শংকরের চৌরঙ্গী

ঘটনার পেছনের ঘটনা, গল্পের পেছনের গল্প জানা আজকাল বাহুল্য। সময় নেই কারো। উন্মত্ত ছুটে চলায় ব্যস্ত সকলে। তবুও মন খারাপের কোনো সন্ধ্যেয়, কিংবা কোনো এক তীব্র দহনের মধ্যদুপুরে যখন সমস্ত পৃথিবী অসাড় লাগে, যদি ইচ্ছে হয় মঞ্চস্থ নাটকের মঞ্চায়নের গল্প শুনতে, তবে শঙ্করের চৌরঙ্গী হতে পারে উত্তম সঙ্গী। 

বইজুড়ে লেখক কেবল আড়ালের ঘটনাগুলো সামনে এনেছেন। চাকচিক্যময় হোটেলে রোজ যেসব নাটকের মঞ্চায়ন হয়, তার আড়ালে কিছু সত্য, বাস্তবতা, কিংবা অসহায় আত্মসমর্‌পণের গল্প থাকে। যার সাক্ষী হন স্যাটা বোসের মতো রিসেপশনিস্ট। আর লেখকের মতো অকূলে কূল পাওয়া চাকরিজীবীরা। 

মনে পড়ছে কনি দ্য ওম্যানের কথা। শাহজাহান হোটেলের বারে মনোরঞ্জনের চুক্তিতে এদেশে এসেছিলেন। উন্মাদ নৃত্যে সমস্ত বার মাতিয়ে রাখা রমণীর ব্যক্তিগত জীবনের রহস্য ক্রেতাদের ভাববার বিষয় নয়। অস্থির রমণীর অন্তর্গত অদৃশ্য ঝড় এবং সাথে থাকা বামনের দৃশ্যমান উপস্থিতি ক্রেতাদের নিকট কেবল মুখরোচক ঘটনা। বামনটি কনির উপর লালায়িত পুরুষদের পাশবিকতায় ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু বামনের সাথে কনির সম্পর্ক, বা রূপ-যশ-খ্যাতির অধিকারী কনির বামনকে এত মূল্যায়নের রহস্য, যারা উপভোগ করতে আসে, তাদের ভাবায় না, বরঞ্চ বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। তাও কেবল উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হওয়ায়। কেউ জানুক বা না জানুক, কনির ইতিহাস না জানলে লেখক নিজের শাহজাহান জীবনের অনেকটা অদেখা রয়ে যেত বলে দাবি করেছেন। 

লেখক নিজেই তো একটা চলমান গল্প। অপরাধ পাড়ার মামলা-মোকাদ্দমা লড়ে যারা, তাদের সাথেই ছিল বসবাস। কিন্তু নিয়তির ফেরে চাকরি হারান। পরিচিতদের বদান্যতায় চাকরি পাননি, চাকরি যুগিয়েছিলেন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। কেইস দিতে পারেননি যাকে কখনো, কিন্তু চায়ের বদৌলতে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। ডিটেক্টিভ সাহেব বন্ধুকে যে মেয়ের স্থলে বসিয়েছিলেন, সেও আবার ফিরে এসেছিল সপ্তাহান্তেই। এভাবে বারে বারে যাওয়া আর ফিরে আসা অন্য এক আলেখ্য। কিন্ত ম্যানেজারের বদান্যতায় পার পেয়ে যান লেখক, মনের ক্যানভাসে লিখতে থাকেন শাহজাহান হোটেলের গল্প। 

প্রচ্ছদ; Image: Goodreads

শাহজাহানের ইতিহাসে নারী বারবণিতার ইতিহাস খুঁজতে আসেন এক ডাক্তার। ‘WHO’-র হয়ে কাজ করতে আসেন তিনি। কিন্তু যেকোনো মূল্যে শাহজাহান হোটেলে থাকা চাই তার, কর্মচারীর রুমে হলেও। বিশেষ কোনো স্মৃতি কিংবা জীবনালেখ্য খোঁজার দায় ছিল কি তার? কনির মতো অসংখ্য বারবণিতা শাহজাহান মাতাতে এসেছিল। প্রত্যেকেরই ছিল ভিন্ন গল্প। কেউ কেউ বারবণিতার জীবন ছাড়তে চেয়েছিল, সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিল। আর তার বাধ্যতামূলক শাস্তি দিতে কার্পণ্য করেনি সমাজ।

ইনসাফি সমাজ পুরুষটিকেও ছাড় দেয়নি। বারবণিতাকে গ্রহণের সাহস দেখাতে না পারা পুরুষ সমাজ জানুক, এই ব্যতিক্রমী সাহস দেখান পুরুষের পরিণাম কী। সমস্ত অসম্মানের ঘানি টানিয়ে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল। জীবন দিয়ে মূল্য দিয়েছিল উভয়ে, কিন্তু রেখে যাওয়া পাপের (!) ফসল সন্তানের গল্প কি স্বাভাবিক হতে পারে? তার সাধারণ (কিংবা অসাধারণ) পরিণতিও লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন আকস্মিক গল্পে। 

কবরী গুহ আত্মাহুতি দিয়ে সমাজকে কী যেন বলতে চেয়েছিল! বা সেক্রেটারির কথাই বলি, হিংসুটেপনা আর অধিকারের জোরে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা মহিলাটি! ভালোবেসেও ভালোবাসার কাছে নিজেকে সঁপে না দেওয়া রমনীর পিছুটানের গল্প, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা, সুরের মূর্ছনায় জীবন কাটান লোকটা। কিংবা স্যাটা বোস নিজেই, যে নিয়মিত বোর্ডার থেকে শুরু করে শিল্পপতি, সমাজসেবক, ব্যবসায়ী, প্রত্যেকের হাড়ির খবর বুঝে ফেলেছেন, তারও একটা গল্প ছিল। আলগোছে লুকানো।

সে গল্পটা, কিংবা ম্যানেজারের মদ্যপ জীবনের রহস্য উন্মোচিত হয় বইয়ের পাতায় পাতায়। শাহজাহানের মতো হোটেল পরিচালনায় যে ন্যূনতম কুণ্ঠিত নয়, সমস্তটা জুড়ে যার সহজ পদচারণা, তার জীবনেও অসংখ্য কানাগলি। ক্ষতবিক্ষত হওয়ার, ব্যর্থতার, না পাওয়ার চরম বেদনামুখরতার। তাই মধ্যরাতে শহরের পথে, কিংবা মদের গেলাসে থাকে সান্ত্বনার অন্বেষা। 

শংকর; ছবি: দ্য হিন্দু

এলাহী হোটেলের সাধারণ কর্মচারীদেরও জীবন থাকে। তাদের মধ্যে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা থাকে, সে পিতাকে ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়। কন্যার সম্মান বা অসম্মানজনক পরিণয় ঘটে। থাকে এক-দু’জন সংস্কারাবদ্ধ প্রাচীন কর্মচারী, যারা সময়াবর্তে আসা পরিবর্তনের উপর চড়াও হয় সবসময়। থাকে বারে বাদ্য বাজানো গুণী, তার শিল্পসত্তার মূল্যায়ন হয় না। সেসব তিনি চানও না, কেবল সুরের মুর্ছনায় পৌঁছে যান জীবনসায়াহ্নে। 

পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চের মঞ্চস্থ অভিনয়ের চেয়ে মঞ্চায়নের কানাগলির রহস্য যাদের জানার, তারা বইটা পড়ে নিরাশ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হোটেলকেন্দ্রিক চরিত্রগুলোর চিত্রায়নে লেখক যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। 

বইয়ের নাম: চৌরঙ্গী || লেখকের নাম: শংকর

প্রকাশনী: দে’জ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থল: রকমারি

This article is in Bangla language. This is a classic novel written by Shankar, published by Dey’s Publishing.

Featured Image: Sirajam Munir Shraban

RB-AS/SM

Related Articles

Exit mobile version