এপার বাংলা, ওপার বাংলা। কিছু কিছু বিষয় সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে দুই বাংলাকে কোনো এক জায়গায় এক করে দেয়। সেটা হোক এপারের কোনো সুন্দর চলচ্চিত্র কিংবা ওপারের কোনো ভালো বই। সত্যজিৎ রায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক যেভাবে ভূত-প্রেতের গল্প লিখে গিয়েছেন, তাদের মতো করে খুব কম লেখক ভাবতে পেরেছেন। তার মধ্যে একজন সৌমিক দে। তার লেখা ‘কালীগুণীন ও ছয় রহস্য’ ওপারে তো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, এপারেও তার কমতি নেই। বইটি কালীপদ মুখুজ্জেকে নিয়ে। তিনি আসলে গুণীন, তান্ত্রিক, ওঝা না সাধারণ একজন মানুষ- সেটা পাঠকই বিচার করবেন।
এই কালীপদ মুখুজ্জের জীবনের ছোটবড় ছয়টি গল্প নিয়ে সাজানো এ বই। বইয়ের প্রতি অধ্যায়ে ভারতীয় পুরাণের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় উঠে এসেছে। মাঝেমধ্যে আসলে বোঝা কঠিন হয়েছে, এটা ঠিক কোন সময় বা সালের গল্প। আর এই বিষয়টা বইকে যেন আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
অত্যন্ত বিচক্ষণ এই ব্যক্তির জীবনের ছ’টি ঘটনা দিয়ে লেখক বুঝিয়েছেন, কেবল মন্ত্রতন্ত্র আর সাধনার জোরে অপশক্তিকে বশ করা যায় না। অপশক্তিকে বশ করতে প্রয়োজন- জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতার সমন্বয়। শুধু লাল চেলি পরেই নয়, সাধারণ পোশাকেও আমরা গুণীন পেতে পারি, সেটা লেখক আমাদের জানিয়েছেন।
রায়দীঘড়া গ্রামের এই মানুষটি কখনও প্রেতাত্মার সাথে লড়াই করেন নিজের বুদ্ধি দিয়ে, কখনও কেবল চাপাতা দিয়ে জব্দ করে ফেলেন ভয়ঙ্কর অতৃপ্ত অঘোরীদের আত্মাকে। প্রতিটি গল্প শুনলে গ্রামবাংলার প্রচলিত গল্পের কথায় মনে হবে। কোন বাড়াবাড়ি নেই, সাধারণ গ্রামীণ প্রেক্ষাপট, সাধারণ মানুষের গল্প। কালীপদের চরিত্রের কোনো বাড়াবাড়ি স্বভাব নেই। আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ লোক মনে হলেও বেশ অদ্ভুত স্বভাব রয়েছে এই কালীপদ মুখুজ্জে ওরফে কালীগুণীনের। তার চেহারায় মেশা অদ্ভুত কাঠিন্য, কিন্তু তার চোখ দুটোতে আছে নির্ভরতা। সাধারণ মানুষের মতো চলেন দেখে ভূত-প্রেত, অশুভ শক্তি তাকে খুব সাধারণভাবে গ্রহণ করে, কিন্তু তিনি সেসব ছাপিয়ে ক্রমেই কীভাবে অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠেন, তা সম্পূর্ণ বই পড়েই জানা যাবে।
বইয়ে উঠে এসেছে মোট ছয়টি রহস্য, অপশক্তি, দুরাত্মা আর দুষ্টশক্তির গল্প। হাতের তুড়িতে হাসতে হাসতে যেগুলো কালীগুণীন সমাধান করেছেন। কানাওয়ালার ফাঁদ, নেত্রপানির বিভীষিকা, চন্দ্রপিশাচ রহস্য, রক্তগন্ধা রহস্য, হোগলামারীর নরঘাতক ও আপাই। এর মধ্যে সবথেকে সেরা কোনটা, তা বাছাই করা বেশ কঠিন। এর মধ্যে ‘আপাই’ গল্পটি একটু আলাদা; কেন আলাদা, তা নাহয় পাঠকের জন্য তোলা থাকল।
যদিও তিনি ঠিক কোন সময়ের লোক ছিলেন, তা বোঝা শক্ত। মনে হতে পারে, এটা হাজার বছর আগের, আবার মনে হবে, এই তো সেদিনের গল্প। তবে লেখক তার লেখার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসনামল।
ছয়টি গল্পের প্লট কিন্তু খুব বেশি রহস্যমণ্ডিত বা প্যাঁচানো নয়। আর দশটা সাধারণ ভূতের গল্পের প্লট যেমন হয়, তেমনই। তবুও গল্পগুলো আর দশটা গল্প থেকে আলাদা। কারণ অবশ্যই এর প্রধান চরিত্র কালিপদ মুখুজ্জে, যিনি কিনা মূলত এক জমিদার।
প্রতিটি গল্পে একটা জিনিস এক ছিল; তা হলো, অপশক্তির বিরুদ্ধে সবাই যখন পরাজিত, ঠিক তখন গুণীনের প্রবেশ, প্রায় একই উপায়ে। এটা যদি একটু অন্যরকম হতো কিছু কিছু গল্পে, তাহলে বোধহয়, বইটি আরো সুন্দর হতে পারত। ওপার বাংলার বই হলেও বাংলাচলিত রীতির কিছু সাধারণ শব্দ ও ধরন ব্যবহার করা হয়। লেখক এ গল্পে সেগুলো ব্যবহার করেননি। তাই প্রথমদিকে পড়তে, লেখার ধরন বুঝতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে, যা সময়ের সাথে সাথে অভ্যাস হয়ে যাবে।
গল্প, প্লট, কাহিনী ইত্যাদি বেশ গোছানো ছিল। তবে সময়ের এদিক-সেদিকটা কতকটা চোখে লাগার মতো, লেখক এই বিষয়ে আরেকটু যত্নশীল হতে পারতেন। আবার কালীগুণীনের উপস্থিতি গল্পে আরো একটু থাকলে বোধহয় ভালো হতো। কারণ, তাকে মনে হয়েছে, ঝড়ের মতো এসে, ঝড়ের পরমুহূর্তে আবার চলে গেলেন। তবে স্বল্পসময়ে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন, তা ভুলে যাবার জো নেই।
গল্পগুলোতে নতুনত্ব ছিল। তবে পড়ে মনে হয়েছে, আরে এ তো খুব চেনা ঘটনা, আমাদের আশেপাশে হরহামেশাই হয়তো ঘটে যাচ্ছে। এ তো আমাদের পাশের গ্রামের গল্প। গুণীন চরিত্রকে এ বইয়ের লেখক অন্যভাবে এনেছেন। গুণীন বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, এর বাইরেও যে কেউ হতে পারে, সেটা বেশ ভালো লাগার মতো। অনেকটা ছদ্মবেশী গোয়েন্দার মতো। ঠিক যেন ‘আন্ডারকভার গুণীন’।
গুরুগম্ভীর কিছু জায়গায় লেখক ছোটখাটো হাসির খোরাকও জুগিয়েছেন। মাঝে মাঝে পৌরাণিক কিছু কথা উঠে এসেছে, এসেছে অনেক এলাকার কথা, ছোটবড় বেশ সূক্ষ্ম বিষয়। এদিকে লেখক বেশ নজর দিয়েছেন।
ছোট-বড় ভুলের উপস্থিতির পরও মোদ্দাকথা এই, বইটি পড়ে আগ্রহী পাঠকের সময় নষ্ট হবে না। ভালো লাগবে, পড়ার পরও কিছুটা রেশ থাকবে। হয়তো কালীগুণীনের সাথে ঘুরে আসতে পারবেন নিজের শৈশবের ভূতে ভয় পাওয়া দিনগুলোতে, সাথে রয়ে যাবে এক রাশ ভালোলাগা। তবে দুর্বলচিত্তের কেউ যদি ভয় পান, তাহলে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
বইয়ের নাম: কালীগুণীন ও ছয় রহস্য
লেখক: সৌমিক দে
ধরন: ভৌতিক ও রহস্য গল্প সমগ্র
প্রকাশক: চিরকুট [বাংলাদেশ], বিভা পাবলিকেশন্স [ ভারত]