কিছু কিছু মানুষ আছে বাসায় মেহমান এলে আপ্যায়ন করতে খুব পছন্দ করে। গাঁটের পয়সা যতই খরচ হোক, অতিথি যতই অদরকারি হোক আপ্যায়ন করতে পারলে তারা মানসিকভাবে খুবই তৃপ্ত হন। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের পাতা উল্টাতে পছন্দ করে। বই যতই পুরাতন হোক, দেখতে যতই ছেড়াফাড়া লাগুক, বই ঘাটাঘাটি করতে পারলেই তার মনের তৃপ্তি আসে। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কারিকুরি করতে পছন্দ করে। হাতে একটা ক্যালকুলেটর এলো, এর নাড়িভুঁড়ি খুলে আবার আগের মতো করে লাগিয়ে ফেললো। একটা মোটর, একটা পাখা, একটা সুইচ আর কিছু তার যোগাড় করে বানিয়ে ফেললো একটা ফ্যান। একটা সেন্সর একটা এই একটা ঐ মিলিয়ে বানিয়ে ফেললো সায়েন্স ফেয়ারের দারুণ এক প্রজেক্ট।
এরকমই একজন ব্যক্তি হলেন ওয়াল্টার হোয়াইট। পেশায় রসায়নের শিক্ষক। বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে। রাসায়নিক দ্রব্যাদি, রাসায়নিক যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ে খেলা করে তিনি মানসিকভাবে তৃপ্ত হন।
যারা রসায়ন পড়েছেন কিংবা অন্তত যারা টুকটাক ধারণা রাখেন তারা হয়তো জানবেন রাসায়নিক উপাদানগুলো বিভিন্ন উপায়ে পাওয়া যায়। অর্থাৎ একই জিনিস পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়ার মাধ্যমে। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন তাপ, ভিন্ন চাপ, ভিন্ন প্রভাবক উপাদান দিয়ে একই জিনিস বের করে আনা যায়। জনাব হোয়াইট এই কাজে খুবই পারদর্শী। প্রচলিত ফর্মুলাকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব ফর্মুলাতে মূল্যবান উপাদান তৈরি করা তার কাছে ছেলেখেলা। তিনিই ব্রেকিং ব্যাড সিরিজের প্রধান চরিত্র।
কোকেইন, মেথেমফেটামাইন ইত্যাদি অনেক নেশাজাতীয় দ্রব্য আছে। বলে না দিলেও হবে, এদের প্রায় সবগুলোকেই রাসায়নিক উপায়ে প্রস্তুত করতে হয়। ওয়াল্টার হোয়াইট একজন ভালো মনের মানুষ। কখনো মাদক সেবন করেন না। কিন্তু কোনো একভাবে মাদক দ্রব্য তৈরি করাতে যুক্ত হয়ে যান। কেন, কীভাবে যুক্ত হন তার পেছনে কারণ আছে। শুরুর পর্বেই তা দেখা যায়।
রসায়ন শাস্ত্রে উপাদানের বিশুদ্ধতা বলে একটা বিষয় আছে। যেমন পানি, আমরা যে পানি পান করি তা শতভাগ বিশুদ্ধ নয়। এতে নানা ধরনের উপাদান মিশ্রিত আছে। মিনারেল ওয়াটার নামে যে পানিগুলো বোতলজাত আকারে পাওয়া যায় সেগুলো কিছুটা ভালো। রসায়নের ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্টের জন্য ডিসটিল্ড ওয়াটার নামে এক বিশেষ পানি ব্যবহার করা হয়। এই পানিতে H₂O ছাড়া বাকি যা আছে সব ছেকে ফেলা হয়। সে হিসেবে এই পানি ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ। বাকি যত পানি আছে তা এর নীচে।
মাদকদ্রব্যের বেলাতেও এই কথা প্রযোজ্য। যে মাদক যত বিশুদ্ধ হবে তার তৃপ্তিদানের ক্ষমতা তত বেশি হবে, তত নিখুঁত হবে। রসায়নের জিনিয়াস জনাব হোয়াইট যখন মাদক রাজ্যে প্রবেশ করলেন তখন নিজের ফর্মুলায় মাদক তৈরি করতে লাগলেন। বাজারে প্রচলিত মাদক যেখানে শতকরা ৬০ ভাগ বিশুদ্ধ সেখানে তার ফর্মুলায় তৈরি মাদক ৯৬ ভাগ বিশুদ্ধ। পুরো মাদক রাজ্যে আলাদা এক ফ্লেভার চলে এলো। ক’দিনের মাঝেই এটি হয়ে গেল আলাদা এক ব্র্যান্ড।
যেহেতু এই ফর্মুলা তার নিজস্ব, তাই অন্য কেউই এটি প্রস্তুত করতে পারে না। ফলে চারদিকে বাড়তে থাকে শত্রু। এই ব্যক্তিকে সরিয়ে দিতে পারলে পরিষ্কার হয়ে যাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যবসার কাটা। আবার এখানে কথাও আছে। যেহেতু তার বানানো পণ্য সবার সেরা, তার মানে তাকে হাত করতে পারলে পাওয়া যাবে লাভজনক এক রাজ্য। এক অংশ তাকে শেষ করতে চায় আরেক অংশ তাকে পেতে চায়। লেগে যায় অদৃশ্য যুদ্ধ। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের কথা তো মনে আছে। আমেরিকা যখন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌ-বহর পাঠায় তখন সোভিয়েত ইউনিয়নও আরো শক্তিশালী নৌ-বহর পাঠিয়ে দেয়। দুটিই নিউক্লিয়ার সজ্জায় সজ্জিত। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বেধে যাচ্ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের।
এখানেও এমনই ব্যাপার। অল্প অল্প করে ঘটনা এমন অবস্থায় যেতে থাকে যে চোখ তুলে তাকাবার সময় হয় না। কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেড়িয়ে আসে সাপ। সাপ খুড়তে গেলে দেখা যায় বেরিয়ে আসছে কুমির। এতটুকুতেই সফল একটা সিরিজ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু না। কুমির বের হতেই চলে আসে আরো বড় দানব। একটু একটু করে বিশাল থেকে বিশালতর হতে থাকে কাহিনী। প্রত্যেকটা পর্ব টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ।
এমন সিরিজ মনে হয় আর কখনো হয়নি। প্রথম সিজনটা চমৎকার হয়েছে, দ্বিতীয়টা আরো চমৎকার হয়েছে, তৃতীয়টা এর চেয়েও চমৎকার হয়েছে, চতুর্থটা তৃতীয়টার চেয়েও চমৎকার হয়েছে, পঞ্চমটা ছাড়িয়ে গেছে চতুর্থটাকে। সামগ্রিক সিজন তো ভালো হয়েছেই, পাশাপাশি প্রত্যেকটি পর্বও ভালো হয়েছে।
আপাত অসম্ভব কাজগুলো করাতে সাধারণত সুপারহিরো ধাঁচের চরিত্রের প্রয়োজন হয়। এই সিরিজে এমন অনেক বিষয় আছে সেগুলো সাধারণ মানুষ করতে পারবে না। সুপারহিরোর পক্ষেই শুধু এ ধরনের কর্মকাণ্ড করা। কিন্তু জনাব হোয়াইট তার মেধা ব্যবহার করে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এসব কাজ করে দেখিয়েছেন। তিনি সিক্স প্যাক সম্পন্ন কোনো পুরুষ কিংবা হ্যান্ডসাম কোনো নায়ক নন। পড়তি বয়সের এক আধবুড়ো। তার মাধ্যমে যে যে সুপারহিরোয়িক, সুপারঅসাম কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে তার কোনো জবাব নেই।
কেউ যখন জিনিয়াস হয়, অনেক দিক থেকেই হয়। তিনিও তা। রসায়নই শুধু নয়, অন্যান্য বিষয়গুলোও ঠাণ্ডা মাথায় সুচারুভাবে সামাল দিতে ওস্তাদ তিনি। কখনো মাদকের সাথে জড়িত না থেকেও কীভাবে ড্রাগ লিডার হিসেবে সকলকে লিড করতে হয় তিনি তা সহজেই আয়ত্ব করে নেন। কীভাবে কোন পথে গেলে তার শত্রু নাশ হবে তিনি তা খুবই ভালো বুঝতে পারেন। কীভাবে কার কাছে গেলে তার সমস্যার সমাধান হবে তা বের করতে তার সময় লাগে না। কীভাবে উদ্ভূত বিপদকে সামাল দেয়া যাবে এবং সামলিয়ে উৎরে আসা যাবে তা তার চেয়ে কেউ ভালো জানে না।
এ গেলো পুরো সিরিজের মাত্র একটি চরিত্র। সমগ্র সিরিজ নিয়ে ভালোভাবে লিখতে গেলে মাস ফুরিয়ে যাবে। সিরিজের অন্যান্য চরিত্রগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে নিয়েও আলাদা করে প্রবন্ধ লেখা যাবে। যেমন জনাব হোয়াইটের কাজের সহকারী জেসি পিংকম্যান, স্ত্রী স্কাইলার হোয়াইট, শ্যালিকার স্বামী শ্রেডার, আইনগত সহায়তাকারী সল গুডম্যান, মাদক সম্রাট গুস্তাভো ফ্রিং, সকল কাজের কাজী মাইক আরমেনট্রাউট ইত্যাদি অনেকে। সম্ভব হলে পরবর্তীতে তাদের নিয়ে আলোচনা করা হবে।
যেভাবে সুন্দর করে চরিত্র নির্মাণ করেছে আর কাহিনী এগিয়ে নিয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না। একইসাথে কোনো সিরিজের সব দিক নিখুঁত হয় না। কিন্তু এটি হয়েছে।
সব দিক মিলিয়ে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক সিরিজ হলো এই ব্রেকিং ব্যাড। যারা থ্রিল পছন্দ করেন তারা এখনই নামিয়ে নিন ব্রেকিং ব্যাড, যারা টুইস্ট পছন্দ করেন এখনই দেখতে বসে যান ব্রেকিং ব্যাড, যারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে তৈরি করা কাহিনী পছন্দ করেন তারা এখনই শুরু করে দিন ব্রেকিং ব্যাড।
হ্যাপি ওয়াচিং।
ফিচার ছবি: Wallpaper Cave