ব্রিটিশ ফিকশনের সর্বকালের সেরা কনসাল্টিং ডিটেকটিভ কে? খ্যাতির দিক থেকে চিন্তা করলে, অবশ্যই, শার্লক হোমস ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু যদি মোট সলভ করা কেসের কথা ধরা হয়, তাহলে উঠে আসবে আরেকটি নাম- সেক্সটন ব্লেক। শার্লক হোমসকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে দেবে সে। কিন্তু তারপরও, সেক্সটন ব্লেককে বলা হয়ে থাকে ‘দ্য পুওর ম্যান’স শার্লক হোমস’। অথবা সোজা বাংলায়, গরিবের শার্লক হোমস।
গরিবের অমুক, গরিবের তমুক কনসেপ্টের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, সেক্সটন ব্লেককে গরিবের শার্লক হোমস বলার কারণ এই চরিত্রটি গড়ে তোলা হয়েছে সবার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসেরই আদলে, এবং ‘নক অফ’ এর নামে ঝেড়ে দেয়া হয়েছে শার্লক হোমস সিরিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। সেক্সটন ব্লেক দেখতে শুনতে হাবেভাবে অনেকটাই যেন শার্লক হোমসের মতো। শার্লক হোমসের আস্তানা যেমন ছিল লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে, একটা লম্বা সময় ধরে সেক্সটন ব্লেকেরও তাই। শার্লক হোমসের ঘর দেখাশোনা করতেন মিসেস হাডসন আর সেক্সটন ব্লেকের মিসেস বারডেল। শার্লক হোমসের সহকারী হিসেবে ছিল ড. ওয়াটসন আর সেক্সটন ব্লেকের সহকারী, শুরু থেকে না হলেও, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে, অনাথ ছেলে টিঙ্কার।
তাছাড়া সেক্সটন ব্লেকের প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের আপামর গোয়েন্দাদের অদ্বিতীয় গুরু, শার্লক হোমসের নাম। কথিত রয়েছে যে, শার্লক হোমসের বিকল্প হিসেবেই বাজারে আনা হয় সেক্সটন ব্লেককে।
শার্লক হোমসের তুমুল জনপ্রিয়তায় ত্যক্তবিরক্ত স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ১৮৯৩ সালে ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ কাহিনিতে শার্লক হোমসকে রাইখেনবার্গ প্রপাত থেকে ফেলে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, আর লিখবেন না এই চরিত্রটিকে নিয়ে। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীতে বুঁদ হয়ে থাকা ব্রিটিশ পাঠকদের তো সময় কাটানোর অন্য রসদ চাই। সে কারণেই, সে বছরের ২০ ডিসেম্বর হ্যাল মেরিডেথ ছদ্মনামে হ্যারি ব্লাইথের লেখা ‘দ্য মিসিং মিলিয়নিয়ার’ কাহিনিটি প্রকাশিত হয় ‘দ্য হাফপেনি মার্ভেল’ পত্রিকায়, এবং এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় সেক্সটন ব্লেকের।
শুরুর দিকে কিন্তু সেক্সটন ব্লেকও পেয়েছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এতটাই যে, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও বেকার স্ট্রিটের গোয়েন্দা বলতে লোকে সেক্সটন ব্লেককেই বুঝত। কেননা মহাকাল কোয়ালিটিকে স্মরণে রাখলেও, সমসাময়িক কালে কোয়ান্টিটিরই জয় হয়। আর সেই কোয়ান্টিটির দিক থেকে সেক্সটন ব্লেকের যে কোনো তুলনাই হয় না!
১৮৯৩ সালে প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ‘সেক্সটন ব্লেক অ্যান্ড দ্য ডেমন গড’ পর্যন্ত ৮৫ বছরে সেক্সটন ব্লেককে নিয়ে রচিত আখ্যানের সংখ্যা কয়টি, জানেন? প্রায় ৪,৫০০ এর মতো! অবশ্য একজন লেখকই লেখেননি এর সবগুলো। সেক্সটন ব্লেককে নিয়ে লিখেছেন ২০০-র মতো লেখক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এডউই সার্লস ব্রুকস, জর্জ হ্যামিল্টন টিড, উইলিয়াম মারে গ্রেডন, ব্রায়ান ও’নোলান (ফ্ল্যান ও’ব্রায়েন), জ্যাক ট্রেভর স্টোরি, জন ক্রিসি, মাইকেল মুরকক প্রমুখ।
সব মিলিয়ে সেক্সটন ব্লেক হলো ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রকাশিত চরিত্র। প্রথম দুইটি স্থান রয়েছে নিক কার্টার ও ডিক্সন হকের দখলে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এখন ডিক্সন হককে নিয়ে একটি উইকিপিডিয়া এন্ট্রি পর্যন্ত নেই!
এদিকে সেক্সটন ব্লেকের অস্তিত্ব কেবল বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখে চোখ চকচক করে উঠেছে অনেকেরই। তারা চেয়েছে যেকোনোভাবে হোক, সেক্সটন ব্লেককে কাজে লাগিয়ে অর্থোপার্জন করতে হবে। তাই একে একে সেক্সটন ব্লেককে দেখা গেছে কমিক স্ট্রিপ, টিভি ও রেডিও এপিসোড, মঞ্চ নাটক, এমনকি বড় পর্দায়ও।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সেক্সটন ব্লেককে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়েছে। নানাবিধ অবতারে দেখা গেছে তাকে। কেননা একে তো তার স্রষ্টা হিসেবে ছিল বহু লেখক, তার উপর আবার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাকে আধুনিকায়নেরও একটা ব্যাপার ছিল।
সেক্সটন ব্লেকের ক্যারিয়ার শুরু হয় তার চেয়ে বয়সে বড় ও বুদ্ধিমান এক ফরাসি গোয়েন্দা, জুলস জেরভেইসকে সঙ্গী করে। এই জুটি একত্রে কয়েকটি রহস্যের সমাধান করার পর জেরভেইস অবসর নেয়। তারপর ব্লেক একা একাই, কিংবা র্যান্ডম কোনো সহকারীকে নিয়ে, কাজ করতে শুরু করে। ১৮৯০-র দশকে ব্লেককে গড়ে তোলা হয় চিরাচরিত ভিক্টোরিয়ান গোয়েন্দাদের আদলে।
এরপর, পনের বছর বা তারও বেশি সময় ধরে, সেক্সটন ব্লেকের উপর খুব বেশি প্রভাব দেখা যায় শার্লক হোমসের। ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ছিল সেক্সটন ব্লেকের স্বর্ণযুগ। সেই সময়ে কাহিনিতে অ্যাকশনের তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়, ফলে সেগুলো হয়ে উঠে দারুণ মনোরঞ্জক। এই স্বর্ণযুগেই তার সঙ্গী হিসেবে দেখা যায় টিঙ্কারকে।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অবশ্য সেক্সটন ব্লেক কিছুদিনের জন্য ঘুরপাক খায় গৃহস্থালী যুগে। সেই সময়কার ‘কিচেন সিঙ্ক ড্রামায়’ ফুটে উঠে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ডিপ্রেশন। ১৯৫৬ সাল থেকে আবার সেক্সটন ব্লেক ফিরে আসে স্বমহিমায়। কিংবা বলা যায়, তখন তার উপর জেমস বন্ড ছাড়াও দেখা মেলে ডাশিয়েল হ্যামেট ও রেমন্ড চ্যান্ডলারের ছায়া।
সেক্সটন ব্লেক চরিত্রটির যে ক্রমোন্নতি ঘটেছে, এর পেছনে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি কারণটি হলো, এর আদি লেখক ব্লাইথের মৃত্যু। গোড়ার দিকে ব্লাইথ যেসব কাহিনি লিখেন, সেগুলো খুব একটা পাতে দেয়ার মতো না। কারণ আক্ষরিক অর্থেই ব্লাইথ আহামরি কোনো লেখক ছিলেন না। কিন্তু ব্লাইথের মৃত্যুর পর যখন বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের, প্রচুর জানাশোনা ও অভিজ্ঞতালব্ধ লেখকরা সেক্সটন ব্লেক চরিত্রটিকে নিয়ে কাজ করা শুরু করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই সিরিজের গুণগতমানে ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
যেহেতু অনেক ধরনের লেখক মিলে লিখেছেন সেক্সটন ব্লেক সিরিজটি, তাই গোয়েন্দা কাহিনি নির্ভর এই সিরিজেও দেখা মিলেছে নানা ধরনের জনরার। কোনোটি শ্বাসরুদ্ধকর হুডানিট থ্রিলার, কোনোটি রগরগে প্রাপ্তবয়স্ক থ্রিলার, কোনোটি গা ছমছম করা হরর, কোনোটি অ্যাকশন, আবার কোনোটি অ্যাডভেঞ্চার।
অনেক আজগুবি ব্যাপারস্যাপারও ছিল সেক্সটন ব্লেক সিরিজে। যেমন টিঙ্কার তার সহকারী হিসেবে আসার পূর্বে, তার অন্যতম সহকারী ছিল একটি বোলার হ্যাট পরিহিত গরিলা! একটি কাহিনীর ভিলেন রুপার্ট ওয়াল্ডো দ্য ওয়ান্ডার-ম্যান এতটাই করিৎকর্মা যে, খুব সহজেই সে রবারের মতো নিজের শরীরকে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গিয়ে সিন্দুক থেকে মণিমুক্তা চুরি করতে পারে! এই ওয়াল্ডো অবশ্য পরে সেক্সটন ব্লেকের বন্ধু বনে যায়, এবং কয়েকটি রহস্য সমাধানে তাকে সাহায্যও করে। এদিকে সেক্সটন ব্লেক নিজেও যখন-তখন বাঘ কিংবা কুকুরের ছদ্মবেশ নিয়ে লুকিয়ে শুনে নিতে পারে ভিলেনদের নানা গোপন আলোচনা!
ভিলেনদের প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন আরেকটি কথাও বলে রাখা প্রয়োজন। সেক্সটন ব্লেকের চরিত্রটিকে যতই শার্লক হোমস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হোক না কেন, এ সিরিজের একটি বড় দুর্বলতা হলো, সেক্সটন ব্লেকের তেমন কোনো সাংঘাতিক আর্চ-রাইভাল ছিল না, যেমনটি শার্লক হোমসের বেলায় ছিল প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি। আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য, একজন হিরো কখনোই তার সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে না, যদি না থাকে তার একজন সমানে-সমানে টেক্কা দেয়ার মতো অ্যান্টি-হিরো, রাইভাল বা নেমেসিস।
শেষ করার আগে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’-কে মোকাবিলা না করলেই নয়। সেক্সটন ব্লেক যদি এতই জনপ্রিয় হয়, এতই হয়ে থাকে তার নাম-ডাক, তবে কেন আজকের দিনে বেশিরভাগ মানুষই চেনে না তাকে?
আসলে, সেক্সটন ব্লেক হলো উৎকৃষ্টতম উদাহরণ আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎ মাটিতে আছড়ে পড়ার। একসময় তার স্বর্ণযুগ ছিল; তখন প্রচুর লেখক তাকে নিয়ে লিখে টু-পাইস কামালেও, একসময় আর সামনে এগোনো সম্ভব হয়নি। তাকে নিয়ে লেখার মতো সম্ভাব্য সব কাহিনিই লিখে ফেলা হয়। এদিকে লেবু চিপতে চিপতে তেতো করে দেয়া হয়। তাই তো পাঠকসমাজও মুখ ঘুরিয়ে নেয় তার উপর থেকে। বলে, ‘অনেক হয়েছে বাপু, আর না!’
এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসে সেক্সটন ব্লেক। অবশ্য একেবারে যে হারিয়ে যায়নি এখনো, এ লেখাই তো তার প্রমাণ! তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সেক্সটন ব্লেকের বইয়ের রিপ্রিন্টের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মেছে অনেক পাঠকেরই মনে। সেক্সটন ব্লেককে নিয়ে নতুন করে লেখালেখিও করছে কোনো কোনো লেখক, যার মধ্যে রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও লেখক।
এখন দেখার বিষয়, চার দশকেরও বেশি সময় পর আবারো ফিরিয়ে আনা যায় কি না সেক্সটন ব্লেকের ভাগ্য।