“I like things how they were. Why can’t we go backwards for once? Backwards, really fast, as fast as we can- really put the pedal to the metal.”
– James Halliday (Ready Player One)
চাওয়াটা এমন প্রতিটা মানুষেরই। জীবনের কোনো না কোনো বাঁকে এসে শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে, সময়ের ফ্রেমের ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করতে করতে দিন কাটে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর আশির দশকে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর জন্য তাই ২০১১ সালটা ছিল এক বড়সড় পাওয়া। আর্নেস্ট ক্লাইন প্রথমবারের মতো পরিচয় করে দিয়েছিলেন এক মঞ্চ, যেখানে একই দৃশ্যপটে ‘আয়রন জায়ান্ট’ আর ‘চাকি’-কে দেখে থতমত খেয়ে তাদের মুখ হা হয়ে যাবে। পুরনো দিনের অসাধারণ সব চরিত্র, ভিডিও গেমস আর পাঙ্ক ব্যান্ড একই বইয়ের বিভিন্ন পাতার নায়ক বনে যাবে। আশির দশকের অনন্য সব নস্টালজিয়া বইয়ের প্রতিটি পাতায় ঠেসে, সুন্দর এক গল্পের মোড়কে পুরে সবার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন ক্লাইন।
আর এই আশির দশকে পপ কালচারের বড় একজন নির্বাহক ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। স্পিলবার্গের ‘ই.টি. ফোন হোম দৃশ্য’ থেকে শুরু করে রেইডার্স অফ দ্য লস্ট আর্কের প্রখ্যাত ইন্ডিয়ানা জোনসের হ্যাট, স্পিলবার্গহীন আশির দশকের পপ কালচার যেন কল্পনাই করা সম্ভব নয়। আর তাই যে সোনার খনি হয়ে ধরা দিয়েছিল ছেলে-বুড়ো সবার কাছে ক্লাইনের ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’ বইটি, তা নির্মাণের জন্যে স্পিলবার্গের চেয়ে দক্ষ কাউকে পাওয়া সম্ভব ছিল না।
বইয়ের থেকে ছবিটা বেশ দূরের পথ ধরেই হেঁটেছে বলতে হবে। হ্যাঁ, যদিও মোটা দাগে মেলাতে কষ্ট হয় না বই এবং ছবির গল্পের ধারা। কিন্তু বই পড়ে ছবি দেখতে বসলে কিছুটা খটকা লাগতে বাধ্য। কারণ ছবির কাহিনী থেকে যা আশা করা হবে, আদতে তেমনটা হয় না। ২০৪৫ সালের ধূসর ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় ওয়েড ওয়াটস আর স্যামান্তা কুপারদের যেন তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই। ২০৪৫ এর পৃথিবীতে মানুষ বাঁচে নিজেদের অ্যাভাটারদের পিছনে, এক সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগত ‘দ্য ওয়েসিস’-এ। ছবির শুরুতেই কাহিনীর মূল চরিত্র ওয়েড পরিষ্কার করে দেয় ব্যাপারটা। তার বাক্যে বলতে গেলে, “মানুষ ওয়েসিসে আসে যেকোনো কিছু করতে, কিন্তু তারা রয়ে যায় কারণ তারা এখানে পারে যেকোনো কিছু হতে।”
কাহিনী মোটামুটি সোজা-সংক্ষিপ্ত করে শোনাতে গেলে বলতে হয়, ওয়েসিসের এই ভার্চুয়াল জগতটিকে একটি গেমের মতো করে সাজিয়ে রেখে গেছেন ওয়েসিসের স্থপতি, জেমস হ্যালিডে। তিনি ছিলেন নন্দিত গেম ডেভেলপার, কিছুটা আলাভোলা ধরনের চরিত্র, যার ছিল আশির দশকের গান, ছবি, আর্কেড গেমের উপর অগাধ জ্ঞান এবং সেগুলোর প্রতি অপরিসীম ভালবাসা।
ওয়েসিস তার সবচেয়ে বড় সৃষ্টি, যেখানে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন ওয়েসিসকে জিতে নেয়ার জন্য তিনটি চাবি। যে ব্যক্তি তিনটি চাবি খুঁজে বের করতে পারবে সবার আগে সে পাবে বিশাল অঙ্কের পুরস্কার এবং ওয়েসিস নিয়ন্ত্রণ করার পূর্ণ ক্ষমতা। তাই পুরো ওয়েসিসবাসী নামে তিনটি চাবি আর ‘ইস্টার এগস’ এর খোঁজে। যার যত বেশি জ্ঞান থাকবে আশির দশক আর হ্যালিডেকে নিয়ে সে, তত বেশি এগিয়ে থাকবে। স্বভাবতই ওয়েড বা পার্জিভাল চলন্ত উইকিপিডিয়া, এই ব্যাপারে আর তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে স্যামান্তা কুপার বা আর্টিমিস। তারা একে অন্যকে সময়ে-অসময়ে ছাপিয়ে যায় ইস্টার এগ এর খোঁজে, সামনে এগিয়ে যায় লিডার বোর্ডে।
এই জায়গায় সবচেয়ে প্রথম অমিল চোখে পড়ে বইয়ের সাথে ছবির। যেখানে প্রথম ধাঁধা সমাধান না করতে পারা পর্যন্ত ওয়েসিসে পার্জিভাল আর আর্টিমিসের দেখাই হয় না বইয়ে, সেখানে প্রায় প্রথম কিছু দৃশ্যের মধ্যেই ছবিতে ডেলোরিয়েন চালাতে চালাতে ভক্ত পার্জিভাল দেখা পেয়ে যায় ট্রনের মতো আলোকিত আকিরা মোটরযানে হেলমেটের নিচে লুকিয়ে থাকা আর্টিমিসের সাথে। বইয়ের পাতায় তাদের দুজনের রসায়ন সময় নিয়ে হলেও জমেছে বেশি, তা তাই একবাক্যে স্বীকার করে নিতেই হবে।
ছবিতে আর একটু আগালে দেখা মেলে তাদের সাথে এই যাত্রার সঙ্গী ওয়েডের বন্ধু ‘এইচ’, ছবিতে দুঃখজনকভাবে যার একমাত্র কাজ গাড়ি চালানো এবং দুই জাপানি ছেলে ‘ডাইটো’ আর ‘শটো’র। প্রধানত এই পাঁচজনের উপরে নির্ভর করছে ওয়েসিসের ভাগ্য। কারণ আইওআই কর্পোরেট বা নোলান সোরেন্টোর হাতে চলে গেলে ওয়েসিস আর সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে না। তাই ওয়েসিসকে বাঁচাতে মরিয়া পুরো গান্টার (ইস্টার এগ হান্টার) ক্ল্যান এবং তারা পাঁচজন। এদিকে আবার সোরেন্টোর ধাওয়ার গতিও কম নয়! ওয়েসিস আর আসল জীবন- কোনোখানেই সে ওয়েডদের মেরে ফেলতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এই শেষ কিভাবে হয়, মূলত সেখানেই কাহিনীর দৌড় শেষ এই ছবির।
তবে ছবিটি মূলত অসাধারণ ভিজুয়ালসের মায়ায় জড়িয়ে পুনরুজ্জীবিত করে পুরনো স্মৃতিগুলো। কী গেম, কী ছবি, কী ‘সিগনেচার’ চরিত্র- থ্রিডি পর্দায় সব যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছে, রচনা করে চলছে বিরতিহীন এক স্লাইড শোর। প্যাকম্যান, রেসিংসহ নানা পদের গেমগুলো খেলতে কয়েন হাতে ছেলে-বুড়ো সবার কত বড় বড় লাইন লাগতো আর্কেডগুলোতে সেই দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় ছবিটি!
ভয়ের স্বাদ নেবার আশায় প্রথমবার ‘দ্য শাইনিং’ দেখার অনুভূতি, স্ট্রিট ফাইটারের চরিত্র রূপে মাঠে নামা অ্যাভাটার কোনটা রেখে কোনটায় চোখ আটকানো যায় তা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্বেই ভুগতে হয়। টিনএজ মিউট্যান্ট নিনজা টার্টেল, কিংকং, গডজিলা, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ইনক্রেডিবল হাল্ক, ব্যাক টু দ্য ফিউচার, এলিয়েন, ব্যাটেলস্টার গ্যালাক্টি, বিটলজুস, ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ, স্টার ট্রেক, মরটাল কমব্যাট ইত্যাদির দৃশ্য এবং উপাদানগুলো সবই যেন একটা চলমান রিলের মাধ্যমে মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোর কথা, নস্টালজিয়ায় আর্দ্র করে মন, আর এর সাথে ডলবি সারাউন্ডে প্রতিধ্বনিত হয় আশির দশকের পপ আর পাঙ্ক হিটগুলো। সিন্থ পপ আর নিউ ওয়েভের দাপট যেন আবার নতুন করে উপভোগের সুযোগ করে দিতেই থিয়েটারে এই ছবির আগমন।
সব পপ-কালচার উপাদান, যা ছবিতে উল্লেখ করা আছে, সবার পক্ষে ধরতে পারা সম্ভব না হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এখানেই ছবিটা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। ছবিটাতে কেন যেন মনে হয়েছে নস্টালজিয়া জোর করে চাপানো হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। যারা বই পড়ে ছবিটা দেখতে এসেছে তারা যদি বইয়ের আশা না ছাড়তে পারে তাহলে ছবি ভাল না লাগার সম্ভাবনা বেশ ভালোই। কিন্তু যদি বই ভুলে শুধু ছবি হিসেবে কেউ এই ছবির মাধ্যমে আশির দশককে প্রাণভরে উপভোগ করতে চায় তাহলে তার জন্য ছবিটি প্রতীয়মান হবে এক দুর্লভ এবং মধুর ঘোর হিসেবে।
স্টিভেন স্পিলবার্গ ছবিটার পরিচালনায় ছিলেন। পরিচালক হিসেবে তার সবচেয়ে বড় দক্ষতা হচ্ছে বিশাল ক্যানভাসেও সবচেয়ে সূক্ষ্ম রেখাটি তার ছবিতে অভিক্ষিপ্ত হয় একাধিক মাত্রা নিয়ে। তিন মাস আগে তিনি বড় বড় তারকাদের নিয়ে গুরুগম্ভীর ছবি দ্য পোস্ট বের করেন। ছবিটি কয়েকটি অস্কার নমিনেশন পায়, তবে স্পিলবার্গ কিন্তু আজকের স্পিলবার্গ হননি ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ এর জন্য।তিনি আশির দশকের ‘পোস্টার চাইল্ড’, কারণ তিনি দিয়েছেন রেডি প্লেয়ার ওয়ানের মতো কিছু বিনোদন নির্ভর ছবি। তার ঝুলি ভর্তি হয়ে আছে জুরাসিক পার্ক, জস, ইন্ডিয়ানা জোনসে ধরনের ব্লকবাস্টার ছবি দিয়ে।স্পিলবার্গ নিজেও এ কথা সম্পর্কে অবগত।
স্পিলবার্গ এই ছবিটি নির্মাণের সাথে জড়িত থাকায় এবং ওয়ার্নার ব্রাদারস প্রযোজনা করায় আরেকটি যে সুবিধা পেয়েছে দর্শকেরা তা হল, ক্লাইনের বইয়ে স্থান পাওয়া বেশিরভাগ উল্লেখিত পপ-কালচার উপাদানগুলোই আমরা পর্দায় দেখতে পেয়েছি। অন্য কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলে হয়ত আমরা একই ছবিতে কখনোই লুনি টুনস, ডিসি কমিকসের চরিত্র, বিটলজুস, ট্রন আর ফ্রেডি ক্রুগার এক পর্দায় উপভোগ করতে পারতাম না। আর এই ৭১ বছর বয়সী লোকটি যে চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি, তা কে-ই বা অস্বীকার করতে পারবে?
তিনি তার গল্প বলার অনন্য গুণ দিয়েই উপস্থাপন করেছেন ছবিটি। আর জ্যাক পেনের সাথে আর্নেস্ট ক্লাইন ছবির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বে থাকায় গল্পটিতে পরিবর্তন আনা সহজ হয়েছে। বইয়ের জটিল অংশগুলো বাদ বিয়ে গল্পটিকে অনেকটাই দর্শকদের বোধগম্য করে উপস্থাপন করার চেষ্টা চোখে পড়ার মতো। একইসাথে বইয়ে যে কিছু কিছু বিষাদ জড়ানো পর্ব ছিল তা পর্দায় আনার খাতিরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া জন হিউসের ছবিগুলোর কথাও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বেশ কায়দা করেই। কিন্তু তার ছবি ছাড়া আশির দশক কল্পনা করা কঠিন, বেশ কঠিন।
এরকম কিছু অম্ল-মধুর, পাওয়া-না পাওয়া দিয়েই শেষ হয় ছবিটি। হয়ত সবার মন ভরে না, আবার অনেকে খুঁত তেমন খুঁজে পায় না। সবারই ছবিটি সমানভাবে ভাল লাগবে, তেমনটা না। কিন্তু অনেকেই ছবিটিকে ভালবেসে ফেলতে পারে, তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্মাতাদের তা হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ধারণা। ২০১১-তে এটি বেশ চমকপ্রদ একটি উপায় ছিল পুরো ভিন্ন এক পৃথিবীর প্রবেশদ্বার খুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু আজ সাত বছর পরে এর আবেদন একেবারেই ফিকে হয়ে এসেছে। তাই এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দিয়ে দর্শকদের তুষ্ট করতে বেশ বেগই পেতে হয়েছে নির্মাতাদের। আবার পুরোপুরি করতে পেরেছেন তারা এটি বলাও সম্ভব হচ্ছে না।
ছবির কলাকুশলীদের পরিবেশনা সন্তোষজনক ছিল। বিশেষ করে প্রধান চরিত্রে টাই শেরিড্যান বাদে সবাই নিজ নিজ চরিত্রে ভালই করেছেন বলা যায়। শেরিড্যানের অভিনয় একদমই দর্শক টানতে ব্যর্থ ছিল। তার চেয়ে অলিভিয়া কুককে আরও স্ক্রিন টাইম দিলে ভাল হত, যদিও তা সে বইয়ের চেয়ে বেশিই পেয়েছে এবং যথাযথ ব্যবহারই করেছে। ছবিটি ব্যাবসায়িকভাবে সফলই বলতে হবে। বছরের দ্বিতীয় বড় হিট এবং ইন্ডিয়ানা জোনস সিরিজ বাদে স্পিলবার্গের অন্যতম বড় সাফল্যগুলোর একটি।
দিন শেষে এটি একটি বড় পপ কর্ণের ব্যাগ হাতে বসে আশির সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র এবং মার্চেন্ডাইজগুলো উপভোগ করবার ছবি। ডুরান ডুরান, টুইস্টেড সিস্টারস, ডেপ্যাচে মোড, নিউ অর্ডার, আ-হা, বি জিস, টিয়ারস ফর ফিয়ারস ইত্যাদি ব্যান্ডের আশির দশকের কালজয়ী গানগুলোর তালে মাথা নাড়তে নস্টালজিয়ায় হারানোর ছবি। এই ছবি দিয়ে পপ-কালচারের উপর জ্ঞান বোধহয় তেমন একটা বাড়বে না। কিন্তু যে জ্ঞানটুকু আছে সেটাই বা এক বসায় ঝালাই করে নিতে দোষ কী!
Featured Photo: Empire Online