‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ আহমদ ছফার একটি উপন্যাস। প্রতিভাবান লেখনীতে মাজার ব্যবসাকে উপজীব্য করে লেখক উপন্যাসের প্লট সাজিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে উপন্যাসটি ‘লালসালু’ অথবা ‘বহিপীর’-এর মতো মনে হলেও পরে পাঠকের চোখে গল্পের স্বকীয়তা অবশ্যই ধরা পড়বে। আহমদ ছফা যে অন্যদের থেকে আলাদা সত্ত্বার লেখক, তা তিনি আবারো প্রমাণ করলেন এ উপন্যাসের মাধ্যম। উপন্যাসের বাচনভঙ্গি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, লেখক বেশ সুচতুরভাবে গল্প বলে গেছেন। ঘটনার বর্ণনায় অতিনাটকীয় কোনো অবস্থা তিনি তৈরি করেননি। তাই তাকে বুঝতে হলে, পাঠককেও সমান্তরালভাবে মগজ চালাতে হবে।
একই লেখকের ‘অলাতচক্র’ কিংবা ‘ওঙ্কার’-এ গল্প বলার সাথে আলী কেনানের গল্পের প্রকাশভঙ্গিতে মিল পাওয়া যায়। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, লেখক রূপকের আশ্রয়ে কাহিনীর ধারাবর্ণন করেছেন। রূপকের কারণেই তার লেখার তীব্র সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা করা যায় না। গল্পের একেবারে শেষের দিকে এসে পাঠক যখন গল্পের নিগূঢ় বাস্তবতা বুঝতে পারবে, তখন জাবর কাটা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাই একটি সাধারণ গল্পের আবহে তিনি তৈরি করেছেন অসাধারণ এক উপন্যাস।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন তিনি। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্ত্বার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। যেকোনো বিষয় লেখার সময় তিনি খুব সচেতনভাবেই তার অবয়ব সাজিয়ে থাকেন। ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি থেকে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
আহমদ ছফা বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আলী কেনান নামের মূল চরিত্রের সামগ্রিক উত্থান ও পতন উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু করে শেখ মুজিবের শাসনামল পর্যন্ত ঘটনা দিয়ে বিস্তৃত করেছেন উপন্যাসটি। প্রথিতযশা বাংলাদেশী চিন্তাবিদ ও লেখক সলিমুল্লাহ খান আলী কেনানকে শেখ মুজিবুর রহমানের রূপক মনে করেন। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়। আমরা দ্বিধান্বিত হই।
ঘটনার ব্যাপ্তি ছিল ১৯৬৯-৭৫ সাল পর্যন্ত। আলী কেনানের মতো একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে ক্ষমতাবানের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তা আমরা দেখি একটি অংশে। আর মূল অংশে দেখতে পাই, গ্রামের এক দখলদার কীভাবে শহরে এসে জয় বাংলার দরবেশ হয়ে যায়। ধুরন্ধর এই আলী কেনানকে একদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল গভর্নর সাহেব, যে একদিন তাকে বুকেও টেনে নিয়েছিল। ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয় তাকে। চতুর আলী কেনান আস্তে আস্তে ভান ধরে একজন বুজুর্গের। লালসালুর মতো খুলে বসে মাজার ব্যবসা। আলী কেনানের প্রভাব-প্রতিপত্তি এতটাই বেড়ে যায় যে, ব্রিটিশ টেলিভিশনের কোনো এক চ্যানেল তাকে নিয়ে তথ্যচিত্রও তৈরি করে। আলী কেনান আবারো ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের সাথে নিজেকে জড়িয়ে প্রচার করতে থাকে জয় বাংলার দরবেশ হিসেবে। নিজেকে আবিষ্কার করে আলী কেনান বলে,
“স্বর্গবাসী পুরুষের মুক্ত চেতনার সঙ্গে পৃথিবীর শকুনিদের লোভলালসা এক করে না দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে। তাই তারা মাজারে আসে।”
মানুষ মাজারে আসবেই; এবং এখনো তা সত্য। কারণ, মানুষ ভাবে, সে দুর্বল, অসহায় এবং একইসাথে উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
লেখক আলী কেনানের গল্পের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টিতে পাঠকের দ্বিমত থাকতে পারে। সমালোচকেরা এখানে কিছু বিষয়ের অবতারণা করে থাকেন। ১৯৬৯ থেকে আলী কেনান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চরিত্র দুটো সরলরেখায় চলতে থাকে। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে দুজনই দেশে ফিরে আসেন। ক্ষমতায় আসীন হন৷ সময় গড়িয়ে আসে ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
আলী কেনান বলে ওঠে,
“শেখ মুজিব বাইচ্যা নাই, আমি ঢাকায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইল না, আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম।”
একজন সাধারণ পাঠক বিষয়টি এভাবে না ভেবে অন্যভাবেও ভাবতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করার পরও মৃত্যুর সময় খুব কম মানুষকেই কাছে পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনি আলী কেনানের গড়ে তোলা সাগরেদ সম্প্রদায়ও তাকে শেষ অবধি সঙ্গ দেয়নি। বিষয়টি পাঠকের নজর এড়াতে পারে না।
আলী কেনান চরিত্রটি একইসাথে দৃঢ়চেতা, সাবধানী ও চতুর হওয়ার কারণে দেশের অন্য পীর-ফকিরদের সাথে বিলীন হয়ে যায়নি। উপন্যাসে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ছমিরন বিবি ও তার কন্যা উল্লেখযোগ্য। মূল চরিত্রের গল্প এগিয়ে নেয়ার জন্যই অন্য চরিত্রগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এসব চরিত্রের নিজ থেকে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
বাংলাদেশে মাজার ব্যবসার স্বরূপ উন্মোচন করে লেখক সমাজের কিছু অসাধু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ধর্ম আর মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা গড়ে তুলে দুর্নীতি করতে থাকা ব্যক্তিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আমরা উপন্যাসে দেখতে পাই, ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একজন ব্যক্তি ধর্মকে ব্যবহার করে কী করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। গল্পের প্রধান চরিত্র আলী কেনান তো একসময় চিৎকার করে বলে,
“আমার কাছে যত টাকা আছে, শেখ মুজিবের ব্যাংকেও এত টাকা নাই।”
উপন্যাসের শেষের দিকে এসে পাঠককে কিছুটা হতাশ হতে হবে। কারণ আলী কেনানের মতো চরিত্রের এমন পরিসমাপ্তি ঘটবে, তা মেনে নেয়া যায় না। এক্ষেত্রে লেখক কিছুটা তাড়াহুড়ো করেছেন বলে মনে হয়েছে। সবমিলিয়ে উপন্যাসটি বেশ সুপাঠ্য আর শিক্ষণীয়৷ বলতেই হবে, আহমদ ছফা তার এই উপন্যাসে অসাধারণ দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। আলী কেনানের চরিত্রটা এমন, যে কিনা বারবার ভেঙে পড়ে আবার উঠেও দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সে কখনো নতিস্বীকার করেনি। আলী কেনান ক্ষমতার ওজনে নিজেকে শেখ মুজিবের সমতুল্য ভেবে একদিন জোর গলায় বলেছিল,
“বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই।”
অথচ শেখ মুজিবের সাথে কোনোদিন আলী কেনানের পরিচয়ও ছিল না। তবু তার দাপট ছিল ভয়াবহ।
উপন্যাসের শেষের দিকে আলী কেনান একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর সাথে সাথে তার প্রবল প্রতিপত্তি ধুলোয় মিশে যায়। সে নিজের ধ্বংসের রাস্তা নিজেই ঠিক করেছিল। জাগতিক মোহ আর মানবিক কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে সে একসময় হার মানে। অথবা হার মানতে বাধ্য হয়। আবারো প্রমাণ হয়, ক্ষমতা বা ক্ষমতার দম্ভ কখনো চিরস্থায়ী নয়। দুনিয়ার সবাইকেই নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে বিদায় নিতে হয়। আর এ বার্তার মধ্য দিয়েই শেষ হয় আহমদ ছফার আরো একটা উপন্যাস। সমান্তরালভাবে অত্যন্ত সুখকর অনুভূতি আর বিষণ্ণতায় ভরা অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঠককে ইতি টানতে হবে, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’ পাঠের।