মালায়লম শব্দ ‘ইরাট্টা‘র বাংলা অর্থ জমজ। সিনেমাটি রচনা এবং পরিচালনা করেছেন রোহিত এম জি কৃষ্ণান। ক্যামেরার পেছনে এ সিনেমার মাধ্যমেই অভিষেক ঘটলো তার।
ইরাট্টা-র শুরুতে দর্শককে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের কেরালা রাজ্যের ইদুক্কি জেলার ভাগামন পুলিশ স্টেশনে। সেখানে চলছে তোড়জোড়, পড়ে গেছে সাজ সাজ রব। আসন্ন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ব্যস্ততায় ফুসরত মিলছে না কোনো পুলিশ সদস্যের। গ্রাম্য পুলিশ স্টেশনটি দায়িত্ব পেয়েছিল সরকারি একটি গৃহনির্মাণ প্রকল্পের। সেই প্রকল্পের চাবি আজ তুলে দেয়া হবে উপকারভোগীদের হাতে। উপস্থিত থাকবেন মন্ত্রীও। তাই মিডিয়ার লোকজনও এসে ভিড় করেছে স্টেশনে। মাইকে কথাবার্তা বলছেন থানার উচ্চপদস্থরা। অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। মন্ত্রীর আসতে দেরি হচ্ছে। ফলে অনুষ্ঠান শুরুতেও দেরি করছে থানা কর্তৃপক্ষ। উৎকণ্ঠ জনতা ও সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের বিপরীতে তাদেরকে শান্ত থাকার আহবান জানানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, ছোট্ট এক টুকরো জমিতে টেপবিহীন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলছে দুটি শিশু। উইকেটকিপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে তাদের পোষা কুকুর। একজন ১২ রানের টার্গেট দিয়ে আউট হয়ে গেল। ব্যাটিংয়ের পালা আসলো অন্যজনের। নিজের ব্যাটিংয়ের একপর্যায়ে সজোরে ব্যাট হাঁকালো সে। ফলাফল? ছক্কা! বল পেরিয়ে গেলো ছোট্ট জমিটির সীমানা প্রাচীর। কিন্তু ব্যাটসম্যানের আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। কারণ খেলা চালিয়ে যেতে হলে বলটি তো খুঁজে আনতে হবে!
ফলে দুই ক্ষুদে ক্রিকেটারকে আমরা সীমানা প্রাচীর বেয়ে উঠতে দেখি। সেখান থেকে তারা নিজেদের বল দেখতে পায়। বোলার অনেকটা সখেদেই প্রতিপক্ষকে বলে, “তুই মেরেছিস; তুই-ই নিয়ে আসবি!“
টিভিতে চলছে মালায়লম ভাষার সংগীত বিষয়ক একটি রিয়ালিটি শো। গান গাইছেন একজন প্রতিযোগী। কেরালা ছেড়ে মুম্বাইয়ে থিতু হওয়া এক মহিলাকে দেখা যায় টিভি পর্দায়। তিনি বলছেন কীভাবে কাজের জন্য তাকে নিজের মেয়েকে একা রেখে যেতে হয়েছে। একা একা তার মেয়ে নিজের সংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছে। তার ফলেই সে আজ গান গাইছে সেই অনুষ্ঠানে। আর মাকে দেখা যাচ্ছে টিভির পর্দায়।
রয়েছে থানায় বন্দী এক আসামি। সে ধরা পড়েছে মাদকসহ। কর্তব্যরত এক পুলিশ অফিসারের কাছে সে অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করে। কিন্তু সেসব গায়ে না মেখে উল্টো তাকে বকাঝকা করে পুলিশ অফিসার চলে যান অন্য রুমে।
কাছাকাছি আরেক অফিসার তাড়াহুড়ো করে টয়লেটে যেতে চান। নিজের সার্ভিস রিভলবারটা আরেক পুলিশ সদস্যের ডেস্কে রাখেন। বলেন তিনি আসা পর্যন্ত রিভলবারটির উপর নজর রাখতে।
আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায় হাসপাতালে। নিজের চেকআপ করাচ্ছেন এবং কথা বলছেন ফোনে৷ নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে তিনি বোঝাচ্ছেন ফিরে আসতে। অনেক তো বিরহ হলো। আর কত!
তার মেয়েটা বাবার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না কিছুই। কিন্তু মেয়ের উপর, তাকে জানার অধিকার তো তারও আছে!
এভাবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোকে এক ঝলক দেখানোর পর হঠাৎই ছন্দপতন। গল্পের সহজাত ভঙ্গি আর থানার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কোলাহলকে চিরে দেয় পর পর তিনটি গুলির শব্দ। আবারও হুড়োহুড়ি শুরু হয়। সবার গন্তব্য থানার ভেতর, শব্দের উৎসের দিকে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় নিজ কক্ষে, নিজের ডেস্কে খুন হয়েছেন এএসআই বিনোদ (জোজু জর্জ)। খুনের কারণ আর মোটিভ দুটোই অজানা।
কর্তব্যরত পুলিশ কর্তা সতীশ চন্দ্রন (শ্রীকান্ত মুরালী) অধঃস্তনদের আদেশ দেন জনসাধারণ এবং আগত সাংবাদিকদের হঠিয়ে দিতে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এভাবে ইরাট্টা পরিণত হয় একটি পুরোদস্তুর পুলিশ প্রসিডিওরাল হুডানিটে।
হুডানিট জনরার অন্যসব সিনেমার মতো ইরাট্টাতেও সাসপেক্টদের দেখা পাই আমরা। সাথে সাথে উঠে আসে তাদের মোটিভের ব্যাপারও। প্রথমেই সন্দেহের আঙুল ওঠে ঘটনাস্থলে সবার আগে উপস্থিত হওয়া ব্যক্তিদের দিকে। আমরা দেখতে পাই প্রায় কাছাকাছি সময়ে তিনজন পুলিশ সদস্য বিনোদের মৃতদেহের কাছে পৌঁছান। এরা হলেন যথাক্রমে এএসআই জন (মনোজ কে. ইউ.), সিপিও বিনীশ (অভিরাম রাধাকৃষ্ণান) এবং এসসিপিও সন্দীপ (সাবুমন আবুসামাদ)। এদের ভেতর সবার আগে বিনোদের কক্ষে পৌঁছান জন, তারপর বিনীশ, এবং সবশেষে সন্দীপ।
এরপর গল্প সাসপেক্টদের ন্যারেটিভে এগোয়। সবাই ঘটনা ঘটার সময় নিজেরা অন্য জায়গায় অবস্থান করছিলেন বলে যুক্তি দেখান, অ্যালিবাই উপস্থাপন করেন। তারপর তাদের বয়ানেই আমরা তাদের সকলের সাথে বিনোদের ব্যক্তিগত বিরোধের কথা জানতে পারি। এতে করে ব্যক্তি হিসেবে বিনোদ কেমন, তার প্রতি সহকর্মীদের মনোভাব এসবও উঠে আসে। সৎ ও ঈমানদার পুলিশ অফিসার বলে যে প্রচলিত একটা কথা আছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীতে বিনোদকে আবিষ্কার করি আমরা। পুলিশের সাধারণ আচরণবিধির তোয়াক্কা সে করে না। বরং পুলিশি পেশিশক্তির প্রদর্শনের মাধ্যমে সে নিজেকে জাহির করে। নিজের সহকর্মীদের উপর খবরদারি করে, দমিয়ে রাখে। তাদের পায়ে পা দিয়ে ঝগড়ার পথ সৃষ্টি করতে চায়। তার চারিত্রের স্খলতার দিকটাও দর্শকের দৃষ্টিগোচর হয়।
এদিকে হাসপাতাল থেকে ফোনে প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে কথা বলা লোকটি ভীড় ঠেলে থানায় ঢোকে। সতীশের মতো সে-ও একজন ডিওয়াইএসপি। নাম প্রমোদ (জোজু জর্জ), এবং সে বিনোদের আইডেন্টিক্যাল টুইন। এভাবে আমরা বুঝতে পারি সিনেমার নাম কেন ইরাট্টা রাখা হয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের সামনে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, ‘একই বৃন্তের দুই ফুল’ কথাটি এই দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। মেজাজের দিক থেকে মাঝেমধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও দুই ভাই দুই মেরুর বাসিন্দা। পরবর্তীকালে তাদের পারিবারিক ইতিহাসের দিকেও আলোকপাত করা হয়, যাতে তাদের বৈপরীত্যের কারণ আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়। আমরা আরো আবিষ্কার করি যে, উভয়ের মাঝে ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক। তারা একে অপরের ছায়াও মাড়াতে চায় না। ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত কোন্দলের কারণে সন্দেহভাজনের খাতা থেকে প্রমোদের নাম কাটা যায় না। ফলে তদন্তের দায়িত্বভার থেকে যায় সতীশ এবং এসপি সবিতা সত্যন (আরিয়া সালিম)-এর হাতে।
কিন্তু শত বিরোধ থাকলেও, ভাইয়ের মৃত্যুতে ভাইয়ের হৃদয় তো কাঁদে! ফলে প্রমোদ নিজেকে যুক্ত করে তদন্তের সাথে। পুনরায় নিরীক্ষণ করে সাসপেক্টদের অ্যালিবাই। নতুন সাসপেক্টের সাথে উঠে আসে নতুন তথ্য। বিনোদের চরিত্রের নতুন দিকও উন্মোচিত হয় আমাদের সামনে। তার জন্যে খানিকটা হলেও মায়া জন্মে। হুডানিটের চিরায়ত ট্রোপ ধরে সিনেমার শেষে বিনোদের হত্যা রহস্যের উন্মোচন হয়। পরিষ্কার হয় মোটিভ। কিন্তু এ কোন সত্য আমাদের সামনে এলো? এই টুইস্টের জন্য কি আমরা প্রস্তুত ছিলাম?
আর বিনোদ তো মরে গিয়ে বেঁচে গেলো। আরো একজন তো আজন্ম চিতায় জ্বলার বন্দোবস্ত করলো সকল আশার জলাঞ্জলি করে!
এসব জানতে দেখতে হবে ইরাট্টা।
হুডানিটের সকল ট্রোপ অনুসরণ করে শেষপর্যন্ত সাসপেন্স ধরে রাখতে পারার জন্য বাহবা পাবেন পরিচালক। এক্ষেত্রে তাকে যোগ্য সহচার্য দিয়েছে বিজয়ের সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং জেকস বিজয়ের মিউজিক। সাসপেন্সের পাশাপাশি হত্যারহস্য উদঘাটনের পথে পুলিশকে কেমন প্রসিডিওর অনুসরণ করতে হয় সেটি ফুটে উঠেছে বাস্তবমুখীতার সাথে। পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর মামলা চলাকালীন সময়ে মিডিয়ার আচরণ আর রাজনীতিবিদদের আচরণের প্রতিও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এসব বিষয় সিনেমার গল্পকে আরো প্রগাঢ় হতে সহায়তা করেছে।
মালায়লাম সিনেমাপ্রেমী মাত্রই জোজু জর্জের অভিনয়দক্ষতা সম্পর্কে জানেন। এখানে দ্বৈত চরিত্র বিধায় চ্যালেঞ্জও বেশি ছিল। সেটি তিনি উতরে গেছেন অসাধারণ সাবলীলতায়। বিশেষ করে বিনোদের জীবনের শেষ কয়েক মুহুর্তে তার অভিব্যক্তি দর্শকের মনে দাগ কেটে যাবে।