দ্য কাইট রানার: যে উপন্যাস যুদ্ধ, বন্ধুত্ব, মাটি এবং মানুষের গল্প বলে

“পৃথিবীতে অপরাধ একটাই, আর সেটা হলো চুরি! যখন তুমি কাউকে হত্যা করলে, একটা প্রাণ চুরি করলে তুমি! যখন তুমি মিথ্যা বললে, তখন তুমি আসলে একজনের সত্য জানার অধিকার চুরি করলে, যখন কাউকে ঠকালে, তুমি আসলে তার ন্যায়ের অধিকার চুরি করলে!”  

এমন সাবলীলভাবেই জীবনের নানা বাস্তবিক দিক উঠে এসেছে ‘দ্য কাইট রানার’ উপন্যাসটিতে, বইটি লিখেছেন আফগান বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক খালেদ হোসাইনি। এটি তার প্রথম উপন্যাস এবং প্রথমটিতেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন, যার দরুন ২০০৩ সালে প্রকাশের পর এখন অবধি বইটি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রায়ই আলোচনা হয়।

উপন্যাসের মূল পটভূমি হলো আগফানিস্তানের কাবুল। দেশটির সাথে বহু বছরের যুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তবে পুরো বই জুড়ে তা না থাকলেও আফগানিস্তানের যুদ্ধের শুরুটার দেখা মিলবে বইটিতে। সেইসাথে দেখা মিলবে সুন্দর একটা শহরের বাসযোগ্য থেকে হুট করেই অনিরাপদ হয়ে ওঠার গল্পের। সাথে লেখক এ-ও মনে করিয়ে দেবেন যে, কীভাবে অশান্তি শিশুদের জীবন ভিক্ষা দিলেও শৈশব কেড়ে নেয়। এ সম্পর্কে ইঙ্গিত করেই লেখক বলেছিলেন,  

আফগানিস্তানে অনেক শিশু আছে, কিন্তু শৈশব নেই!   

খালেদ হোসাইনি; Image Source: BBC

‘দ্য কাইট রানার’ উপন্যাসটির মূল চরিত্র আমির, তার জবানিতেই উঠে আসে তাদের জীবনের গল্পগুলো। বলা যায়, আমিরের জীবনীই হলো এই উপন্যাসটি। কাবুলের অভিজাত এলাকায় আমিরের বসবাস। মা হারা একমাত্র সন্তান হওয়ার পরও বাবার সাথে শৈশবে একটা অচেনা দূরত্ব অনুভব করতে থাকে সে, বাবার সহকারী হাজারা সম্প্রদায়ের আলির একমাত্র ছেলে হাসান ছিল আমিরের নিঃসঙ্গতার সাথী। যদিও হাসানের বড় পরিচয়, সেও একজন সহকারী। এ পরিচয়ের ব্যাপারে আমিরও তার শৈশবে নিশ্চিত ছিল না; আসলেই হাসান কি তার বন্ধু, নাকি শুধুমাত্র একজন সহকারী? এসব মিলিয়ে পুরো গল্প জুড়ে আছে বহু মানুষের আনাগোনা, যাদের গল্পগুলো এক সুতোয় মিলে পুরো একটি উপন্যাসের জন্ম হয়েছে। 

আফগানিস্তানে শীতকালে স্থানীয়ভাবে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করা হতো, যার মূল লক্ষ্যই ছিল একে অন্যের ঘুড়ি কেটে দেওয়া। তারপর শেষ অবধি যে টিকে থাকবে, সে-ই বিজয়ী। প্রতিযোগিতার আরও একটি আকর্ষণ ছিল কাটা ঘুড়ি সংগ্রহ করা। যারা কাজটি করত, তাদের বলা হত ‘কাইট রানার’। বাতাসের গতিবেগ বুঝে দৌড়ে সবার আগে ঘুড়ি সংগ্রহের কাজটি সহজ ছিল না, বেশ জটিল এবং তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল। আর এ কাজটি পানির মতন সহজে করে ফেলত হাসান, বাতাসের গতিবেগ বুঝে কেটে যাওয়া ঘুড়ি পড়ার স্থানে পৌঁছে যাওয়ার ঈর্ষণীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিল সে।  

বন্ধুত্বের আকাশ; Image Source: Medium

১৯৭৫ সালের ঘুড়ি প্রতিযোগিতাটি ছিল অন্যরকম। আমিরের পরিকল্পনা ছিল বিজয়ী হওয়া, আর তাকে সাহায্য করতে হাসানও ছিল বদ্ধপরিকর। আমির ছেলেবেলায় এই বিজয়টি চাইত শুধু বাবার কাছে নিজেকে তুলে ধরতে। সে জানত, বাবা তাকে খুব নাজুক-ভীতু একটা ছেলে হিসেবেই জানে। আর এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া মানে বাবার চোখের সামনে পুরো মহল্লায় নিজেকে একটা উচ্চতায় তুলে ধরা; কারণ, বিজয়ীর নাম বাতাসের গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় আমিরের বিজয়ের দিনে কাটা পড়া সর্বশেষ ঘুড়িটিকে কুড়িয়ে আনতে গিয়ে হাসানের অনেক দেরি হয়ে যায়। আমির তাকে খুঁজতে বের হয়ে আবিষ্কার করে হাসানের জীবনের এক বেদনাময় ঘটনার। প্রচণ্ড ভয়ের কারণে আমির হাসানকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতে পারে না, অথচ তার মনে পড়ে যায়, যেকোনো বিপদেই নিজের জীবন বাজি রেখে হাসান তার পাশে দাঁড়াতো। এই এক বিকেলের ঘটনা যেন সব কিছু ওলট-পালট করে পুরাতন প্রশ্নটি নতুন করে সামনে আনে, আমির কি সত্যিই হাসানকে বন্ধু ভাবে, নাকি সে ধনী আমিরের একজন সেবক মাত্র? 

সেই এক বিকেলের ঘটনায় আমির নিজেকে অপরাধীও যেমন ভাবে, তেমনি হাসান থেকে দূরে থাকাতেই স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করে; কেননা হাসান তাকে তার অপারগতার কথা মনে করিয়ে দিত।  

হাসান আর আলির দৃশ্যপট থেকে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গল্পটিতে যোগ হতে থাকে আরও নতুন ঘটনার। একদিন হুট করে রাশিয়া আফগানিস্তানে আক্রমণ করে বসে, আর তখন শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন গল্পের। আমির আর তার বাবা আমেরিকায় আশ্রয় পায়। গল্পের প্রধান চরিত্র আমিরের জীবনে ভালোবাসা যেমন আসে, তেমনি বাবা হারানোর ব্যথাও আসে, ধনী বাবার এক দরিদ্র সংগ্রামী জীবনেরও দেখা মেলে আমেরিকায়।

ঘুড়ি ওড়ানোর, না সংগ্রহের গল্প? Image Source: Rokomari 

আমিরের জীবন যখন লেখক হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত, ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিয়ে হওয়ার পর ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় যখন ব্যস্ত, ঠিক তখন তার বাবার বন্ধু রহিম খান তাকে ডাকেন পাকিস্তানে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে যুদ্ধবিধস্ত আফগানিস্তানে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সফর। মৃত্যুর ভয়, প্রতিষ্ঠিত জীবন হারিয়ে ফেলার ভয় পেছনে রেখে গল্পের প্রধান চরিত্র পা বাড়ায় আফগানিস্তানের পথে। যুদ্ধে জর্জরিত তার নিজ দেশে পা রাখতেই গল্পে আসে নতুন মোড়। পুরনো চরিত্রগুলোই আসে নতুন নতুন গল্প নিয়ে, পাঠকের জন্য এ যেন এক নতুন চমক। নতুন এক ব্যথার সন্ধান নিয়ে হাজির হয় একটি শিশু। কী হয় শেষ অবধি? নিজের অভিযানে সফল হয়ে আমির কি পারে আবার আমেরিকায় নিজের জীবনে ফিরতে, অথবা ফিরলেও কি পারে আগের জীবনে ফিরে যেতে? সবকিছু জানতে আমাদের যেতে হবে উপন্যাস ‘দ্য কাইট রানার’-এর কাছে।

পুরো উপন্যাসে বাড়তি পাওয়া হচ্ছে আফগানিস্তানের আচার-আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার বিষয়টি। লেখক খালেদ হোসাইনি এই কাহিনীটিকে শুধু আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা নিয়ে যাননি, তিনি দু দেশের কিছু সাংস্কৃতিক আলোচনাও তুলে ধরেছেন এবং সেইসাথে নিজস্বতাগুলো জানিয়েছেন। যুদ্ধ যে মানুষের জীবনে ভয়াবহ অন্ধকার নিয়ে আসে, তার সাক্ষ্যও আছে পাতায় পাতায়।

পাঠক হিসেবে এ বই থেকে পাওয়ার আছে অনেক কিছুই। ডেইলি টেলিগ্রাফ হয়তো এ জন্যই বইটিকে ‘বিধ্বংসী’ বলে আখ্যায়িত করেছিল আর দ্য টাইমস বলেছিল, ‘হৃদয়বিদারক’। অনেকগুলো মানুষের জীবন আলাদা আলাদাভাবে তুলে আনেননি লেখক, একই সুতোয় গেঁথেছেন সব ঘটনাগুলো আর সেজন্যই হয়তো আন্তর্জাতিক মহলে ভূয়সী প্রশংসা হয়েছে বইটির। সেইসাথে ২০০৭ সালে সিনেমা হিসেবে মুক্তি পায় ‘দ্য কাইট রানার’ এবং এটি প্রায় পাঁচটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করে নেয়। 

‘দ্য কাইট রানার’ সিনেমায় শৈশবের আমির এবং হাসান; Image Source: nicholasjv.blogpost.com 

জীবনের দুই অবিচ্ছেদ্য অনুভূতি, আনন্দ-বেদনায় ডুব দিতে বইটি সত্যিই অসাধারণ। সেইসাথে  সাংস্কৃতিক আলাপ শুনতে পারাটাও পাঠক হিসেবে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করবে। একজন দক্ষ লেখকের কথায় ভর করে এমন অন্যরকম একটি যাত্রা তো করাই যায়, যেখানে দেখা মিলবে জীবনের নানারূপের সাথে, হোক সেটা বেদনার! এসবই তো জীবনের সত্য, লেখক খালেদ হোসাইনি তো তাই জানিয়েছিলেন,

মিথ্যের সাথে স্বস্তি বোধ করার চেয়ে সত্যের আঘাতই ভালো।

বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে- 

https://cutt.ly/JfjXO3Y

This is a Bengali language article. This is a review of the book 'The Kite Runner' by Khaled Hosseini.

Featured Image: Bookishelf.com

Related Articles

Exit mobile version