জীবন আমার বোন: এক নতুন জীবনবোধের আলোয় মুক্তিযুদ্ধ দর্শন

বাংলাদেশের শক্তিমান গদ্যশিল্পীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলে তাতে নিঃসন্দেহে থাকবেন কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক (১৬ নভেম্বর, ১৯৪১-২১ জুলাই, ২০০৮)। অথচ নামটি বাংলাদেশের পাঠকমহলে প্রায় অপরিচিত। কারণ অবশ্য অনুমিত। ৬৬ বছরের জীবনব্যাপ্তিতে মাহমুদুল হক লিখেছেন সর্বসাকুল্যে এক দশক। এই অল্প সময়ে পরিমিত সংখ্যক রচনা দিয়েই তিনি স্থান করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। আজ কথা বলব তার রচিত অনবদ্য এক উপন্যাস ‘জীবন আমার বোন’ নিয়ে।

জীবন আমার বোন; Image Credit: Author

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে, সাহিত্য প্রকাশ থেকে। এটি লেখকের তৃতীয় উপন্যাস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগসন্ধিক্ষণের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে এ উপন্যাসে। পটভূমি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের ঢাকা শহর। উপন্যাস এগিয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহেদুল কবির খোকার বয়ানে। আর আছে খোকার ছোট বোন রঞ্জু, বন্ধু মুরাদ-ইয়াসিন-রহমান, মুরাদের বড় বোন লুলু চৌধুরী, খোকার পরিচিত রাজীব ভাই আর তার দুই স্ত্রী।

১ মার্চ প্রেসিডেন্টের ভাষণে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। যতদিন যেতে থাকে, বাড়তে থাকে উত্তেজনা। সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে খোকার বয়সী তরুণেরা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের জল্পনা-কল্পনা, কাঠের ডামি রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজ। সমান্তরালে চলতে থাকে রঞ্জু-খোকার পারিবারিক জীবন। এর মধ্যেই ঘটে যায় আসন্ন যুদ্ধ পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক সব ঘটনাবলী- অসহযোগ আন্দোলন, জাহাজে করে চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যের আগমন, নতুন গভর্নর টিক্কা খান, ৭ই মার্চের ভাষণ, জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গোলাগুলি, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় চলতে থাকা মিছিল-মিটিং-জনসভা। সমগ্র দেশ যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে।

খোকার দৃষ্টি দিয়ে আমরা দেখি বারুদের স্তুপে পরিণত হওয়া ঢাকা শহরকে, যার সলতেয় স্ফুলিঙ্গ লাগে ২৫ মার্চ কালরাতে। গণহত্যা শেষে ২৭ মার্চ ঠিক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তেই শেষ হয় উপন্যাস। যদিও শেষ দু’পাতায় বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধ শেষে চরিত্রগুলোর পরিণতি। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ গল্প মনে হলেও, চেতনাপ্রবাহরীতি পদ্ধতিতে রচিত উপন্যাসটির গভীরে প্রথিত রয়েছে এক অনবদ্য জীবনদর্শন। ‘জীবন আমার বোন’ তাই মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস হয়েও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস নয়। বরং দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে এটি হয়ে যায় মানবজাতির চিরন্তন স্বাধীনতার এক আখ্যান।

ঔপন্যাসিক মুখ্য চরিত্র হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন খোকাকে, মুক্তিযোদ্ধা মুরাদ বা ইয়াসিনকে নয়। কিন্তু কেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ঘরকুনো খোকা উপন্যাসের নায়ক? চরিত্রের গভীরে উঁকি দিলেই তার উত্তর পাওয়া যায়। খোকা গভীরভাবে জীবনসচেতন এবং বিশ্বাত্মবোধে উজ্জীবিত একজন আধুনিক মানুষ। সে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় নয়, কিন্তু প্রবল রাজনীতি সচেতন। উপন্যাস পড়তে শুরু করলেই খোকার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে পাঠক ধারণা পেতে থাকবেন। বোনের সাথে খুনসুটির ভেতর অবলীলায় তার কথায় চলে আসে আমেরিকান জিপসি জিন ডিক্সন, ‘বোক্কাচ্চো ‘৭০’ চলচ্চিত্রের অনিতা, গোয়েন্দা গল্প ‘মার্ডার ইন দ্য বুগেনভেলিয়া’, আইরিশ উপন্যাস ‘ইউলিসিস’, ‘দ্য টিন ড্রাম’ চলচ্চিত্রের অস্কার কিংবা ফ্রাঞ্জ কাফকা সৃষ্ট চরিত্র গ্রেগর সামসার কথা।

প্রচলিত দর্শনের বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধী এই চরিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে মুক্তিযুদ্ধকে। খোকার বয়সী তরুণেরা যখন বিপ্লবে রক্ত দেওয়ার নেশায় মত্ত; খোকার মনে তখন ঝড় ওঠে, দেশ আগে না মানুষ আগে? দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন আর জনগণের সার্বিক উন্নতিসাধন, এক খাতে প্রবাহিত হয়নি খোকার ভাবনায়। দেশের জন্য প্রাণদান খোকার চোখে হয়ে যায় প্রাচীনকালে দেবতার উদ্দেশে দেওয়া নরবলির আধুনিক রূপ।

“দেব না। এক মুহূর্তে ব্যারিকেড হয়ে যায় খোকা; আমরা রক্ত দিতে শিখিনি। যে দেশ রক্ত দাও ব’লে দুশো বছর ধ’রে চিৎকার করে চলেছে আমাদের কেউ নয় সে, দেশমাতৃকা তুই নস!”

ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক (১৬ নভেম্বর, ১৯৪১-২১ জুলাই, ২০০৮); Source: আর্টস-bdnews24.com
ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক (১৬ নভেম্বর, ১৯৪১-২১ জুলাই, ২০০৮); Image Source: bdnews24

ভিন্নাদর্শের হওয়ায় স্বভাবতই খোকার সঙ্গে তর্ক বাঁধে বন্ধুদের। মুরাদ প্রশ্ন করে,

“‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৃত্যু আর আমাদের কয়েকজনের বেঁচে থাকা’ না ‘আমাদের কয়েকজনের মৃত্যু সাড়ে সাত কোটি মানুষের বেঁচে থাকা’ কোনটা কাম্য?”

রহমান, ইয়াসিনকে দেখা যায় প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক খবর রাখতে। তারা প্রত্যেকেই আসন্ন যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত। দেশ সম্পর্কে, স্বাধীনতা সম্পর্কে খোকার ধারণার তারা বিরোধিতা করে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের নিজেদের ধারণাও স্পষ্ট না। তারা হিসাব কষে, A-তে আইয়ুব খান পাকিস্তানের শুরু হলে Z-এ জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের সমাপ্তি। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই তরুণদের দেখা যায় ‘স্বাধীনতা’ নামে এক অলীক কল্পনার জগতে বাস করতে, যেখানে যুদ্ধ শেষে জীবনের কাছে যার যার আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ণতা পাবে। যথারীতি তারা প্রত্যেকেই যুদ্ধে যায়। কিন্তু তিনজনের পরিণতি তিন খাতে প্রবাহিত হয়- রহমান শহীদ, ইয়াসিন পঙ্গু, মুরাদ বিখ্যাত গেরিলা কমান্ডার। অর্থাৎ যুদ্ধ যেন পাশার দান; একই দলভুক্ত হয়েও যুদ্ধশেষে কে কী ফল লাভ করবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।

যুদ্ধপরবর্তী জীবনের ফ্যান্টাসি নিম্নবিত্তের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তারা স্বপ্ন দেখে শ্রেণি উত্তরণ আর অর্থনৈতিক মুক্তির। খোকার বাড়ির কাজের মেয়ে ময়নাকে নিতে আসা তার শ্রমিক বাবাকে বলতে শোনা যায়,

“আল্লা করুক, জয়বাংলা যদি হয়েই যায় তাহলে আর মেয়েটাকে ঝিগিরি করায় কে!”

আরেক শ্রেণিকে দেখা যায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে নিজেদের স্থূল আকাঙ্ক্ষা পূরণে চেষ্টারত। মুরাদের বড় বোন লুলু চৌধুরী বীমা কোম্পানির চাকুরে। সে চায়, দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে মূলধন করে নিজের কোম্পানির লাভ করতে। মুরাদ তার দেশ নিয়ে লেখা কবিতার সংকলন বিক্রি করার চেষ্টা করে মানুষের আবেগ ভাঙিয়ে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ চিত্র নির্ধারিত হতে থাকে।

সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল খোকা। যে কিনা লেখকেরই মানসসন্তান। লেখক অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন জীবনকে, প্রিয়জনকে, স্বদেশকে। তিনিও চান স্বাধীনতা। রাতারাতি বিপ্লবে শাসক পরিবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু জনমানুষের সার্বিক উন্নতিসাধন কতটা হয়, তা নিয়ে ঔপন্যাসিক সন্দেহবান। খোকার মুখে তাই শোনা যায় রূপান্তরের ঘোষণা- দীর্ঘকালীন এক মানসিক রূপান্তর। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রেও কি আমরা এই মানসিক রূপান্তরের রূপকচিত্রই দেখতে পাই না? এ রূপান্তর পশুর বিরুদ্ধে পশু হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা নয়; পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবতার লড়াই।

মাত্র ২৩ বছর আগেই, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছিল এ দেশ। দুই যুগ না কাটতেই জাতি সেই এক লক্ষ্যে আরেকটি বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। খোকা তাই যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু এমন এক দেশকালের সাক্ষী সে, যুদ্ধ যার অনিবার্য গন্তব্য। তাকে মুখোমুখি হতেই হয় বাস্তবতার সাথে। যুদ্ধের পাশবিকতার মাঝে খোকা তার গন্তব্য খুঁজে পায় না। কেবল প্রিয়জনকে আগলে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে। তার চেতনাপ্রবাহ শৈশবের স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায়, যে শৈশব জুড়ে ছিল রঞ্জু আর তার মৃত দুই বোন। মাতৃহীন খোকার কাছে জীবন মানেই তার ভালোবাসার বোনেরা। জীবন তার বোন।

উপন্যাসে ব্যক্তি মাহমুদুল হক প্রবলভাবে উপস্থিত খোকার অন্তরালে। সাতচল্লিশের দেশভাগে জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত থেকে সপরিবারে উন্মূলিত হয়েছিলেন তিনি। তার ‘কালো বরফ’ (১৯৭৭) উপন্যাসে আছে সে আখ্যান। নতুন দেশে থিতু হতে না হতেই আরেকটি রাজনৈতিক পালাবদল উপস্থিত। লেখক তাই সহজাতভাবেই নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়েন। তাছাড়া ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি লেখার সময় লেখক ইতোমধ্যেই ‘৭৫ পরবর্তী নৃশংসতা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অবাধ লুণ্ঠনের চাক্ষুষ সাক্ষী। উপন্যাসে চাওয়া রূপান্তরের প্রয়োজন তখন সত্যিই অনুভূত হয়।

তরুণ মাহমুদুল হক, দেশভাগে যাকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল নিজ জন্মভূমি; Source: আর্টস-bdnews24.com
তরুণ মাহমুদুল হক, দেশভাগে যাকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল নিজ জন্মভূমি; Image Source: bdnews24

বরাবরের মতো এ উপন্যাসেও বিশ শতকের আধুনিক গদ্যভাষা ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেনন মাহমুদুল হক। যুক্তি দিয়ে একের পর এক রচনা করেছেন বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ। তার অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এখানেও পরিচ্ছেদ বিভাজনে কৌশল দেখা যায়- একটি পরিচ্ছেদে খোকা বাড়ি থাকলে পরের পরিচ্ছেদে থাকে বাড়ির বাইরে। চরিত্রচিত্রণ ও কাহিনীবিন্যাসে রেখেছেন পরিমিতির পরিচয়। ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ জানা থাকা সত্ত্বেও তাই পাঠকের কাছে উপন্যাসের আবেদনে কমতি পড়ে না। সর্বোপরি প্রথাগত সব চেতনা ও বিশ্বাসের বিপরীতে উপন্যাসটি উপস্থাপন করে নতুন এক দর্শন। যে দর্শন বাস্তবিকই আমাদের তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত করে। নতুন করে ভাবতে শেখায় দেশ নিয়ে, দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে।

বইটি সংগ্রহ করতে

বই: জীবন আমার বোন
লেখক: মাহমুদুল হক
প্রকাশনা সংস্থা: সাহিত্য প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৬
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৫৮
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা

This article is in Bangla. It is a review of the book 'Jibon Amar Bon' by writer Mahmudul Haque.

Featured Image Credit: Naholy Akashlina.

Related Articles

Exit mobile version