স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের কথা। একবার ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে দুজন সঙ্গীসহ চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন আনিস সাহেব। উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার পদে যোগদান করা। পথিমধ্যে দাউদকান্দি ও চান্দিনার মধ্যবর্তী কোনো এক স্থানে তার গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। রাস্তা থেকে ছিটকে যায় পার্শ্ববর্তী মাঠে। কুমিল্লার ডিএসপি ফয়জুর রহমান (জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা) তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে অনেকটা আহতাবস্থায় ঢাকা ফেরেন তারা। পরবর্তীতে আনিস সাহবকে দেখতে যান শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমেদ।
গাড়ি দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে দেখতে যাচ্ছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিন আহমেদ! বুঝতেই পারছেন, এই আনিস সাহেব কোনো সাধারণ আনিস সাহেব নন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রয়াত এমিরেটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তাঁর গুরুত্ব কেমন ছিল- সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই উপর্যুক্ত ঘটনাটি প্রথমেই উল্লেখ করা হলো।
তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আনিসুজ্জামানের ছিল দীর্ঘ পরিচিতি ও ঘনিষ্টতা। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি দেখেছেন কাছ থেকে। এ বিষয়টি যুদ্ধকালীন আনিসুজ্জামানকেও গুরুত্বপুর্ণ করে তুলেছে। সে কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উপর লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা ‘আমার একাত্তর’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচিত হয়। ভূমিকায় লেখক নিজেই বলেছেন, “১৯৭১ সালের স্মৃতি যাদের সঞ্চয়ে আছে, তা নিয়ে কিছু বলার মতো কথা আছে- আমি তাদের একজন।” বইটি সাহিত্যপ্রকাশ থেকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথমে ‘ভোরের কাগজ’ সাময়িকীতে, পরে বই আকারে।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমান তালে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। এরকম একটি উত্তাল সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার পদের সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ২৫ মার্চ সকালে একটি ফ্লাইটে আনিসুজ্জামান ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছান। সেদিনই আইয়ুব খান ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ‘আমার একাত্তর’ স্মৃতিকথার ঘটনাপঞ্জি শুরু হয় সেদিন থেকেই। এরপর বইটি এগোতে থাকে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সমান্তরালে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ এবং এর প্রেক্ষাপট নিয়ে।
সত্তরের নির্বাচনে লেখক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জনগণের পালস উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন খুব কাছ থেকে। নির্বাচন পরবর্তী দ্রুত পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে চট্টগ্রামে তাঁর শিক্ষকতা জীবন। উত্তাল মার্চ কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসময় চট্টগ্রামে সাহিত্যিক-শিক্ষক-শিল্পীরা এগিয়ে আসেন জনগণের আধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এসব আন্দোলনে লেখক রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
২৫ মার্চের পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের কেন্দ্র। সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা এবং ইপিআর-এর সদস্যরা জড়ো হতে থাকে সেখানে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ছিলেন ড. এ. আর. মল্লিক। সৈয়দ আলী আহসান, লেখক নিজে এবং ড. মল্লিক সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
সুসজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণে একসময় দুর্বল হয়ে আসে সেই প্রতিরোধ। পেছনে হটেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেখান থেকে লেখক প্রথমে আশ্রয় নেন রাউজানে। তারপর রামগড় হয়ে সীমানা পেরিয়ে চলে যান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। সীমানা পার হওয়ার আগে ও পরে তাঁর সাথে দেখা হয় খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক এবং জিয়াউর রহমানের মতো সেনা অফিসারদের সাথে। রামগড়ে জিয়াউর রহমানের সাথে লেখকের কথোপকথনের বিষয়টি পাঠকের অদ্ভুত লাগবে। জিয়ার সাথে লেখকের কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে জিয়া নিস্পৃহভাবে বলে ওঠেন, “Poor Sheikh! He must be rotting in the prison now“!
আগরতলায় লেখকের সাথে দেখা হয় খালেদ মোশাররফের। সেই সম্পর্কে তিনি বলেন,
চা খেতে খেতে খালেদ মোশাররফের কাছে তার পরিবারের খোঁজ খবর জানতে চাইলাম। ২৫ মার্চ বা তার দুইদিন আগে থেকেই তিনি পরিবার বিচ্ছিন্ন। তার একমাত্র ভরসা তার উপরস্থ কর্মকর্তা- যার বিরুদ্ধে তখন তিনি লড়ছেন। খালেদ মোশাররফের কথা শুনে আমি ভাবতে লাগলাম- এ কী শিষ্টাচার? বীরের প্রতি বীরের সৌজন্য।
এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে লেখক পৌঁছে যান কলকাতায়। সেখানে ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অনুরোধ সত্ত্বেও লেখক প্রথমেই সরকারে যোগ দেননি। বরং কলকাতায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি শিক্ষকদের নিয়ে ড. মল্লিকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গড়ে তোলেন। এরপরের অভিজ্ঞতাগুলো লেখকের নিজস্ব গন্ডির বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদের সাথে যোগাযোগের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।
এই জায়গায় পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে। তবে যেখানেই তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী বা সৈয়দ নজরুলের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা আসে, সেখানে আবার পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। নজরুলের স্মৃতিধন্য মোজাফফর আহমেদ, বিষ্ণু দে এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে লেখকের সাক্ষাৎ-মুহূর্তও পাঠককে আচ্ছন্ন করবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে লেখক-শিক্ষক-সাহিত্যিকদের একটি দল উত্তর ভারত সফর করে। আনিসুজ্জামান ছিলেন সেই দলের সদস্য। সেই সফরে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ হয় তাদের। উত্তর ভারত সফরের এসব ইতিহাস জানার জন্য বইটি একটি ভালো উৎস।
পরবর্তীতে লেখক যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পরিকল্পনা সেলের চারজন সদস্যের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। এসময় সরকারের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তার আভাস বইটিতে দিয়েছেন। বিশেষ করে শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, সীরাজুল আলম খান, আব্দুর রবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী কীভাবে তাজউদ্দীন প্রশাসনকে বিব্রত করেছিল তা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে মুজিবনগর সরকারের সামরিক প্রশাসনের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব ও চ্যালেঞ্জের চিত্র। এছাড়া সরকারের কুটনৈতিক তৎপরতা, ভারত সরকারের সাথে সম্পর্ক, স্বীকৃতি অর্জন, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় প্রচেষ্টার সামগ্রিক কর্মযজ্ঞও বইটিতে বিবৃত হয়েছে, যা এর ঐতিহাসিক মূল্য বৃদ্ধি করেছে।
জুনে কলকাতায় সেক্টর কমাণ্ডারদের একটি সম্মেলনে লেখকের সাথে আবারও দেখা হয় জিয়াউর রহমানের। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন জিয়াউর রহমান। তার কাছে গিয়ে কুশল প্রশ্ন করলাম। বৈঠক ফলপ্রসূ হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজ যত হচ্ছে, সময়ের অপচয় হচ্ছে তার বেশি। যুদ্ধ পরিস্থিতি জিজ্ঞেস করলে তিনি ওসমানীকে নিয়ে তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য করেন। পরে শুনেছিলাম, জিয়া ঐ সভায় ওসমানীর কঠোর সমালোচনা করেন। জিয়ার কথায় ওসমানী এতটাই আহত হন যে তিনি প্রধান সেনাপতি হতে পদত্যাগ করে ঐদিনই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পত্র লিখেন।
নানা আশা-হতাশা, অনিশ্চয়তা, নৈরাশ্য ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে একসময় ডিসেম্বর আসে। একাত্তরের ডিসেম্বর, যার প্রতিটি দিন হয়ে উঠেছিল একেকটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসেন কলকাতায়। ভাষণ দেবেন এক সমাবেশে। লেখক, ড. মল্লিক এবং অনিরুদ্ধ বসে আছেন রেডিওর সামনে। ড. মল্লিকের শতভাগ বিশ্বাস- আজই ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। কিন্তু ভাষণে সেরকম কোনো আভাস পাওয়া গেল না।
ক্ষুদ্ধ হয়ে মল্লিক সাহেব বলে উঠলেন, “কিছু মনে করো না, অনিরুদ্ধ, গরুর গোস্ত না খেলে বোধ হয় মানুষের রক্ত গরম হয় না’।” ইন্দিরা গান্ধি তখনও মঞ্চ থেকেই নামেননি, ইতোমধ্যেই পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করে বসে। ইন্দিরা গান্ধি সাথে সাথে দিল্লি ফেরত যান এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরদিন অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে দিয়ে দেন স্বীকৃতি। এরপর বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে একে একে পতন হতে থাকে প্রতিটি পাক-দুর্গের। মাত্র ১২ দিনের মাথায় বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় যৌথবাহিনী, কলকাতাতেই যার সুভাসে আচ্ছন্ন হন লেখক।
বিজয়ের ৭ দিন পর, ২৩ ডিসেম্বর যশোরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে তিনি বলেন,
যশোরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন। যশোর থেকে আমি খুলনা যেতে চাইলাম। তিনি সন্ধ্যার পরে দূরপাল্লার যাত্রা নিষেধ করলেন। তারপর তিনি বললেন, তিনি অপেক্ষা করছেন মেজর আব্দুল জলিলকে ধরার জন্য। চমকে উঠলাম। মাত্র ৭ দিন হলো আমরা যুদ্ধে জয় হয়েছি। মেজর জলিল সেক্টর কমান্ডার। এরই মধ্যে এমন একজনকে বন্দি করার আদেশ দেয়া হয়েছে তারই অধস্তন কর্মকর্তাকে। ক্যাপ্টেন হুদা জানালেন, প্রধান সেনাপতি এই আদেশ দিয়েছেন।
পরে লেখক খুলনা যান। সেখানে গিয়ে তাঁর দেখা হয় খুলনার নতুন ডিসি কামাল সিদ্দিকের সাথে। তার কাছ থেকে লেখক অভিহিত হন ভারতীয় বাহিনীর ধন-সম্পদ অপহরণের কথা। জানতে পারেন আব্দুল জলিল ও তার সহযোগীদের দ্বারা অবাঙালিদের সম্পদ লুণ্ঠন ও অবাঙালি নারীদের নির্যাতনের কথা। এরকম নানা অভিজ্ঞতার অকপট বর্ণনা রয়েছে বইটিতে।
৮ জানুয়ারি লেখক ঢাকায় পৌঁছান। ঢাকায় ফেরার অনুভূতি এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তের মিশেলে শেষ হয়ে আসে বইটি।
মূলত মুক্তিযুদ্ধে লেখক-সাহিত্যিকদের ভূমিকার কথা মুখ্য হয়ে উঠলেও যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক বিভিন্ন দিক উপলব্ধির জন্যও বইটি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমার একাত্তর কিনতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।