বাংলাদেশের উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত নিরীক্ষায় সবচেয়ে উৎসাহী লেখক বোধকরি শওকত ওসমান। তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসকে কেবল বিষয়বৈচিত্র্যেই ঋদ্ধ করেননি, আঙ্গিক নিরীক্ষায়ও করেছেন সমৃদ্ধ। শওকত ওসমানের উপন্যাস চর্চা শুরু হয় গ্রামীণ জীবনের পটভূমি— ‘বনি আদম’ এবং ‘জননী’তে বৃহত্তর জীবনের রস-রহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের জীবনে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ যখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তখন সঙ্গত কারণেই শওকত ওসমান উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন মুক্তিযুদ্ধ।
‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ শওকত ওসমানের শিল্পীসত্ত্বার তৃতীয় পর্বের রচনা এবং প্রত্যক্ষ ঘটনার উপর ভিত্তি করে রচিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই উপন্যাসের কলেবর ছোট হলেও কাহিনীর গাঁথুনি ছিল প্রবল। সেই সময় সত্যিকার অর্থেই দেশ জাহান্নম হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহায়তাকারী আধা-সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, উচ্ছেদ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে। রাজধানী ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যাসহ একাধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়। বাঙালি ও উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়। অগণিত মানুষের সলিল সমাধি ঘটতে থাকে। লাশের বহর দেখে মানুষ দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু কোথায় পালাবে? পুরো দেশটাই যে জাহান্নম হয়ে আছে।
ঢাকার পূর্বদিক দিয়ে শেখ আজিজুর রহমান ওরফে শওকত ওসমান চললেন সীমান্তের দিকে। পোড়া জমিনের উপর দিয়ে তিনি এগোতে লাগলেন। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। উপন্যাসের মূল চরিত্র গাজী রহমানও একইভাবে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে চলছিলেন সীমান্তের দিকে। তার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই উপন্যাসের মূল কাহিনী। এর বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা এতে নেই। কিন্তু গল্পের মূল চরিত্রের বলার অভিজ্ঞতা বেশ সাবলীলভাবেই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসে দেখা যায়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। অজস্র মানুষ প্রাণভয়ে একবস্ত্রে শহর ত্যাগ করছে।
সাত খণ্ডে বিভক্ত এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক বাংলাদেশের সংকটকালীন মুহূর্ত তুলে ধরেছেন। শওকত ওসমান মূল চরিত্র গাজী রহমানকে একেবারে নির্দ্বন্দ্ব চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেননি। তার মাঝে সবসময় একটি দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল ছিল। সবুজ মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, নাকি সংকটকালেও মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবেন। গাজী রহমানের মাঝে সবসময়ই এ দ্বন্দ্ব কাজ করেছিল।
শওকত ওসমানের বড় ছেলে বুলবন ওসমান লিখেছেন,
“মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা বাবার বাংলাদেশে থাকাটা নিরাপদ নয় মনে করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিই। এ ব্যাপারে আমার মেজভাই আসফাক ওসমান সব ব্যবস্থা করে। সে তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অফিসার হিসেবে চাকরিরত। তার পিয়ন ইদ্রিস মিয়া ও অন্যতম অধঃস্তন অফিসার জীবনকে সঙ্গে নেয়। ওদের বাড়ি কুমিল্লা কোনাবন বর্ডারের কাছে। ওরা বাবাকে আগরতলা পৌঁছে দেবে। আমার ছোটভাই জাঁনেসারও ছিল ওদের সঙ্গে। এই সময় বাবার যে মানসিক দ্বন্দ্ব তা আমরা তার মুখ দেখে বুঝতে পারতাম। যেটি উপন্যাসে বারবার এসেছে।”
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই শওকত ওসমান কলকাতায় পৌঁছান। দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ খবর পেয়ে দেখা করতে আসেন। পত্রিকার জন্য একটা লেখা জমা দিতে তাকে অনুরোধ করেন। শওকত ওসমান তার পথের অভিজ্ঞতা আর নিজের কল্পনা মিশিয়ে লিখে ফেলেন ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’। পরবর্তী সময়ে উপন্যাসটি কলকাতার ‘মুক্তধারা’ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে ‘মুক্তধারা’ ঢাকা থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তবে বর্তমান বাংলাদেশে সময় প্রকাশন বইটি নতুন করে ছেপেছে৷
উপন্যাসটি অপরাপর মুক্তিযুদ্ধের লেখা থেকে ভিন্নতার দাবি রাখে, কারণ এখানে ঘটনার বর্ণনা হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাস বড় হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধের কারণ বা ফলাফল নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা হয়নি। শুধু দুর্বিষহ অবস্থা বর্ণনা হয়েছে। উপন্যাসে কাহিনী অত্যন্ত সরলভাবে বর্ণিত হয়েছে। একদম হঠাৎ করেই যেন উপন্যাসের শুরু হয়েছে। শুরুতে কথোপকথনটা ছিল এরকম,
“এখন কী করবেন, স্যার?”
“তা-ই ভাবছি।”
গাজী রহমান তার আশ্রয়দাতার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
কে গাজী রহমান? কে তাকে প্রশ্ন করল? শুরুতে পাঠক কিছুটা গ্যাঁড়াকলে পড়বে। বাংলা সাহিত্যে সাধারণত ছোট গল্পের ধরন এরকম হয়ে থাকে। তবে গল্পের পরিধি এবং কাহিনীবিন্যাসে এটি একটি আদর্শ উপন্যাস হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমানকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গেছে এর কাহিনী। অন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে রেজা আলী, কিরণ রায়, সৈয়দ আলী, আলম, ইউসুফ, বৃদ্ধা, ফালু প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য।
লেখক ও গবেষক আহমেদ মাওলা ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার এক সংখ্যায় নিম্নোক্তভাবে গাজী রহমানের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন,
ক. বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব।
খ. শত্রুকবলিত দেশ থেকে অসহায় আক্রান্তগ্রস্ত মানুষের নিরাপদ গন্তব্যে যাত্রা।
গ. হানাদার বাহিনীর হত্যা, নির্যাতনের নির্মমতার চিত্র।
ঘ. ব্যক্তি গাজী রহমানের প্রতিরূপ শওকত ওসমানের মানসিক যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার চিত্র।
বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব একটি পুরনো বিষয়। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাকে সাত-পাঁচ ভাবতে হয়। তাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়- আত্মরক্ষা, আত্মোন্নতি, নিরাপদ থাকার স্বার্থচিন্তা। পলায়নপর মানসিকতায় সে ক্রমাগত বিপদ ও বৈরী বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। গাজী রহমানের চরিত্রে এই বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। শুধু গাজী রহমানই নন, সে সময় আক্রান্ত অসহায় মানুষজন এই দুর্বিপাকের রঙ্গ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল।
এই পালিয়ে বেড়ানোর সময় গাজী রহমানের সাথে দেখা হয় উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের সাথে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো উত্থান-পতন কিংবা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চোখে পড়ে না। মূল চরিত্রকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কোনো চরিত্রও গড়ে ওঠেনি। পুরো উপন্যাসে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পরবর্তী দীর্ঘ দেড় মাস সময় জুড়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যে তাণ্ডব বয়ে গেছে, তা গাজী রহমানসহ সব চরিত্রের জীবনেই দুঃস্বপ্নের মতো প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।
‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার আগের উপন্যাসগুলোর ভাষা থেকে এ উপন্যাসের ভাষা কিছুটা ভিন্ন। বিষয় যা দাবি করে, সে অনুসারে এখানে তিনি ভাষা ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে জীবনের কারও সঙ্গে আপোস করেননি তিনি। সমাজের করুণ চিত্র সমকালীন বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন। ঘটনার বর্ণনায় বিশেষ ভাবের উদয় ঘটেছে। ব্যবহার করা হয়েছে আরবি-ফারসি ও প্রচলিত-অপ্রচলিত নানা শব্দ। কখনো ঔপন্যাসিক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। কাহিনীর চিত্রায়ন করেছেন সুকৌশলে। যেমন,
“নদীর টলটলে জলের উপর ভাসতে ভাসতে দুই চোখ লংস্পটে ছড়িয়ে দিলে যদ্দুর তাকাও, বাংলাদেশের আকাশ, হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।”
শিল্পসাহিত্য বিচারে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ ঔপন্যাসিক এক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের অত্যাচারে নরক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে যেতে লেখকের প্রয়াসের কারণেই এরূপ নামকরণ। সেই সময়ে এই ভূখণ্ডের পরিস্থিতি সম্পর্কে বোঝাতে নৌকার মাঝির প্রতি গাজী রহমানের উক্তিটিই যথেষ্ট। যেখানে তিনি বলছেন,
“জোরে চালাও, আরও জোরে, জোরে চালাও, তোমার নৌকা হাঁটে না কেন?… দেখছ না চারিদিকে দোজখ। অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ জ্বলছে… এই নরক থেকে আমি বাইরে যেতে চাই…।”
রচনার গুণ ও আঙ্গিক বিশ্লেষণে হয়তো অনেক কিছুই উঠে আসবে। কিন্তু মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোর দৃশ্যপট চিত্রায়নেই এ উপন্যাস সার্থক।