লাইব্রেরিতে যাতায়াতের অভ্যাস আছে আপনার? কী করেন সেখানে গিয়ে? প্রশ্নটা শুনে একটু হাসি পেল হয়তো। লাইব্রেরিতে গিয়ে আবার মানুষ কী করে! বই পড়ে! আর কী? এই তো ভাবছেন? বাস্তবে এই পুরো ধারণাটিকেই বদলে দিয়েছে অন্যরকম এক লাইব্রেরি। যার নাম- ‘হিউম্যান লাইব্রেরি বা মানুষের গ্রন্থাগার’।
বইয়ের ভাঁজে আমরা অনেক মানুষের জীবন সম্পর্কে জানি, তাদেরকে কল্পনা করতে ভালোবাসি। গল্প কিংবা উপন্যাস- সবকিছু তো সেই এক মানুষকেই ঘিরে। মানুষ অন্য মানুষের জীবনকে জানতে চায়, জানতে ভালোবাসে। আর ঠিক সেই ব্যাপারটিকে মাথায় রেখেই রনি এবেরগেল, ছোট ভাই ড্যানি এবং বন্ধু আসমা মউনা ও ক্রিস্টোফার এরিকসন- এই চারজন গড়ে তোলেন আমাদের পরিচিত লাইব্রেরির চাইতে একেবারে ভিন্ন এক লাইব্রেরি। যেখানে বই নয়, থাকবে মানুষ। মানুষ অন্য মানুষের জীবনকে জানতেই যদি বই পড়ে থাকে, তাহলে কেন সেই মানুষটিকেই সরাসরি জেনে নেওয়া নয়?
শুরুটা হয় ২০০০ সালে। তবে তখন এত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নয়, ডেনমার্কের রসকিল্ডে উৎসবে ছোট্ট করে যাত্রা শুরু করে লাইব্রেরিটি। ধর্ম-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কথা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল রনি, ড্যানি, আসমা এবং ক্রিস্টোফারের উদ্দেশ্য। এতে সবার মধ্যে থাকা মিলগুলোকে খুঁজে নেওয়া সহজ হবে সবার, এমনটাই ভেবেছিলেন তারা। সেই ঘটনার পর টানা ১৭টি বছর পেরিয়ে গেছে। প্রায় ৮৪টি দেশে ছড়িয়ে আছে বর্তমানে হিউম্যান লাইব্রেরি। তো এখন প্রশ্ন হলো, হিউম্যান লাইব্রেরি ব্যাপারটা ঠিক কী? কীভাবে কাজ করে এটি? সহজ একটা ধারণা তো একটু আগেই দিয়েছি। চলুন এবার ঘুরে আসা যাক এর ভেতর থেকে।
হিউম্যান লাইব্রেরি হলো এমন এক লাইব্রেরি যেখানে বই নয়, সাজানো থাকে মানুষ। না, এমন নয় যে, সবসময় লাইব্রেরির ভেতরেই থাকেন তারা। নিজেদের ইচ্ছেমতন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে এই মানুষেরা। ডাক পড়লেই চলে আসেন অবসর সময়ে আর মুখোমুখি বসে পড়েন পাঠকের সামনের চেয়ারে। এরপর? এরপর প্রশ্ন করে পাঠক আর উত্তর দেয় সামনে বসা মানুষটি। পাঠকের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর অনেকটা খোলা বইয়ের মতোই দেয় তারা। ভাবছেন, একজন জলজ্যান্ত মানুষকে কী জিজ্ঞাসা করেন পাঠকেরা? হতেই তো পারে, সামনের মানুষরুপী বইটি একজন রোহিঙ্গা কিংবা নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত। ভাবুন তো, আপনার মনে কোনো প্রশ্ন আসছে কিনা? এমন কাউকে সামনে পেলে কি জিজ্ঞেস করতেন না যে, তার দিনগুলো কেমন যাচ্ছে বা কেমন বোধ করছে সে?
ঠিক এভাবেই সামনের মানুষগুলোর প্রতি পাঠকের আগ্রহের শেষ থাকে না। এমন নয় যে, হিউম্যান লাইব্রেরিতে প্রবেশ করলে আপনি কেবল পাঠক হতে পারবেন। চাইলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন কারো বই। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেরা ঠিক করে নেয় যে, তারা বই হবে নাকি বইয়ের পাঠক। সমস্ত ভুল ধারণা, হতাশা, সাংস্কৃতিক অসামঞ্জস্য- মানসিক সব বাঁধাকে দূর করতে সাহায্য করে এই হিউম্যান লাইব্রেরি। সেটা কেবল পাঠকের ক্ষেত্রেই যে ইতিবাচকভাবে কাজ করে তা নয়, প্রভাবটা দ্বিপাক্ষিক। এতে করে দুজন মানুষ নিজেদের জীবন সম্পর্কে জানতে পারে।
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা থাকে। সেই অভিজ্ঞতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠেছে বর্তমানে হিউম্যান লাইব্রেরি। হিউম্যান লাইব্রেরি আর সব লাইব্রেরির মতোই। শুধু আপনি এখান থেকে “বই ধার করে বাসায় নিতে পারবেন না, পৃষ্ঠা উল্টে রাখতে কিংবা টুকে নিতে পারবেন না, এমনকি বিছানায় শুয়ে শুয়েও পড়তে পারবেন না”। নিজের প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি সম্পর্কে মজা করে কথাগুলো বলেন রনি। আমাদের সাধারণ জীবনে প্রতিনিয়ত কাজের ফাঁকে আমরা এমন মানুষের দেখা খুব কম পাই যারা অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে আছেন কিংবা সেরকম কোনো কঠিন সময় ও অবস্থাকে পার করে এসেছেন। আর এমন কেউ আমাদের পাশে থাকলেও তাদের কথাগুলো আমরা জানতে পারি না। হিউম্যান লাইব্রেরির মূল উদ্দেশ্যই এই কঠিন পরিস্থিতি, প্রতিকূল জীবন সম্পর্কে সবাইকে জানানো। কোনো বাঁধাধরা ভাবনা থেকে মানুষকে বের করে আনাটাই লাইব্রেরির মূল লক্ষ্য।
এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ থেকে শুরু করে ধর্মান্তরিত মানুষ, আত্মহত্যা করতে গিয়ে ফিরে আসা কোনো ব্যক্তি- এমন সবাইকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এদের সবারই জীবনের একটি গল্প আছে, একটি অভিজ্ঞতা আছে যেটা আমাদের সবারই জানা উচিত। আর সেটাই আমাদের সহজের জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে হিউম্যান লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে পড়তে গেলে আপনাকে প্রথমে নিজের পছন্দসই বিষয় খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে পেয়েছেন? এবার আপনাকে দেওয়া হবে মোট আধা ঘন্টা সময়। কী? কম মনে হচ্ছে সময়টা? আরো বেশিক্ষণ পড়তে ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটিকে? তাহলে আধা ঘন্টা পর আবার নিজের ধারের সময় বাড়িয়ে নিন নবায়নের মাধ্যমে। হিউম্যান লাইব্রেরি বেছে বেছে নিজের বইগুলোকে প্রকাশ করে। আর কিছুদিন পর পর নতুন করে সম্পাদনা করে সেগুলোকে। এটার নিশ্চয়তা দেয় যে, এই বইগুলো যেন পাঠকের জন্য কোনো ফলাফল বয়ে আনে।
হয়তো আপনার মনে হচ্ছে, মানুষরূপী এই বইয়েরা বানানো কিছু। উঁহু, একদম তা নয়। আপনি যদি হিউম্যান লাইব্রেরিতে কোনো অসহায় আর ঘরহীন মানুষের সাথে কথা বলেন, তাকে পড়েন, তার মানে সে সত্যিই ঘরহীন। এত কিছু জানার পর একটি প্রশ্ন আপনার মাথায় ঘুরপাক খেতেই পারে। আর সেটি হলো- হিউম্যান লাইব্রেরির এই বইগুলো যেহেতু সমাজের এমন সব মানুষ যাদের জীবনে প্রতিকূলতার অভাব নেই। এই যেমন একটু আগেই বললাম ঘরহীন মানুষের কথা। লাইব্রেরি কি কেবল নিজের কাজেই এদেরকে বই হিসেবে ব্যবহার করে? না, কেবল বই হিসেবে মানুষকে ব্যবহার করে না লাইব্রেরি। তাদেরকে সাহায্যর চেষ্টাও করে। এই মানুষগুলোর আশ্রয় হিসেবে কাজ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় এটি। জীবনে অনেক প্রতিকূলতা থাকলেও সেটাকে কাটিয়ে ওঠা যে কোনো ব্যাপার নয় সেটা বুঝতে পারা যায় হিউম্যান লাইব্রেরিতেই। এই যেমন লাইব্রেরির একজন বই মাফ ভালনাজ। হিউম্যান লাইব্রেরির এই বইটির শরীরের শতকরা ৮০ শতাংশ অংশই ট্যাটুতে ভর্তি। মাথার দু’পাশে দুটো শিংএর মতো দেখতে উঁচু কিছু। কেমন আছেন তিনি?
“আমাকে সকালে উঠতে হয়, কুকুরকে নিয়ে ঘুরতে বের হই আর বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়, আমরা সবাই তো মানুষ।”
আর এই অনুভূতি তাকে এনে দিয়েছে হিউম্যান লাইব্রেরিই। অনেক পরিবর্তনের পর অবশেষে নিজেদের বই হিসেবে ভালনাজকে প্রকাশ করে হিউম্যান লাইব্রেরি। গল্পটা আরো অনেক বইয়ের ক্ষেত্রেই এক।
রনি এবং বাকি সবার ইচ্ছা আছে কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের এই লাইব্রেরিকে অন্তর্জালের দুনিয়াতেও ছড়িয়ে দেওয়ার। কেবল সশরীরে নয়, যেন মানুষ ইন্টারনেটেও ইচ্ছে করলে বিভিন্ন প্রান্তের অবহেলিত এবং প্রান্তিক মানুষগুলোকে পড়তে পারে, জানতে পারে। খুব বেশি দেরী নেই সেই দিনটির। তাই এখন কেবল অপেক্ষার পালা। কে জানে, যেকোনো সময় হয়তো ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে এই সেবা আর বাংলাদেশ থেকেই হিউম্যান লাইব্রেরির প্রকাশিত বই পড়তে পারবেন আপনি। কী? কী কী বই পড়বেন তার লিস্টটা করা হয়ে গেছে তো?
ফিচার ইমেজ: The Yellow Sparrow