নাম তকদির আলম। পেশায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের চালক। পিতৃপরিচয় নেই। মা দেহ বেচে তকদিরের ভরণপোষণ করতো, তাই তাদের কোনো মূল্যায়ন এই সমাজে নেই। সেজন্যই ছোটখাট কিছু করে নিরামিষভাবে জীবন চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা প্রতিনিয়ত করে তকদির আলম। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে রাজি নয় সে। বাড়তি কিছু উপার্জনের আশায় অবশ্য প্রায় প্রায়ই লাশ বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরার টাইমে মাছের চালান নিয়ে ফেরে। তেমনই এক দিনের কথা। মাছের চালান বুঝে নিয়ে ঢাকা ফিরেছে সবে। চালান বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে ফ্রিজারের ডালা খোলামাত্রই ভেতরে একটা লাশ দেখতে পায়। মাথার ভেতরটা পাক খেয়ে উঠে। ব্যাপার কী? এই লাশ আসলো কোথা থেকে?
দ্রুত চালান বুঝিয়ে দিয়ে জনবিরল একটা জায়গায় এসে অ্যাম্বুলেন্স থামায় তকদির। ফ্রিজারের ভেতর ঢুকে দেখে এক মেয়ের লাশ। কিন্তু কোথা থেকে আসলো, কে-ই বা রেখে গেল এখানে- এসবের কিছুই জানে না সে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় তকদির। প্রথমেই ফোন করে মন্টুকে, যে কিনা মাছের চালানটা তুলে দিয়েছে তার গাড়িতে। মন্টুর কাছেও কাঙ্ক্ষিত উত্তর পায় না। এরপরই ফোন আসে অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির মালিকের। এই মুহূর্তেই আরেকটা লাশ নিয়ে যেতে হবে ঢাকার বাইরে। মালিক জানায়, তকদির অপারগ হলে অন্য কাউকে গাড়িটা বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু পেছনে যে আরেকটা লাশ; তাই তকদির কাজটা নিজেই বুঝে নেয়। গাড়ি নিয়ে বের হয়েই ময়লার ভাগাড়ে যায় সে। লাশটা সেখানেই ফেলে পালাতে চায়। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই ফোনটা বেজে উঠে। লাশটা যে রেখেছে সে-ই ফোন করে তকদিরকে।
উপায়ান্তর না পেয়ে এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপনজন মন্টুকে ঢেকে পাঠায় তকদির। তকদিরকে ভাইছা সম্ভোধন করা মন্টুরও এই দুনিয়াতে কেউ নেই। তাই ভাইছার জন্য জান কোরবান করতেও দ্বিধা করবে না মন্টু। ফ্রিজারে এখন দুটো লাশ। একটা জায়গামতো পৌঁছে দিতে হবে আর অন্যটার কোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। মন্টু বুদ্ধি করে লাশ অদলবদল করে দেয়। অজ্ঞাত আর জ্ঞাত- দুটো লাশেরই দাফন হয়ে যায় সুকৌশলে। কিন্তু অজ্ঞাত লাশটার জন্য ফোন আসাটা তখনও থামে না। দুই পক্ষের সম্মতিতে এটাই সিদ্ধান্ত হয় যে, নির্দিষ্ট এক জায়গায় দেখা করবে তারা। লোকটা আসামাত্রই ধরে বেধড়ক পেটানো হয়। কিন্তু দেখা যায়, এই লোক হচ্ছে আজকের দিনের খবরের শিরোনাম। কেননা, এই লোক আর নতুন আলো পত্রিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক আফসানা আঞ্জুম নিখোঁজ আছেন গত দুদিন ধরে।
মূলত এমনই দারুণ একটা গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে তাকদীর নামক ওয়েব সিরিজটি। বছরের একদম শেষে এসে এই ওয়েব সিরিজটি প্রকাশ করেছে ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই। তবে হইচই ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের কয়েকটা সিরিজও প্রযোজনা করেছে। মূলত, চঞ্চল চৌধুরী ছিলেন এই সিরিজের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। চঞ্চল চৌধুরী নামটাই একটা আস্থা; যেন ভালো কিছুই হবে। পাশাপাশি ট্রেইলার প্রকাশ পেলে নির্মাণশৈলী দেখে দর্শকদের মধ্যে ভালো কন্টেন্ট পাবার একটা তীব্র ইচ্ছা প্রবল হয় আরও। কেননা, ভালো কন্টেন্টহীনতায় এদেশি দর্শকরা ভুগছে বেশ দীর্ঘ একটা সময় ধরেই। সেজন্যই ট্রেইলার প্রকাশ হবার পর থেকেই তাকদীর বেশ হাইপ তৈরি করেছিল দর্শকদের মধ্যে।
একজন হোমিসাইড ডিটেকটিভ দুর্ঘটনাবশত গাড়ি চালানোর সময় একজন পথচারীকে মেরে ফেলে। দিশেহারা হয়ে আর নিজের অপরাধ লুকানোর জন্য নিজের মায়ের লাশের পরিবর্তে সেই লাশটার দাফন করে ফেলে। কিন্তু পরের দিন থেকে তাকে কেউ ফোন দিয়ে লাশের খোঁজ জানতে চায়। এভাবেই এগিয়ে চলে ২০১৪ সালে প্রকাশ পাওয়া কোরিয়ান সিনেমা অ্যা হার্ড ডে। সম্প্রীতি প্রকাশ পাওয়া তাকদীর এবং অ্যা হার্ড ডে গল্প দুটির যোগসূত্র দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। ব্যক্তিগতভাবে দুটি গল্পই দেখা; কিন্তু মোটেও চুরি বা নকল কন্টেন্ট বলে মনে হয় না।
ইন্সপায়ার্ড বা অনুপ্রেরণায় এই যাবতকালে প্রচুর সিনেমা বা সিরিজ নির্মিত হয়েছে, হচ্ছেও, এবং হবেও সামনে। যেমন, আকিরা কুরোসাওয়ার সেই সেভেন সামুরাই সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হলিউডের দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন বা ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড; কিংবা বলিউডের সর্বকালের সেরা হিট ফিল্ম শোলে এর নির্মাণ। এমন কথা উঠেছিল বটে দেশীয় সিনেমা আয়নাবাজির ক্ষেত্রেও। কিন্তু ঐ যে অনুপ্রাণিত হয়ে এই দুনিয়ায় অসংখ্য কাজ সৃষ্টি হচ্ছে। অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করলে সেই কাজে স্বাতন্ত্র্য আর মৌলিকত্ব থাকে; এমনকি ছায়া অবলম্বনে করলেও তাতে বিষয়টা খুব একটা চুরির পর্যায়ে পড়ে না।
আরবী শব্দ কদর বা কাদরুন থেকে তাকদীর শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ হচ্ছে অদৃষ্ট বা ভাগ্য অথবা নিয়তি। সিরিজের প্রধান চরিত্রের নামও তকদির। যেন ভাগ্যের লীলাখেলায় বন্দি এক সত্ত্বার গল্প এই তাকদীর ওয়েব সিরিজ। সিরিজটির নির্মাতার হিসেবে ছিলেন সৈয়দ আহমদ শাওকি এবং সালেহ সোবহান অনিম। তবে পুরো সিরিজের পরিচালক হিসেবে ছিলেন তরুণ প্রতিভাবান পরিচালক সৈয়দ আহমদ শাওকি। এর আগে প্রজন্ম টকিজ, ইতি, তোমারই ঢাকা অ্যান্থলজি সিনেমাতে চিয়ার্স এবং অস্থির সময়ের স্বস্তির গল্পতে কথা হবে তো নামক নাটকের পরিচালক হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন ইতিমধ্যেই। তাই দর্শকদের প্রত্যাশাও ছিল খানিকটা বেশিই। আর সেই প্রত্যাশা পূরণে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন শাওকি। ফলাফল, দর্শকপ্রিয়তা আর সুনাম দুই-ই অর্জন করলেন এই তরুণ পরিচালক।
নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে ছিলেন মীর মুকাররম হোসেন এবং রোমেল চৌধুরী। আর ক্রিয়েটিভ প্রযোজক হিসেবে এসেছে আরেক তরুণ প্রতিভাবান নির্মাতা তানিম নুরের নাম। একইসঙ্গে নির্মাতা, প্রযোজক এবং সম্পাদনাতে ছিলেন সালেহ সোবহান অনিম। চিত্রনাট্যে ছিল নেয়ামত উল্লাহ মাসুম এবং সৈয়দ আহমদ শাওকির নাম। গল্প আর চিত্রনাট্য ছিল বেশ গোছানো। খুব সূক্ষ্মভাবে আর যত্ন নিয়ে গড়া হয়েছে এই সিরিজের চিত্রনাট্য। চেষ্টা করা হয়েছে যেন তেমন কোনো ফাঁকফোকর কিংবা ভুলভ্রান্তি না থাকে। চিত্রনাট্যের পরতে পরতে গল্পের ভাঁজ খোলার একটা প্রবণতা ছিল যেটা দর্শকদের গল্পের শেষ অবধি আটকে রাখে।
আর গল্পের পারিপার্শ্বিকতা নিত্যদিনের বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত। ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ কিংবা লাশ গুমের রাজনীতি অথবা আড়ালে হারিয়ে যাওয়া গণধর্ষণের কথা; নয়তো ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা প্রচার করতে গিয়ে সাংবাদিকের জীবনবসান- এসব ঘটনা পত্রিকা কিংবা অনলাইন পোর্টাল জুড়ে অহরহ পড়া হয় কমবেশি সকলেরই। আর সেই সঙ্গে চিত্রনাট্যর দারুণ উপস্থাপন যেন গল্পকে খুব বেশি চেনা আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। চিত্রনাট্যে তাই বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন চিত্রনাট্যকারদ্বয়।
পরিচালনায় বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছেন পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকি। পুরো সিরিজ জুড়ে কেমন একটা ভারিক্কী ভাব পরিচালনায়। যেন বেশ পরিকল্পনা নিয়ে নির্মিত অথবা কাজ করতে করতে পরিপক্ব, এমন একটা ভাব। পরিচালকের সঙ্গে অভিনয়শিল্পী আর কলাকুশলীদের কী দারুণ মেলবন্ধন। সেজন্যই পরিচালক যা দেখাতে চেয়েছেন তা-ই দেখাতে পেরেছেন। এটা অবশ্যই পরিচালকের পরিচালনার মুন্সিয়ানা। পরিচালকের পর ভার ছিল সিনেমাটোগ্রাফারের। যেন গল্পটা ঠিকঠাক পর্দায় উপস্থাপন করা যায়।
আর সেই দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবেই পালন করেছেন বরকত হোসেন পলাশ। কী সুন্দর আর দারুণ সব ফ্রেমিং। কী চমৎকার সব দৃশ্য ধারণ। কবরস্থান থেকে মাছের আড়ত, সেখান থেকে ময়লার ভাগাড়, ফেরি করে নদী পাড়াপাড় কিংবা বরফকল থেকে কাশফুলের গহিনে হারিয়ে যাওয়া অথবা লাশ কাঁধে শেষ ঠিকানায় পৌঁছে যাওয়া যেখান থেকেই মূলত গল্পের শুরু- এসব দৃশ্য যেন দর্শকদের ভাবায় গল্পটা হয়তো সত্যি। খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য লাগে গল্পটাকে। খুব বেশি চেনা পরিচিত মনে হয়। যেন চেনা সড়ক ধরে ছুটে চলে সকালের চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার সময় পড়া খবরের কাগজের সংবাদটা।
না বলতে চাইলেও চলে আসে অভিনয়শিল্পীদের কথা। কেননা, অভিনয়ের উপরই নির্ভর করে গল্পটা কত ভালোভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। প্রধান চরিত্রে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। অনেক আগেই নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নিজের জাত চিনিয়ে আস্থার জায়গাটা তৈরি করে নিয়েছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। এই সিরিজে একজন লাশবাহী চালকের চরিত্র ছিল চঞ্চল চৌধুরীর, তকদির যার নাম। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও দর্শক বুঝতে পারবে না, এই লোকটা তকদির আলম নয়; বরং তার আসল নাম চঞ্চল চৌধুরী!
একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের চালচলন, কথাবার্তার উচ্চারণশৈলী, আদবকায়দার রীতিনীতি, সর্বোপরি একজন চালকের জীবনীতে নিজেকে এমনভাবে মিশিয়ে ফেলেছেন চঞ্চল চৌধুরী যে ধরার উপায় ছিল না। প্রতিটি পর্বে যেন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, শুরুতে তকদির আলম চরিত্রের যতটা জটিলতা আর সূক্ষ্মভাব ছিল তা উপভোগ্য। পরবর্তীতে চরিত্রের এই জটিলতা আর সূক্ষ্মভাবগুলোই বিরক্তি এনে দেয়। কেননা, চরিত্র বিকশিত হবার জায়গাটা ছিলই না বলতে গেলে। তকদির চরিত্রের ক্ষেত্রে বিকাশের চেয়ে অভিনয়েই হয়তো বেশি জোর দেয়া হয়েছে চিত্রনাট্যে। যদিও নিজের অভিনয় দিয়ে শেষ অবধি চরিত্রটাকে দারুণভাবে টিকিয়ে রেখেছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। আর একদম শেষের দিকে তকদির নয়, চঞ্চল চৌধুরী নয়; বরং ভিন্ন কোনো মানুষ যেন এসে আবেগ আপ্লুত করে দিয়ে যায় দর্শকদের। ফিকশনাল চরিত্র তকদির হাওয়ায় মিলিয়ে যায়; তবে দর্শকদের মনে রয়ে যায় চঞ্চল চৌধুরীর একবুক হাহাকার আর বিষণ্ণতা।
লাশ ওঠানোর খাটিয়া বহনে চারজনকে দাঁড়াতে হয় ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য। তেমনি গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও মূল চরিত্র ব্যতিরেকেও অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রের দরকার হয়, গল্পের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য। এমনই এক ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্র ছিল মন্টু; যেখানে অভিনয় করেছেন দীর্ঘ এগারো বছর যাবত থিয়েটার করা সোহেল মণ্ডল। মন্টু মূলত তকদির আলমের খুব কাছের ছোট ভাই। তাই তকদির চরিত্রের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়ই মন্টুকে দেখা গিয়েছে। চরিত্র দুটো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন একটা চরিত্র অন্যটার পরিপূরক। সিরিজের প্রথমার্ধ অবধি গল্পটাকে তকদিরই একা টেনে নিয়ে যায়; আর মধ্যভাগ থেকে শেষ অবধি যেন তাকেও ছাপিয়ে যায় মন্টু।
সোহেল মণ্ডল ন্যূনতম ছাড় দেননি নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শনে। কিংবা ন্যুব্জ হননি বর্ষীয়ান অভিনেতাদের ভিড়ে। বরং চঞ্চল চৌধুরীর মতো গুণী অভিনেতার পাশে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে অভিনয় করেছেন, যেটা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। বর্ষীয়ান অভিনেতাদের ছাপিয়ে কাউকে নিয়ে প্রশংসা করলে ব্যাপারটা কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগে, অন্তত উপমহাদেশের সংস্কৃতিটাই এমন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিংবা কিছু কিছু দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরীকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন সোহেল মণ্ডল। হয়তো শুনতে লাগে বাড়িয়ে বলা, কিন্তু সিরিজ দেখলেই বোঝা যায় কথা কতটা সত্য আর স্পষ্ট।
একটা রাস্তার ছেলে কিংবা একজন মাছ ব্যবসায়ীর কথা বলার একটা নির্দিষ্ট টোন আছে। আঞ্চলিকতার একটা টান আছে, কিছু নির্দিষ্ট বুলি আছে, কাপড়চোপড় পরাতেও কিছু ব্যাপার থাকে; এ সবকিছু মন্টু চরিত্রে না থাকলেও ছিল সোহেল মণ্ডলের অভিনয়ে। বিপদের মধ্যে কথায় কথায় খিস্তিখেউড় করা সোহেল মণ্ডল মুহুর্তের জন্যও সরতে পারেনি মন্টু চরিত্র থেকে। বিপদে ভাইছা‘কে একা ফেলে না রেখে বরং বিপদ কাঁধে তুলে নেয়া আর এর সমাধানও নিজেই করা- এমন বৈচিত্র্যময় চরিত্র শেষ কবে দর্শকরা দেখেছে তা সঠিক মনেও নেই হয়তো। এমনই একটা ছেলে যখন বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তখন আসলে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে নয়, বরং অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয় দর্শক। আন্ডার কনস্ট্রাকশন, মুসাফির, আয়নাবাজিতে অভিনয় করে কিংবা অমিতাভ রেজার ঢাকা মেট্রো সিরিজের সম্পাদনা এবং কালার গ্রেডিং করেও সোহেল মণ্ডল যা অর্জন করতে পারেননি, তাই অর্জন করেছেন কেবল এক সম্বোধনে-ভাইছা।
তাকদীর সিরিজের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন পার্থ বড়ুয়া, সানজিদা প্রীতি, ইন্তেখাব দিনার, মীর রাব্বিসহ অনেকেই। সানজিদা প্রীতি খুব বেশি একটা সময় পর্দায় ছিলেন না। কিন্তু যতটুকু সময় ছিলেন ডানা মেলে নিজের চরিত্রকে উড়িয়েছেন পুরো পর্দা জুড়ে। তাই তো সাংবাদিক আফসানা আঞ্জুম চরিত্রটা বেশ ভার রাখতে সক্ষম হয়েছে এই সিরিজে। পার্থ বড়ুয়া ছিলেন মূলত একজন হিটম্যানের চরিত্রে। খুবই সাদামাটা বা ক্যাজুয়াল ভাব বজায় ছিল তাঁর অভিনয়ে। আর এই ক্যাজুয়াল ভাবই যেন গুমোট করে তুলেছিল সিরিজের পরিবেশকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ক্যাজুয়াল ভাবটা খুব বেশি জমাতে পারেনি ঠিক।
তবে হ্যাঁ, কোনো ধরনের খুনখারাবির দৃশ্য ব্যতিরেকে বেশ ভালোই হিটম্যান হিসেবে নিজেকে ফুটিয়েছেন পার্থ বড়ুয়া। আর একটা চরিত্রের কথা বিশেষ করে বলতে হয়। হয়তো এই চরিত্রকে নিয়ে তেমন কোনো আলাপ-আলোচনাই হয়নি। কেননা, এত এত চরিত্র আর অভিনেতাদের ভিড়ে অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল শেহজাদ চরিত্রটি। শেহজাদ চৌধুরী চরিত্রে ছিলেন মীর রাব্বি। পর্দায় যিনি সাংবাদিক আফসানা আঞ্জুম (সানজিদা প্রীতি) এর স্বামী। শেহজাদের চরিত্রটি একটু বিতর্কিত ধরনের। চাপা, একরোখা স্বভাবের, আবার কিছুটা বিরক্তকরও বটে। মীর রাব্বি বেশ স্বচ্ছন্দে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন এই চরিত্রে। অভিনয় যে করেছেন সেটা বোঝার সুযোগ দেননি। পর্দায় থাকা তার সময়টুকু জুড়েই বেশ পরিপক্ব এক অভিনেতার পরিচয় দিয়েছেন।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্ব চরিত্রে ছিলেন মনোজ প্রামাণিক। ফটোগ্রাফার রানা চরিত্রটি সিরিজের মধ্যভাগে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চরিত্রটি মূলত এমন এক চোরাবালিতে আটকে পড়া লোকের যে বুঝতে পারে না, কে তাকে ডোবাতে চায় আর কে চায় বাঁচাতে? এমন দ্বিধান্বিত এক চরিত্রে মনোজ প্রামাণিক নিজের সেরাটাই দিয়েছেন। তার অঙ্গভঙ্গি-চালচলনে তেমনটাই প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করা কমবেশি সবাই-ই ভালো করেছেন। যেমন- পাভেল জামান, নাফিস ইসলাম, তকদির আর মন্টুর শৈশবে অভিনীত দুই শিশুর কথাও উল্লেখযোগ্য; তবে পুলিশ অফিসারের কথা তেমনভাবে উল্লেখযোগ্য নয় এই কারণে যে, চরিত্রটি খুব বেশি একটা সময় পায়নি ফুটিয়ে তোলার।
এত এত ভালো দিক কি একটা সিরিজের হওয়া সম্ভব? এমনকি চাঁদেরও তো কলঙ্ক আছে! একদম শুরুর দিকে কয়েকটা ফোনকল যে ডাবিং করা হয়েছে তা চোখে লাগে। কেননা, ফোনকলের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি বা কার্যক্রম অনেকাংশে মেলে না। যেমন- ওপাশ থেকে কথা বলছে আর এপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়া হয়েছে। ধস্তাধস্তির দৃশ্যগুলো খুব বেশি একটা সুবিধের না। কেমন যেন খাপছাড়া। তবে এসবকিছু একদমই ফিকে। যেটা নিয়ে কথা না বললেই নয়, সাংবাদিক আফসানা আঞ্জুম (সানজিদা প্রীতি) এর লাশ।
কবর থেকে তোলা একটা লাশের কাফন অবশ্যই ধবধবে সাদা হবার কথা নয়। বরং মাটির দাগ আর ময়লা থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকি তা লাশের ক্ষেত্রেও মেকআপের সাহায্য নেয়া উচিত ছিল। কেননা, মাটির নীচে থাকলে ত্বকের কোমলতার বদলে রুক্ষতাই বেশি ফুটে ওঠে। আবার শুরুতে গল্পের ডালপালা ব্যাপক বিস্তৃত ছিল। রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ব্যবহার, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, দলীয় প্রভাব ইত্যাদি বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুললেও সমাধান ছাড়াই শেষের দিকে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ব্যাপারগুলোকে। হয়তো দ্বিতীয় সিজনের আশায় কিংবা এখানেই গল্প সমাপ্তের ইচ্ছায়।
শুরুর টাইটেল অ্যানিমেশন আর আবহ সঙ্গীত বেশ মনকাড়া ছিল। কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব। শুনলেই মনে হয় কারো হৃদয়ের গভীর থেকে ভেসে আসা হাহাকারের সুর। ডার্ক অর্কেস্ট্রার এমন ফ্লেভার অনেককাল মনে রাখার মতোই, রুশলান রেহমানকে এজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল মোটামুটি। একমাত্র করুণ বা দুঃখজনক দৃশ্য ব্যতীত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খুব বেশি একটা মন কাড়তে পারেনি। আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। তবে এখানেও পরিচালক একটা বাহবা পান। কেননা, তিনি চিত্রনাট্য এমনভাবে সাজিয়েছেন যে মিউজিক ছাড়াই তা প্রাণবন্ত আর জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আবার, কস্টিউম আর আর্ট ডিপার্টমেন্ট ভালো ছিল। যেজন্য প্রোডাকশন ডিজাইন সর্বোপরি বেশ ভালো লাগে।
তবুও এই সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় অভিনয় দক্ষতা, গল্প আর গল্প বলার ধরন। সিরিজের এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা যে, সিরিজ দেখা শেষে বিষণ্ণতার একটা রেশ রয়ে যায়। কিছু বার্তা দিয়ে যায় আমাদের। যেমন- চঞ্চল চৌধুরী যখন বলেন, “মানুষের জন্য চিন্তা কইরা লাভ নাই, মানুষ মইরা না গেলে কেউ কাউরে ভালো কয় না।” কতটা স্বার্থপর আমরা যে, অন্যের বিদায় ব্যতীত ভালো বলতেও আমাদের এত কুণ্ঠা। কেনই বা আমাদের এত স্বার্থপরতা? এত অহংকার?
পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকি এবং তাকদীর সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ এই জন্য যে, ভালো কন্টেন্ট নির্মাণ করার মতো নির্মাতা, ভালো অভিনেতা আর কলাকুশলী সবই আমাদের আছে। কেবল ভালোভাবে ব্যবহার করার মাধ্যম জানতে হবে। একইসঙ্গে প্রযোজকদেরও কাছে এমনটা আবদার থাকবে দর্শকদের যেন বাইরের দেশে কন্টেন্টে অর্থ বিনিয়োগ না করে নিজ দেশের মৌলিক কন্টেন্টে বিনিয়োগ করে। নিজের দেশের একটা ভালো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দরকার যেখানে এমন ভালো কন্টেন্ট নিয়মিত পাবে দর্শক।
পাশের দেশ ভারত থেকে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে এই তাকদীর সিরিজ। চঞ্চল চৌধুরী, সোহেল মণ্ডল এবং পরিচালক শাওকির প্রশংসায় পঞ্চমুখ তারা। এটাই কি একটা সুযোগ নয় বাংলাদেশের প্রতিভা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার! যাক, এমন উপস্থাপনে গল্প বলাটা অনেকটাই সার্থক যখন আইএমডিবিতে রেটিং ৮.৯ চলে আসে। আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতার অবসান হচ্ছে শেষমেশ তকদিরের শেষ দৃশ্যে বলা কিছু কথা দিয়েই,
আমার মা শরীর বেইচা আমারে মাদ্রাসায় পড়াইছে। মা মরণের পর, আমি ঐ দুনিয়া ছাইড়া আপনোগো ভালা দুনিয়ায় আইলাম। কিন্তু এই দুনিয়ায় আইসা দেখলাম, ঐ দুনিয়ায় খালি শরীর বিক্রি হইতো; আর আপনেগো ভালা দুনিয়ায় শরীরের সাথে আত্মাটাও বিক্রি হয়।