“মানুষ আসলে শান্তিই চায় না। তারা গান্ধীকে পর্যন্ত ছাড়েনি!” সিনেমার তৃতীয় অংকের একটি দৃশ্যে প্রধান চরিত্র আমান, যে কিনা একজন সরকারি সিক্রেট এজেন্ট, আর তাকে নজরদারি করতে রাখা আরেক অফিসারের কথোপকথনেই এই কথাটি উঠে আসে। শুধু একটি সংলাপ নয়, এর মধ্য দিয়েই অনেক বড় একটা বক্তব্যের জায়গা দাঁড়িয়ে যায়। অনেক বিস্তৃত অঞ্চল তৈরি হয় মানব চরিত্রের কুৎসিত দিক নিয়ে দার্শনিক আলোচনার, বিশ্লেষণের। মানুষ আসলেই যে শান্তি চায় না। মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিকে নজর দিলে এটা খুবই স্পষ্ট যে, হিংস্রতা, হানাহানির উপরই সভ্যতার বীজ প্রোথিত। বিনাশ ঘটিয়েই মানবসভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। এমনকি বাইবেলীয় রূপক দিয়ে বললেও, সেই হিংস্রতার কথাই আসে। রক্তের মধ্য দিয়েই যে মানবজাতির সূচনা! যুদ্ধের মধ্য দিয়েই যে টিকে থাকা। রক্ত দেখলে তাই মানুষ উল্লসিত হবে না কেন? যুদ্ধ ছাড়া শান্তিই বা সে চাইবে কেন? পরিহাসের বিষয় হলো, হিংস্রতার উপর যে সভ্যতার ভিত দাঁড়ানো, সেই সভ্য সমাজে সভ্য থাকতেই মানুষ তার শেকড়জাত হিংস্রতাকে বস্তাবন্দী করে রাখে।
অসভ্য হওয়ার সুযোগ পেলে, নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশের সুযোগ পেলেই মানুষ হিংস্রতা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ছাড়া দু’দণ্ড জিরোতে পারবে না। এটাই মানুষের প্রকৃতি। দেখলেন তো, একটা কথার সুতো ধরে মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে দার্শনিক বিশ্লেষণের কত বড় জায়গাই না তৈরি হলো! এই সিনেমা শুধু শান্তির দ্বৈরথ নিয়েই কথা বলে না, কথা বলে বৈষ্যম্য, সাংস্কৃতিক আর জাতিগত পরিচিতির জটিলতার মতো নিগূঢ় সব বিষয় নিয়েও।
‘আনেক’ শব্দটির বাংলা অর্থ ‘অনেক’। এই অনেক কারা? সেসকল পরিচিতিহীন জনগোষ্ঠী, যারা না হতে পেরেছে ভারতীয়, না হতে পারলো নিজেদের পরিচয়ে পরিচিত। হতে পেরেছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বলি আর হাতিয়ার। বলতে হয়, ‘আনেক’ (২০২২) পরিচালক অনুভব সিনহার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো এবং সাহসী কাজ। হ্যাঁ, মূল ধারার সিনেমার ফর্মুলাতেই বানানো। কিন্তু ওই মূল ধারার বলিউড বাজারে এমন সিনেমাই দুর্লভ! এমন স্পষ্টবাদিতা, তীর্যক বক্তব্য, সাহসই তো কদাচিৎ চোখে পড়ে ভারতীয় সিনেমায়। পরিতাপের বিষয় হলো- ঠিক এ কারণেই অনুভব সিনহার পূর্বের সিনেমা ‘আর্টিকেল ১৫’, ‘থাপ্পড়’ যে পরিমাণ দর্শক-সমালোচক প্রশংসা এবং সফলতা পেয়েছিল, তেমনটা এই সিনেমার ক্ষেত্রে জোটেনি। ‘আর্টিকেল ১৫’ ও সিনেমা হিসেবে সাহসী ছিল। তবে সেই দুই সিনেমাতে অপেক্ষাকৃত ম্যানিপুলেটিভ ফিল্মমেকিং ছিল। ‘থাপ্পড়’-এ তো সেটার পাশাপাশি বেশ কিছু সূক্ষ্ম পয়েন্টে পরিচালক নিজেই নিজের মতবিরুদ্ধ আচরণ করেন, যা দ্বান্দ্বিকতা আনে বক্তব্যের অতিসূক্ষ্ম জায়গায়। ‘আনেক’-এ তার ফিল্মমেকিং আরো বেশি সৎ এবং মসৃণ।
কন্ঠ আরো বলিষ্ঠ। কিন্তু এই সিনেমা কথা বলেছে ভারতের উত্তর-পূর্ব ৮টি অঞ্চলের বাসিন্দাদের নিয়ে। তুলে ধরেছে যেহেতু তাদের প্রতি বাকি ভারতের বৈষম্যবাদী, কোণঠাসা আচরণকে- তাই প্রশংসা করতে গিয়ে দোনোমনা তো দর্শকের হবেই। সরাসরিই চপটোঘাত করেছে এই সিনেমা একটি দৃশ্যে, যখন একজন বিপ্লবী আমানকে বলে, সেভেন সিস্টার স্টেইটস তথা অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়া, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরার নাম যদি ভারতীয় মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়, তবে ৯০ ভাগই মানচিত্রে এই রাজ্যগুলোকে চিহ্নিত করতে পারবে না! ওই একটা সংলাপেই রাজ্যগুলোর মানুষের প্রতি সর্বভারতীয় জনগণের অবহেলার চিত্র উঠে আসে। তাই অমন আক্রোশে ভরা দাঁতভাঙা বক্তব্যের পর, কালো হয়ে যাওয়া মুখে প্রশংসা স্বভাবতই আশা করা যায় না।
‘আনেক’ তার বিস্তৃত প্রেক্ষাপট আর বক্তব্যকে তুলে ধরতে কেন্দ্রীয় চরিত্র আমানের একটা বোধোদয়ের যাত্রা হিসেবেই অনেকটা কাজ করছে। এবং সেটা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ন্যারেটিভ চয়েজ হিসেবেই কাজ করেছে সিনেমায়। ক্যারেক্টার ড্রামা না, কিন্তু মেকানিজমে সেই অলংকরণ আছে। ভাব আছে। আমানের দৃষ্টিকোণ ধরেই গল্পটা বর্ণিত। আন্ডারকভার এই এজেন্টকে সরকার উত্তর-পূর্ব একটি অঞ্চলে পাঠায়, সেই অঞ্চলের বিদ্রোহীদের প্রধান নেতা টাইগার সাংগাকে প্রতিহত করতে। বিদ্রোহীদের কন্ঠকে ধূর্ত উপায়ে রোধ করে তাদের নেতা টাইগার সাংগাকে সরকারের সাথে শান্তিচুক্তিতে রাজি করানোই আমানের মিশন। ওই সূত্র ধরেই তার পরিচয় হয় আইদো নামের এক বক্সারের সাথে। আইদো চায়, সে বক্সিংয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছানোর পর তার অঞ্চল, তার গোষ্ঠীর দুর্দশা আর নিপীড়নের কথা বিশ্বদরবারে পৌঁছাবে। আইদোর বাবা ওয়াংনাও একজন বিপ্লবী, যিনি স্বাধীনতা চান তার অঞ্চলের, কিন্তু সহিংসতার মধ্য দিয়ে নয়।
ওদিকে, টাইগার সাংগা সরকারের সাথে শান্তিচুক্তিতে রাজি হবে বলে ভয় পেয়ে সাংগার ক্ষমতাসীন দলকেই নাস্তানাবুদ করতে চায় আরেকটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী দল। কিশোর, তরুণরাই যে দলের শক্তি। কলম ধরার বয়সে যারা অবলীলায় সিস্টেমেরই দোষে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। মেনে বলে ‘জনসনের মতাদর্শ!’ এদিকে, মিশন চালাতে গিয়েই আমান ধীরে ধীরে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে এক দ্বন্দ্বমুখর জায়গায় আবিষ্কার করে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। গভীরে গিয়ে সে বুঝতে পারে, শান্তির দোহাই কতটুকু খেলো! অপ্রয়োজনীয়! রাজনীতি কতখানি কুটিল। এবং সে বুঝতে পারে, নিজেই কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে মিশনের বদৌলতে এই রাজনৈতিক অস্থিরতার কানাগলিতে থমকে দাঁড়িয়ে! তার নিজের সততা আর নীতিই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ওদিকে খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। শান্তির নাম দিয়ে অশান্তি আর বিশৃঙ্খলার চরম সীমায় পৌঁছায় এই সিনেমা।
‘আনেক’-এ ড্রামাটিক্যালি ওজনদার আর প্রভাব বিস্তারকারী এমন অনেক দৃশ্য আছে যে, ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার ন্যারেটিভের আলোচনা করলে আবারও বলতে হয়, এটা দুর্লভ! এই সিনেমার শেষ দৃশ্যই তো ভয়ংকর অনুনাদী। ওই আইদো চরিত্রের হাতে উঁচু করে ধরা ভারতের পতাকা। সবাই উল্লসিত। কিন্তু আইদোর মাথা নীচু। হাতের পতাকা সে শুধু ধরেই আছে। সে উদ্দীপনা অনুভব করছে না, গৌরব অনুভব করছে না। কেন? কারণ, যে ভারত তাকে নিয়ে উল্লসিত, সেই ভারতই তার জনগোষ্ঠীকে অবদমিত রেখেছে। তাদের নিজস্ব একটি পরিচয় দিতে চায়নি। তাই জয় কখনোই তার নয়। ওই দৃশ্য ধরেই আয়ুষ্মান খুরান্নার আমান চরিত্রটি তার বসের কাছে প্রশ্ন রেখে যায়, “যারা বিপ্লব চেয়ে জিততে পারেনি, যারা হেরেছে, তাদের কী হবে? কেন তারা উদযাপিত হবার অধিকার রাখে না?”
‘আনেক’ বক্তব্যের জায়গা থেকে অনেক ভারী এবং সুদূর প্রসারিত। গাড়িতে আয়ুষ্মান আর জেডি চক্রবর্তীর আলাপচারিতার দীর্ঘ দৃশ্য নিঃসন্দেহে সিনেমার শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। রাজনৈতিক স্বার্থ, উদ্দেশ্য, শান্তির মিথকে সামনে রেখে অশান্তিপূর্ণ অবস্থার ব্যাখ্যা করে তার মধ্য দিয়ে মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণ, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকে দুজনই এই দৃশ্যে। শুধু এই সিনেমার নয়, সাম্প্রতিক ভারতীয় সিনেমাগুলোর মাঝেই এটি অন্যতম শক্তিশালী একটি দৃশ্য। এই দৃশ্য অভিঘাতী আর অমোঘ করে তোলে সিনেমার প্রতিটি বক্তব্যকে। ‘আনেক’ যে পুরোপুরিই একটি রাজনৈতিক সিনেমা, কড়া বিদ্রুপকারী সিনেমা- তার সুস্পষ্ট পরিচয় এই দৃশ্য বহন করে। ‘আনেক’ আরো দেখায়, রাজনৈতিক সংঘাত আর সহিংসতার মুখে গোটা একটা তরুণ প্রজন্ম কীভাবে নষ্ট হয়, বিপথগামী হয়।
এত ক্ষোভ, ক্রোধ, আর্জেন্সির মুখেও ‘আনেক’ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সৌন্দর্যকে তুলে আনে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার সব নিদর্শন যে ওসব অঞ্চলে আছে, সেটাকে ক্যামেরায় ধরে। বিচ্ছিন্নভাবে নয়। ওই সৌন্দর্যের মাঝে বিনষ্টকারী ভায়োলেন্সকে রেখে একটা যথাযথ বৈপরীত্য এই সিনেমা উপস্থাপন করে। অনুভব সিনহা বক্তব্যধর্মী সিনেমার ন্যারেটিভেই একে কিন্তু পুরোদস্তুর জনরা সিনেমা হিসেবে নির্মাণ করেছেন। অ্যাকশন ফিল্মমেকিং বুদ্ধিদীপ্ততার সাথেই করেছেন। একদম শুরু থেকেই অ্যাকশন ফিল্মমেকিংয়ের বিট ধরে, আর্জেন্সি ধরে উত্তেজনার আবহ তৈরি করেছেন। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সেই ছন্দের পতন হয়েছে। যেমন: গাড়ির ভেতর আয়ুষ্মান আর জেডির ওই আলাপচারিতার দৃশ্যে ফিল্মমেকিংয়ের দিক থেকে আরো চতুর সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারতেন। সম্পাদনায় আরো সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট আনতে পারতেন, কিন্তু ফিল্মমেকিং সেই জায়গায় খুব সাধারণই করেছেন। তবে লেখার শক্তিতে, আয়ুষ্মানের নুয়্যান্সড অভিনয়ে মূল উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ণই থেকেছে। ওই পিঠে বলা দরকার, কুমুদ মিশ্র, মনোজ পাহওয়াদের সমন্বয়ে একটি দক্ষ কাস্টিংয়ের দক্ষ অভিনয়ই তিনি পেয়েছেন এই সিনেমায়।
‘আনেক’ জাতীয়তাবাদী জায়গা থেকে সরে জাতিগত পরিচয়কে খুঁজেছে। সংস্কৃতির ভিন্নতাকে বুঝতে চেয়েছে। ‘আনেক’ শান্তিতে প্রোথিত ভায়োলেন্সকে দেখিয়েছে। শান্তির দ্বিপাক্ষিকতাকেও সম্মান জানিয়েছে। ভায়োলেন্সকে ব্যবহারও করেছে, তবে মহিম্বানিত করেনি। বরং অসহিষ্ণুতার আলাপে এটা যে অবশ্যম্ভাবী রূপে উপস্থিত হয়, সেটাই চিত্রিত করেছে। হ্যাঁ, তা করতে গিয়ে কখনও কখনও সিনেমার গল্প বয়ানের চেয়ে নীতি আর মতাদর্শের বয়ানে ঘেঁষেছে, কিন্তু প্রোপাগান্ডার মুখে, পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের মুখে ওটাই বরঞ্চ জরুরি। এর গা থেকে সব ছাড়িয়ে নিলেও সাহসটা কিন্তু রয়ে যায়।