১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্লো আউট’ (১৯৮০) সম্ভবত ব্রায়ান দে পালমার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা কাজ। এর শুরুতে আমরা সিনেমার ভেতর আরেকটি সিনেমা চলতে দেখি; যেখানে ‘কো-এড ফ্রেঞ্জি’ নামক নকল একটি বি গ্রেডের স্ল্যাশার সিনেমা দেখানো হয়।
এখানকার ক্যামেরার কাজ, বিশেষ করে খুনির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানো শটগুলোয় দর্শকরা ‘ব্ল্যাক ক্রিসমাস’ (১৯৭৪) এবং ‘হ্যালোউইন’ (১৯৭৮)-এর সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। খুনিকে আমরা কলেজের মেয়েদের ছাত্রাবাসের জানালায় উঁকি দিতে এবং সন্তর্পণে সেখানে প্রবেশ করতেও দেখি। এখানে হাতাহাতি, কণ্ঠরোধ এবং ছুরিকাঘাতের মতো ঘটনাবলী সংঘটিত হয়৷ কো-এড ফ্রেঞ্জির দৃশ্যাবলীর যবনিকাপাত হয় ‘সাইকো’ (১৯৬০)-এর বিখ্যাত শাওয়ার দৃশ্যের অপরিপক্ব দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। এই দৃশ্যে অভিনেত্রীর চিৎকার মৃত্যুভয়ের চেয়ে হাসির উদ্রেক করে বেশি।
‘ব্লো আউট’-এর গল্প আবর্তিত হয়েছে জ্যাক টেরি (জন ট্র্যাভোল্টা) নামক একজন সাউন্ড টেকনিশিয়ানকে ঘিরে। সে চেষ্টা করছে, পরিচালকের জন্য নতুন ধরনের শব্দ এবং শেষ দৃশ্যে খাপ খাওয়ানোর মতো একটি নারীকণ্ঠের চিৎকার খুঁজে পেতে। এখানে কীভাবে একটি সিনেমা তৈরি হয়, সে সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয় প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া সত্যকে কীভাবে বিকৃত করে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়; সেটিও দেখানো হয়েছে।
এর বাইরে সিনেমায় উঠে এসেছে তৎকালীন আমেরিকান সমাজের একটি সামগ্রিক চিত্র। যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির এক দশক পরে জনগণের কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছে। পেশী এবং অর্থের বলে বলীয়ানরা সাধারণ কোনো নাগরিককে নিজেদের পথের কাঁটা মনে করলে, কত সহজে চক্রান্তের মাধ্যমে তার জীবনকে নরকে পরিণত করে; তার বাস্তবিক চিত্রও ফুটে উঠেছে এখানে।
‘ব্লো আউট’-এ পরিচালক ছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে সেরা ছন্দে। এটি রাজনৈতিক এবং ভাবাবেগ, উভয় ধরনের উপকরণে পরিপূর্ণ। অসাধারণ নির্মাণকৌশল, মনকাড়া দৃশ্যায়ন এবং বিভিন্ন সিনেমা ও ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিতে ভরপুর এই সিনেমাটি। সিনেমার প্লটে আছে নানা ধরনের পরত। তথাপি পালমা এই প্রজেক্টকে সামলেছেন জাদুকরের হাত সাফাইয়ের মতো সহজাত দক্ষতায়।
সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যাবলীতে আরেকবার আলোকপাত করা যাক। পালমা যখন ব্লো আউট নির্মাণ করেন; তখন ইতোমধ্যেই পরিচালকের আসনে বসে তিনি এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছেন। আর ক্যারিয়ারের ঐ সময়ে দর্শকদের মনকে অন্যদিকে টেনে নেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা ছিল তার। যার কারণে সিনেমা দেখতে বসে প্রথমে মনেই হয়নি যে, সিনেমার ভেতরেই আরেকটি সিনেমা চলছে।
এরকম মনে না হওয়ার আরেকটি কারণ তার ফিল্মোগ্রাফি। এর আগে তিনি বেশ কিছু হিচককীয় থ্রিলার নির্মাণ করেন, যেগুলো ভয়্যারিজম আর উচ্চমাত্রার শোষণে পরিপূর্ণ ছিল। সর্বোপরি, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, ‘ব্লো আউট’-এর আগেই তিনি বানিয়েছেন ‘ক্যারি’ (১৯৭৬); যেটি শুরু হয়েছিল মেয়েদের লকার রুমের ভেতর দিয়ে একটি ট্র্যাকিং শটের মাধ্যমে।
এ সিনেমার ঠিক আগের সিনেমা ছিলো ‘ড্রেসড টু কিল’ (১৯৮০); যেটি আলফ্রেড হিচককের সাইকোর প্রতি সফ্টকোর হোমেজ। এখানে অ্যাঞ্জি ডিকিনসন যা করেছেন, তা করবেন বলে দর্শক ভাবেনি। যা-ই হোক, এই যে নকল সিনেমা থেকে পালমা একটি হাস্যকর চিৎকারের মাধ্যমে বেরিয়ে গেলেন; তা কিন্তু কেবল কমিক রিলিফের জন্য নয়। বরং এর মাধ্যমে দর্শককে তিনি গল্পের দ্বিচারিতার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন৷ এরপর থেকে আমরা যা-ই ঘটতে দেখব; সবকিছুকে প্রশ্ন করতে হবে।
সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসার পরেও চার দশক আগে যখন সিনেমাটি মুক্তি পায়, তখন সেটি বক্স অফিসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত এর করুণ সমাপ্তি, দর্শকদের কাছে যা খুব বেশি নিরাশাজনক বলে মনে হয়েছে। তখন আর কে জানত যে, দ্বিশততম বর্ষীয় উদযাপন, একটি হত্যারহস্য এবং সেটি ধামাচাপা দেওয়ার মতো উপকরণের উপস্থিতি সত্ত্বেও সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে না?
কিন্তু সিনেমাটি কখনোই তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বরং যতই আমরা মিডিয়া ম্যানিপুলেশন, ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তা-ভাবনা এবং উচ্চবিত্ত-সিস্টেমের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছি, ততই এটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়েছে। চার দশক পূর্বের তুলনায়, বর্তমানের দর্শকরা বরং তাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে এই সিনেমার মিল খুঁজে পাবে।
নিজের প্রজেক্টের মৌলিকত্ব পুরোপুরি অটুট রেখেই, আগের কিছু সিনেমাকে ‘ব্লো আউট’-এর কাহিনীর অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছেন পালমা। প্রখ্যাত ইতালিয়ান পরিচালক মাইকেলেঞ্জেলো অ্যান্টিনিওনির ‘ব্লো-আপ’ (১৯৬৬)-এর প্রভাব সরাসরি দৃশ্যমান এখানে। ঐ থ্রিলারে একজন ফ্যাশন ডিজাইনারকে দেখা যায়, যে বিশ্বাস করে একটি খুনের ঘটনাকে সে তার ক্যামেরায় ধারণ করেছে।
আবার আরেক বিখ্যাত পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড ক্যাপোলার মাস্টারপিস ‘দ্য কনভার্সেশন’ (১৯৭৪)-এর প্রভাবও পরিলক্ষিত হয় এখানে। ‘দ্য কনভার্সেশন’-এ আমরা দেখি, নজরদারিতে সিদ্ধহস্ত একজন ব্যক্তিকে; যে বিশ্বাস করে নজরদারির সময় সে একটি হত্যাবিষয়ক ষড়যন্ত্র রেকর্ড করে ফেলেছে। ক্যাপোলার নিজের সিনেমাটিও অ্যান্টিনিওনির সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত৷
পালমা নিজের সিনেমায় যেটি করেছেন, সেটিকে একটি সরল গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব:
ব্লো-আপ + দ্য কনভার্সেশন = ব্লো আউট। অথবা, দৃশ্য + শব্দ = সিনেমা।
শব্দের ব্যাপারটি আগে আসে। ‘কো-এড ফ্রেঞ্জি’-এর পরিচালক জ্যাককে নতুন শব্দ ধারণ করতে বলেন। তাই জ্যাক রাতে ফিলাডেলফিয়া পার্কে চলে যায় আসল শব্দ ধারণ করতে। তার রেকর্ডার অন থাকা অবস্থায় সে একটি দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়। এই যে দুর্ঘটনাটি দেখানো হয়, সেটি বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। ম্যাসাচুসেটসের চ্যাপাকুইডিক দ্বীপে সিনেটর টেড কেনেডির অবহেলার কারণে ২৮ বছর বয়সী একজন নারীর মৃত্যু হয়। এটি ঘটে ১৯৬৯ সালে।
জ্যাকের সামনে ঘটা দুর্ঘটনায় সে একটি গাড়িকে রাস্তা থেকে খাঁড়ির পানিতে পড়ে যেতে দেখে। তড়িঘড়ি করে সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ডুবে যাওয়া গাড়ির ভেতর থেকে স্যালি (ন্যান্সি অ্যালেন) নামে এক নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
হাসপাতালে গিয়ে সে জানতে পারে যে, যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন; তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় গভর্নর। পরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথাও ছিল তার। কিছুক্ষণ পরে গভর্নরের একজন কর্মচারী তার সাথে দেখা করতে আসে এবং বলে, গভর্নরের পরিবারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তার সাথে গাড়িতে কোনো নারী ছিল- এই ব্যাপারটি চেপে যেতে।
দৃশ্য বা ছবির আগমন ঘটে পরে। অদ্ভুত শোনালেও, কাকতালীয়ভাবে একজন অশ্লীলতা বিষয়ক ছবি তোলায় পারদর্শী ফটোগ্রাফারও ঐ রাতে ফিলাডেলফিয়া পার্কে অবস্থান করছিলেন। তিনি পুরো ব্যাপারটাকে ধারণ করেছেন নিজের ক্যামেরায়। ম্যানি কার্প (ডেনিস ফ্র্যান্টজ) নামক এই ফটোগ্রাফার মানুষের স্পর্শকাতর সময়ে ছবি তোলার ওস্তাদ। অনেক দম্পতির সংসার ভেঙেছে এই প্রতারকের কারণে।
কার্প তার কাছে থাকা ছবির প্রিন্টগুলো চড়া দামে বিক্রি করে দেন সংবাদমাধ্যমের কাছে। এই প্রিন্টগুলো এবং নিজের কাছে থাকা শব্দের সমন্বয়ে একটি টেপ তৈরি করেন জ্যাক। তার ধারণা, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত হত্যা। তার বানানো টেপ তার এই ধারণাকে বিশ্বাসে পরিণত করে। আর এই হত্যার ব্যাপারে জানে কেবল সে আর স্যালি। যা তাদের জীবনের জন্য হয়ে ওঠে হুমকিস্বরূপ।
এই অবস্থা থেকে ব্লো আউট সত্তরের দশকে নির্মিত বিভিন্ন পলিটিক্যাল থ্রিলারের ছকে পথ চলতে শুরু করে। প্লট আরো জটিলতর হয় নৃশংস চরিত্র বার্কের (জন লিথগ্রো) আগমনে। তবে পালমা তার সিনেমায় বর্ণিল জাঁকজমক সঞ্চারিত করেন দক্ষতার সাথে। সাথে যুক্ত করেছেন ওয়াটারগেট এবং জন এফ কেনেডি হত্যা পরিকল্পনার নির্যাস। ফলে এটিতে সত্তরের দশকের থ্রিলারগুলোর মতো কনকনে প্যারানয়া দেখা যায় না। এবং এখানে মৌলিক একটি আবহ অবলোকন করি আমরা।
ট্র্যাভোল্টা আর অ্যালেন নিজেদের চরিত্রের সাথে পুরোপুরি মিশে গেছেন। নিজেদের জীবন রক্ষা বিষয়ক টানাপোড়েনের মাঝেও তাদের ভেতর গড়ে উঠেছে একটি মধুর সম্পর্ক। পরিস্থিতি যখন কালো থেকে কালোতর হয়ে ওঠে এবং বিপদ যখন একদম গা ঘেঁষে দাঁড়ায়; তখন পালমার সিগনেচার সেট পিসসমূহ এমনিতেই গড়ে ওঠা চরম সাসপেন্সের আবহকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে।
সিনেমার সমাপ্তি দর্শকের চোখে ধরা পড়ে করাল রূপে। তার কারণ, আমাদের আশা। আমরা কামনা করি, প্রিয় দুই চরিত্র রক্ষা পেয়ে যাবে। সবলের বিরুদ্ধে লড়াই করে দুর্বল জিতে যাবে- এমন ক্ষীণ আকাঙ্ক্ষাও উঁকি দিয়ে ওঠে আমাদের অন্তরে।
জ্যাক শেষপর্যন্ত পেয়ে যায় তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত চিৎকার। এটি তার কাজে ব্যবহারের জন্য যথার্থ। পরিচালকও যারপরনাই খুশি হয়। কিন্তু কোন উৎস থেকে সে এই চিৎকার সংগ্রহ করেছে, সেটা কেবল সে নিজেই জানে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া দুর্ঘটনাটি আসলেই দুর্ঘটনা কি না; এ ব্যাপারে সংগৃহীত সকল দালিলিক প্রমাণ তার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আর ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়েও হেরে যাওয়া অগণিত চরিত্রের একজন জ্যাক টেরি। কনস্পিরেসি থিওরি নিয়ে নির্মিত সেরা সিনেমার তালিকা করলে তাতে ‘ব্লো আউট’-এর স্থান অবধারিত। সময় করে আপনিও দেখতে বসে যেতে পারেন জ্যাকের লড়াই; ব্রায়ান দে পালমার এই মাস্টারপিসের সাথে।