একজন সব্যসাচী লেখক ডক্টর হুমায়ুন আজাদ। স্বকীয় ঢঙ, মেজাজ, স্পষ্টবাদিতা, মননশীলতায় ঋদ্ধ হয়েছে তার সাহিত্যকর্ম। তার সাহিত্য কিশোরদের নিয়ে যায় স্বপ্ন আর সম্ভাবনার মোহনায়, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের কদর্য দিকটিকেও। আমাদের শহরে একদল দেবদূত ডক্টর আজাদের একটি ক্ষুদ্রকায় উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। এখানে তিনি বলেছেন হতাশার কথা, বেদনার কথা, দুঃখের কথা, সেইসাথে দেখিয়েছেন আলোর পথ, যে আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে মুছে যায় সব দুঃখ, বেদনা আর হতাশা।
এ উপন্যাসে তিনি গল্প বলেছেন একটি শহরের, যে-শহরের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে, সবাই নষ্ট হয়ে গেছে, যার কোনো বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ নেই। সে শহরকে একদিন উদ্ধার করে একদল দেবদূত- ওই শহরের পবিত্র শিশুরা। তার এ উপন্যাসে একাধারে উঠে এসেছে নগরায়নের আক্রোশের শিকার মিষ্টি-কোমল নদী, উড়ন্ত পাখি আর চারদিকের সব সবুজের অসহায় মৃত্যু। ফুটে উঠেছে মেঘহীন-বৃষ্টিহীন ইটের খাঁচায় বন্দী নগর, নৈতিকতা-মূল্যবোধের অধোগামীতা, মুক্তচিন্তার বাক-রুদ্ধতা, শিক্ষাব্যবস্থার করুণ দশা, নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীল রূপ, তার নির্মমতার মুখে আমাদের হারিয়ে যাওয়া, মেধাবী তরুণের সন্ত্রাসায়ণের মাধ্যমে ‘অমরতা’ লাভ এবং আমাদের মাথার উপরে ছড়ি ঘোরানো প্রভু-মহাপ্রভু- তাদের চাটুকারদের কাহিনী। এক কথায় এ উপন্যাসটি তুলে ধরেছে আমাদের আধুনিক সমস্যা জর্জরিত সমাজের কুৎসিত কদর্য দিকটিকে।
এ উপন্যাসের শুরুতে লেখক আক্ষেপ করেছেন তার শহরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলা প্রাণোচ্ছল নদীটির অকাল-মৃত্যু নিয়ে। সেই শহরের বাসিন্দাদের তুলনা করেছেন মরে যাওয়া মানুষের সাথে, আর নদীটিকে কাফন বিহীন এক জীবন্ত লাশের সঙ্গে। লেখক আঘাত হেনেছেন আমাদের রাজনীতির উপর- আমাদের শহরের ভৌতিক পরিবেশের উপর। যেখানে বাইরে গেলে হারিয়ে যান অনেকে, আর কখনো তারা ঘরে ফেরেন না। লেখক বলেন,
“আমাদের শহর খুব চমৎকারভাবে আমাদের খেয়ে ফেলতে পারে। আমাদের শহর খুব ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। রক্ত না পেলে আমাদের শহরের তৃষ্ণা মেটে না।”
শিক্ষাব্যবস্থার করুণ দশার কথা তুলে ধরেছেন লেখক খুবই ব্যঙ্গ-রসাত্মকভাবে। যেখানে আমাদের শেখানো হয় উটপাখির মতো বসবাস করতে, নিজের স্বার্থ কীভাবে হাসিল করতে হয় খুব সহজে, অন্যের ক্ষতি করে। প্রাইভেট-কোচিং যেন হয়ে উঠেছে মুদি দোকান, সেখান থেকে এক কেজি একশোতে গুড় কিনছে। যে গুড়ের নাম ইংরেজি। কারও বাসায় চড়া দামে বিক্রি হয় আলকাতরা, যার নাম গণিত।
আমাদের শহরের ভাগ্য যাদের হাতে, সেসব নেতাদের প্রতি লেখক ঢেলে দিয়েছেন তার সমস্ত ক্ষোভ। লেখক বলেন,
“আমাদের বড় বিপদ হচ্ছে আমাদের শহর যারা চালান তারা নষ্ট… আমরা সাধারণেরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকি। কখন কাকে ধরে নিয়ে যাবে, কে আর ফিরে আসবে না, কার চোখ উপড়ে নেবে, কার পায়ের রগ কেটে দেবে, এসব ভাবতে ভাবতে আমরা স্বপ্নেও শিউরে উঠি।”
সেইসব প্রভু-মহাপ্রভুদের চাটুকারিতায় আমরা ব্যস্ত থাকি, তাদের পূজা করি। সেই প্রভুদের অনুগত, বিশ্ব-ইশকুলের সেরা ছাত্র, যাদের কাছে থাকে রাইফেল, স্টেনগান, মর্টার–তারা ট্যাংক চালিয়ে ‘উৎসব’ শুরু করে, ‘অমর’ হওয়ার আশায়।
শেষের অংশে তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেছেন। মরুভূমির মতো ‘পাপিস্থানে’ বন্দী ছিলাম আমরা, একজন নেতার চোখে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম স্বাধীনতার। সে প্রেক্ষাপটেই লেখক আশার আলো দেখিয়েছেন যে একদিন আমাদের শিশুরা বড় হয়ে বদলাবে এই সমাজকে, তাদের বিচ্ছুরিত আলোয় দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে যতো অশুভ-অন্যায়-অনাচার আর প্রভু-মহাপ্রভুর দল, বাতাসে ফেরে গোলাপের গন্ধ-আবার বয় নদী, শহরে সূর্য উঠে, হেঁসে ওঠে চাঁদ।
হুমায়ুন আজাদের ভাষা সব সময়ই অপূর্ব, এ উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি যতটা রুঢ়তার সাথে সত্য বলতে পেরেছেন, দৃঢ়তা-স্পষ্টবাদিতার সাথে তুলে ধরেছেন যাবতীয় অসঙ্গতি। ছবিতে-কবিতায়-ব্যঙ্গে-বিদ্রূপে-