিলের মধ্যে অনড় গাড়িতে ছেলের জন্য চিন্তায় ছটফট করা- সবকিছুই বিদ্যা করেছেন সুনিপুণভাবে। তবে সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন শেফালী শাহ। মায়ার ছেলের সাথে তার রসায়ন, পুলিশের সাথে দরদাম, প্রতিহিংসাপরায়ণ দৃষ্টি, শেষ দৃশ্যে অভিব্যক্তিহীন চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়া- সব কিছু তিনি খুবই সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি দৃশ্যেই তিনি ছিলেন দুর্দান্ত।

পরিচিত গল্পেরই অন্যরকম উপস্থাপন, কলাকুশলীদের চমৎকার কাজ- সব মিলিয়ে সিনেমাটি খুবই উপভোগ্য ছিল। আশা করা যায়, পরিচালক ভবিষ্যতেও দর্শকদের হতাশ করবেন না।

Language: Bangla

Topic: This article is a review on Hindi cinema Jalsa released in 2022. 

Featured Image: Firstpost.com

Related Articles

Exit mobile version