ভাবুন তো একবার, কেমন হবে যদি আপনার শহরের রাস্তায় আচমকাই হাঁটাচলারত এক রোবট দেখতে পান? কেমন হবে, যদি অন্যের সত্ত্বায় নিজেকে আবিষ্কার করেন? কেমন হবে, যদি আপনি চাইতেই সময় থমকে যায়? কেমন হবে, যদি নিজের বৃদ্ধ বয়সের প্রতিচ্ছবি আর প্রতিধ্বনি দেখতে আর শুনতে পান শৈশবেই? কেমন হবে, যদি এমন কোন ঝর্ণার সন্ধান পান, যা আপনার বয়স বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে দিতে পারে?
ঘটনাগুলো খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে না? এগুলোই হচ্ছে মার্সার শহরের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার লুপের কাজ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে লুপ যেকোনো অসম্ভবকেই সম্ভব করার কাজগুলো করে থাকে। এর মধ্যে অত্যাধুনিক কিংবা বলা যায়, মানব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হিউম্যানয়েড রোবট, টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ, প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব, অতীত এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।
এমন অসম্ভব ব্যাপারটাই বাস্তবতার মিশেলে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে আমাজন প্রাইমের সাই-ফাই সিরিজ টেলস ফ্রম দ্য লুপ-এ। মজার বিষয় হচ্ছে, সিরিজটি নির্মাণ হয়েছে একটি আর্টবুক থেকে। একগুচ্ছ চিত্রকর্ম থেকেই মূলত সিরিজ নির্মাণের ভাবনাটা এসেছে। সুইডিশ চিত্রশিল্পী সাইমন স্টেলেনহ্যাগের আর্টবুকের নামও ‘থিংস ফ্রম দ্য লুপ’।
১৯৫৪ সালে সুইডিশ সরকার বিশ্বের বৃহত্তম পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পরে ১৯৬৯ সালে, মেলারোনার গ্রামাঞ্চলের গভীরে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। স্থানীয় লোকেরা প্রযুক্তির এই অভাবনীয় সাফল্যকে ‘লুপ’ নামে অভিহিত করে। আর সেই লুপকে ঘিরে গড়ে উঠে একের পর এক অদ্ভুত কেচ্ছা-কাহিনী। নিজের শৈশব স্মৃতির সঙ্গে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি, রোবট এবং রহস্যময় সব যান্ত্রিক জন্তু-জানোয়ার তৈরির মাধ্যমে স্টেলেনহ্যাগ এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেন নিজের চিত্রকর্মে। সেসব চিত্রকর্মের মধ্যে এক ডিস্টোপিয়ান শহরের গল্প বলেছেন তিনি।
তার এই ডিস্টোপিয়ান চিত্রকর্মগুলো ইন্টারেনেটে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে এই চিত্রকর্মগুলোকে একত্র করে স্টেলেনহ্যাগ একটি আর্টবুক প্রকাশ করেন, যা বেস্টসেলারের মর্যাদা পায়। চিত্রকর্মগুলোর সঙ্গে মাঝে মাঝে অনেকখানি লেখাও জুড়ে দেন তিনি; যার মাধ্যমে আর্টবুকটি গ্রাফিক গল্পের বইয়ে পরিণত হয়। তার আর্টবুকের এই জনপ্রিয়তাই নাথানিয়াল হার্পার্নকে সিরিজ নির্মাণে উৎসাহ দেয়। পরে অবশ্য সাইফাই গেমস হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে টেলস ফ্রম দ্য লুপ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো প্রদেশের ছোট এক শহর মার্সার। ফলাও করে বলার মতো এমন আহামরি কিছু নেই এখানে। এমনকি বনাঞ্চলের আধিক্য থাকায় জনবসতিও একদম অল্প। তবে লুপ নামে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার আছে এ শহরে। তাই শহরের বনাঞ্চলে দেখা যায় কোনো রোবটকে হাঁটতে, কিংবা গোলাকার কোনো লোহার বস্তুকে বনের মাঝে পড়ে থাকতে। কিংবা শহরের শেষপ্রান্তে বিশালাকার ওয়াচ টাওয়ার দেখা যায়। শহরের বাসিন্দারা, এমনকি বাচ্চারা পর্যন্ত এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত। লুপ আর লুপের সঙ্গে জড়িত সবকিছুই এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গী। শহরের একমাত্র বিত্তশালী পরিবারটি লুপ পরিচালনা আর নিয়ন্ত্রণ করে। এই পরিবার আর বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার লুপকে কেন্দ্র করে আটটি ভিন্ন গল্প এক সুতোয় গেঁথে জন্ম নিয়েছে ‘টেলস ফ্রম দ্য লুপ’ সিরিজ।
লুপ
এ শহরের ছোট্ট এক মেয়ে লরেট্টা আর তার সৎ মায়ের গল্প। মেয়েটার সৎ মা আলমা কাজ করে লুপ সেন্টারে। দুজনার এই অভ্যস্ত জীবনে একদিন অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটে। আলমাকে খুঁজে পায় না লরেট্টা। যেন একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফিরে সে আলমাকে খুঁজতে বনের মধ্যে চলে যায়। ছোট্ট লরেট্টার কেন জানি মনে হয়, তার মায়ের সন্ধান পাওয়া যাবে লুপে গেলে।
ট্রান্সপোজ
ড্যানি আর জ্যাকব খুব কাছের বন্ধু। ড্যানির পরিবার লুপ চালায়, আর অন্যদিকে জ্যাকব নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। দুজন একদিন বনের মধ্যে একটা গোলাকার লোহার জিনিস পায়। জ্যাকবের পরামর্শে ড্যানি সেটার ভেতর ঢুকে। অদ্ভুত একটা আওয়াজ হয়ে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর দুজন উপলব্ধি করে যে তারা আসলে বাহ্যিকভাবে একইরকম থাকলেও ভেতরে ভেতরে একে অপরের সত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে।
স্ট্যাসিস
একদিন সমুদ্র সৈকতে গিয়ে অদ্ভুত একটা জিনিস পায় মে। বাসায় এসে নিজে নিজেই সেটা খুলে ঠিক করতে যায়। কিন্তু ভেতরের একটা টিউব নষ্ট। অন্য একদিন বনের মধ্যে ইথানের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়, আর সেখান থেকে প্রণয়। এর মধ্যে মে একদিন সেই নষ্ট টিউবটা যোগাড় করে ফেলে। তারপর ইথানকে সাথে নিয়ে সেই যন্ত্রটা চালু করতেই সময় থমকে যায়। সময়কে অতিক্রম করে মে আর ইথান স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে যন্ত্রটার বদৌলতে।
ইকো স্পিহার
রাস হচ্ছেন লুপের পরিচালক। বৃদ্ধ বয়সেও লুপ চালাতে হচ্ছে তাকে। তবে একদিন নিজের মেয়ে লরেট্টোকে ডেকে সব বুঝিয়ে দেন তিনি। স্ত্রী আর নাতি কোলের সঙ্গে বাকি জীবনটা হেসেখেলে কাটিয়ে দিতে চান রাস। একদিন কোলকে নিয়ে অদ্ভুত একটা গোলক দেখান রাস। কোল সেটার মধ্যে আওয়াজ তুললে সেই আওয়াজের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়, কিন্তু রাসের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। কোল বুঝতে পারে, রাসের মৃত্যুদিন ঘনিয়ে আসছে।
কন্ট্রোল
স্ত্রী ক্লারা আর মেয়ে বেথকে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিল এড। একদিন রাতের বেলা চোরের উপদ্রব হলে মেয়ে বেথ মারাত্মক ভয় পায়। এড এতে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে সে একটা রোবট কিনে ফেলে। কিন্তু এতে ভীষণ খেপে যায় ক্লারা। কারণ মধ্যবিত্তের জীবনযাপনে এমন উটকো ঝামেলার কোনো দরকারই ছিল না। কিন্তু এড নাছোড়বান্দা। সারারাত জেগে এই রোবটকে নিয়ে বাড়ি পাহারা দেয় সে।
প্যারালাল
গ্যাডিস লুপের একজন কর্মকর্তা। লুপের মূল গেটের কাছে থাকা ওয়াচম্যানের বুথটাই তার জন্য বরাদ্দ। রুটিন ধরে গৎবাধাঁ জীবনে সে খানিকটা হতাশ। একদিন সে অদ্ভুত একটা যন্ত্র পায় তার বাসার কাছে। অনেক চেষ্টার পর যন্ত্রটা চালু করতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বিকল হয়ে যায় যন্ত্রটা। তবে এক বিশাল পরিবর্তন হয়ে যায় এরই মধ্যে। গ্যাডিস নিজেকে ভিন্ন এক জগতে আবিষ্কার করে।
এনিমিস
ক্রিস, অ্যাডাম আর জর্জ তিন বন্ধু। জর্জ লুপের পরিচালক রাসের ছেলে। কিছুটা চাপা স্বভাবের জর্জ। বন্ধু বলতে ক্রিস আর অ্যাডাম; যদিও ওরা দুজনই তেমন একটা পাত্তা দেয় না জর্জকে। জেটিতে বসে তিনজন একদিন আড্ডা দিচ্ছিল। জেটি থেকে দূরে যে দ্বীপটা দেখা যায়, তা নিয়ে প্রচলিত অনেক কাহিনী আছে। ক্রিস আর অ্যাডামের জেদে জর্জও যায় ওদের সঙ্গে। জর্জকে জঙ্গলে একা ফেলে রেখে ফিরে আসে ক্রিস আর অ্যাডাম।
হোম
কোল তার ভাই ড্যানিকে প্রচণ্ড মিস করে। একদিন কোল একাই বের হয়ে যায় ভাইয়ের সন্ধানে। বনের মধ্যে থাকা একটা রোবট হয় তার সঙ্গী। কোল ছুটে চলে নিজের ভাইয়ের সন্ধানে।
আদতে গল্পগুলোকে আলাদা মনে হলেও একটা গল্পের সঙ্গে যে আরেকটা গল্পের যোগসূত্র আছে তা ধীরে ধীরে খুব ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে সিরিজে। সিরিজটাকে ইতোমধ্যেই হলিউড রিপোর্টার এবং অন্যান্য সমালোচকরা কাব্যিক ধারার বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার কারণও আছে অবশ্য। প্রথমত অ্যান্থলজি ধারার প্রতিটি স্বতন্ত্র গল্প হলেও একেকটি গল্পের সঙ্গে আরেকটির দারুণ মেলবন্ধন আছে। যেমনটা কবিতার পঙক্তিতে দেখা যায়। সিরিজের আবহসঙ্গীত এই কাব্যিক ধারাকে আরো শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে। প্রতিটি গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিংই সেই গল্পের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। তাই সুরের তালে তালে ছোটা এই অ্যান্থলজি সিরিজ পূর্ণতা পেয়েছে এক কাব্যিক ধারায়।
দারুণ গল্পের সাথে সাথে দুর্দান্ত অভিনয়ে গল্পগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন অভিনয়শিল্পীরাও। যদিও পরিচালকদের জন্যই ব্যাপারটা এতটা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষভাবে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর কথা না বললেই নয়। সবার প্রথমে সবচেয়ে ছোট দুই অভিনয়শিল্পীর কথা বলতে হয়। ‘লুপ’ গল্পে ছোট্ট মেয়েটার চরিত্রে অভিনয় করেছে অ্যাবি রাইডার ফোর্টসন। মার্ভেল কমিকসের অ্যান্ট ম্যান মুভিতে ক্যাসি চরিত্রে অভিনয় করা এই অ্যাবি যেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেছে এ সিরিজে; তাও এত অল্প বয়সেই। কী দারুণ অভিব্যক্তি, কী দুর্দান্ত তার অভিনয় দক্ষতা। মুগ্ধতার রেশ কাটতেই চায় না যেন!
লুপের পরিচালক রাসের নাতি কোল চরিত্রে অভিনয় করেছে ডানকান জয়নার। স্টিভেন স্পিলবার্গের প্রযোজনায় অ্যাপল টিভি প্লাসের ‘অ্যামেইজিং স্টোরিজ’ অ্যান্থলজি সিরিজের ‘দ্য রিফট’ গল্পে অভিনয় করেছে ডানকান। তবে লুপের অভিনয়ের কাছে সেটি যেন অনেকটাই ফিকে। ‘টেলস ফ্রম দ্য লুপ’ সিরিজের শুরু হয়েছে অ্যাবির অভিনয় দিয়ে, আর শেষ হয়েছে ডানকানের অভিনয়ে। বাচ্চা একটা ছেলে, অথচ কত গভীরভাবে চরিত্রে ডুবে যাবার প্রবণতা তার নিজেরই। রেবেকা হল কিংবা জোনাথন প্রাইসের মতো এত দারুণ অভিনয়শিল্পীদের পেছনে ফেলে কেন এই দুই শিশুশিল্পীর অভিনয় নিয়ে কথা বলতে হলো, তা দর্শক নিজেই বুঝতে পারবেন সিরিজ দেখে।
উল্লেখ্য, এই সিরিজটা সাই-ফাই ঘরানার হলেও অনেক জীবনবোধ দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যাণের গল্পের গভীর থাকা অকল্যাণের গল্পটাকেও তুলে ধরা হয়েছে এখানে। মূলত অকল্যাণটাই কতটা গভীরভাবে একজন মানুষ, তথা একটা পরিবার, তথা একটা শহরে কী গভীর প্রভাব ফেলতে পারে- সেই গল্পটাই যেন দেখাতে চেয়েছেন পরিচালক। প্রকৃতির নিয়মনীতিকে তুচ্ছ করে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো কতটা ভয়ানক হতে পারে, তার ক্ষুদ্র উদাহরণ বা বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন নির্মাতা।
‘টেলস ফ্রম দ্য লুপ’ একটি ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাই গল্প; যে গল্পে একটা শহর বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত; যে গল্পে সেই একই শহর আবার বিজ্ঞানের প্রভাবে প্রভাবিত; যে গল্পে একটা পরিবার বিজ্ঞানের জন্যই তাদের জীবন উৎসর্গ করে; যে গল্পে সেই একই পরিবার আবার বিজ্ঞানের কারণেই অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে।