বিধ্বস্ত বাগদাদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হালাকু খান। সামনে এত বই দেখে বেশ বিরক্তই হলেন তিনি, খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী? এখানে এত বই কেন?” জবাবে তার দুই শিয়া চাটুকার নাসিরুদ্দিন তুসি ও ইবনে আলকামি বলে ওঠে, “এটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার।” এটা শুনে হালাকু আরও ক্ষেপে যান, নির্দেশ দেন গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলার। তুসি ও ইবনে আলকামি তাকে এ থেকে নিবৃত্ত করতে চাইলে তিনি বিদ্রুপের কন্ঠেই সেদিন বলেছিলেন, “মুসলিমরা কি এত এত বই পড়েও শিক্ষা নেয়নি যে কী করে নিজেদের রাজ্য রক্ষা করতে হয়? যে বই তাদের নিজেদের রক্ষা করতে শেখায়নি, সে বই দিয়ে কী হবে?”
উপরের ঘটনাটুকু পড়েই যে কেউ বুঝতে পারছেন, এখানে হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন-পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞের অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে।
আসলে মুসলিম বিশ্ব তখন ত্রিমুখী আক্রমণে পর্যুদস্ত। একদিকে ক্রুসেড, একদিকে মোঙ্গল বাহিনীর, এবং আরেকদিকে গুপ্তঘাতক হাশাশিনরা। এর মাঝে সমস্যা আছে আরেকদিকে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সময় ক্রুসেড মানে ছিল কেবল মুসলিম-খ্রিস্টান লড়াই। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই লড়াইয়ের একপক্ষে মুসলিমরা থেকে গেলেও অপরপক্ষ হয়ে ওঠে আসলে এক মিত্রশক্তি; ‘খ্রিস্টান-মোঙ্গল-হাশাশিন’ ঐক্যজোট।
একদিকে শক্তিধর তিন প্রতিপক্ষ, অন্যদিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত মুসলিম বিশ্ব তখন ভুগছে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে। এমন এক পরিস্থিতিতে এক ক্রীতদাসের হাত ধরেই ডুবতে বসা মুসলিম বিশ্ব আবার নতুন করে বাঁচার আশা দেখতে শুরু করে। তিনি আর কেউ নন… সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স।
মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই সমরনায়ক, যিনি তার সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরের যুদ্ধজীবনে একটিতেও পরাজয়ের স্বাদ পাননি, সেই অসামান্য ব্যক্তিত্বকে নিয়েই কালান্তর প্রকাশনী থেকে ২০১৭ সালে বের হয়েছে ইমরান আহমাদ রচিত বই ‘দ্য প্যান্থার’।
একটি জীবনীগ্রন্থ যেভাবে এগোয়, ঠিক সেভাবেই শুরু এই বইটির। তৎকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা তুলে ধরে সেখান থেকে বাইবার্সের জন্ম, দাস হিসেবে বিক্রি, স্বীয় দক্ষতাবলে আইয়ুবি সেনাবাহিনীতে স্থান করে নেয়া- এভাবে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে গেছে বইয়ের কাহিনী।
চিরচেনা এই সজ্জার ভেতরেও ব্যতিক্রম হলো ক্ষণে ক্ষণে, ঠিক যেখানে প্রয়োজন সেখানেই অতীতের রাজ্যে পাঠককে ভ্রমণ করিয়ে এনে তার সাথে আলোচ্য বর্তমানের চমৎকার এক যোগসূত্র স্থাপন করিয়ে দেয়া। পুরো বই জুড়েই অনেকবার লেখক এই কাজটি করেছেন। আর বলতে দ্বিধা নেই, অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই এই কাজটি করে গিয়েছেন তিনি।
ইতিহাস কিংবা জীবনী বিষয়ক বইয়ের কথা শুনলেই অনেকের মাঝে একটু নাক কুঁচকানো ভাব চলে আসে। কারণ আর কিছুই না, সঠিকভাবে উপস্থাপনা করতে না পারাই এই নাক কুঁচকানো ভাবের জনক (কিংবা জননী!)। এই সঠিক উপস্থাপনের অভাবেই ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আমরা নানা সময়ে পড়েছি অত্যন্ত নীরসভাবে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জীবনী পড়তে হয়েছে অত্যন্ত নীরস কর্মজীবনের বর্ণনার মতো করে। সেদিক থেকে এই চ্যালেঞ্জটি চমৎকারভাবেই উৎরে গেছে ‘দ্য প্যান্থার’। লেখকের চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে ক্ষণিকের জন্যও বুঝতে দেবে না যে তিনি কোনো ইতিহাস বিষয়ক বই কিংবা কোনো জীবনী পড়ছেন। বরং তলোয়ারের ঝনঝনানি, কামানের গোলার আওয়াজ, রণকৌশল, ভূ-প্রাকৃতিক নানা বর্ণনা পাঠককে যেন বাস্তব এক যুদ্ধক্ষেত্রেই অবস্থান করাবে পুরোটা সময়। যে যুদ্ধক্ষেত্র সিনেমার মতোই জীবন্ত হয়ে উঠবে তার দু’চোখের সামনে।
শুরুতেই বলে নেয়া হয়েছে যে, এখানে তিনটি ফ্রন্টের সাথে লড়তে হয়েছে মুসলিম বাহিনীকে। ফলে প্রত্যেক প্রতিপক্ষ নিয়েই চমৎকার পর্যালোচনা হয়েছে বই জুড়ে। আবার সেই আলোচনাও একটানা, একপেশে নয়। যখন, যেটুকু দরকার ঠিক সেভাবেই বর্ণনা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এক জায়গায় পাঠক পাবেন ক্রুসেডের অতীত কাহিনী, আরেক জায়গায় গিয়ে বর্ণনার দাবির প্রেক্ষিতে উঠে আসবে ক্রুসেডারদের অন্তর্দ্বন্দ্বের আদ্যোপান্ত। মোঙ্গল বাহিনীর ধ্বংস, অতীত শৌর্য-বীর্যের কাহিনী যেমন এসেছে, তেমনই জায়গামতো এসেছে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়ার বর্ণনাও। একই কথা বলা যাবে গুপ্তঘাতক ওরফে হাশাশিন ওরফে অ্যাসাসিনদের বেলাতেও। বইয়ের কাহিনীর দাবি অনুযায়ীই কখনও তাদের দুর্গগুলোর বর্ণনা, আবার কখনও তাদের অতীত ইতিহাস সবিস্তারে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
এতসব চমৎকার কথা বলার পরেও একটা অতৃপ্তির কথা না বললেই নয়, সেটা হলো ছবির অভাব। পুরো বইয়ে কিলিজ তলোয়ারের ঝনঝনানি, মিদফা নামক হাতকামানের সময়োপযোগী প্রয়োগ এবং আড়ধনুর অব্যর্থ নিশানার কথা উঠে এসেছে বহুবার। এর পাশাপাশি সাম্রাজ্য বিস্তৃতির অংশ হিসেবে মানচিত্র বিষয়ক বিভিন্ন বর্ণনা উঠে এসেছে অনেকবার। পাশাপাশি যুদ্ধের সবিস্তার বর্ণনা তো আছেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সংক্রান্ত ছবিগুলোর অনুপস্থিতি পাঠক হিসেবে অন্তরে কিছুটা হলেও অতৃপ্তির জন্ম দিয়ে যায়।
সরাসরি বাইবার্সের আমলের কিলিজ, মিদফার ছবি না পাওয়া গেলেও কাছাকাছি বা পরবর্তী সময়ের এই অস্ত্রগুলোর ছবি ঠিকই ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একই কথা বলা যাবে সাম্রাজ্যের মানচিত্র ও যুদ্ধে সৈন্যসজ্জা সংক্রান্ত ম্যাপগুলোর বেলাতেও, যা অনেক সময়ই (সব সময় বলার জো নেই) ইন্টারনেটে বেশ সুন্দর করেই খুঁজে পাওয়া যায়। কালান্তর প্রকাশনীর কাছে অনুরোধ থাকবে বইটির পরবর্তী সংস্করণে এই অলঙ্করণের দিকে সদয় নজর দিতে, যা বইটিকে বর্তমান প্রজন্মের জন্য আরও উপভোগ্য করে তুলবে নিঃসন্দেহে।
২০১৭ সালে বইটি প্রথম বাজারে এলেও সর্বশেষ তৃতীয় সংস্করণটি এসেছে এই বছরের জুলাই মাসেই। প্রথম সংস্করণের চেয়ে সর্বশেষ সংস্করণটি যে আরও অনেক পরিণত সেটাও জানা যায় বইয়ের শুরুতেই থাকা ‘প্রকাশকের কথা’ অংশটি থেকে। বানান ও ভাষাগত সমৃদ্ধিসাধন, তথ্যগত ত্রুটি সংশোধন, কিছু লেখা সংযোজন-বিয়োজন, শিরোনাম-উপশিরোনাম দিয়ে লেখা পুনর্বিন্যস্তকরণ- সব মিলিয়ে বেশ বড় রকমের পরিবর্তনই এসেছে বইটিতে। আর এই পরিবর্তনগুলোই বইটিকে করে তুলেছে আরও উপভোগ্য।
কেবলমাত্র ইসলামের ইতিহাস না, আপনি যদি মানবজাতির ইতিহাস নিয়েই আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে বইটি যে আপনার জন্য অবশ্যপাঠ্য- সে কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়ই।
সংক্ষেপে বই পরিচিতি
বই: সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স – দ্য প্যান্থার
লেখক: ইমরান আহমাদ
প্রকাশক: কালান্তর প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্য: ২৭০/-
দ্য প্যান্থার বইটি দেখতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।