“People here grumble and say that the heart of the poet in Meghnad is with Rakhasas. And that is the real truth. I despise Ram and his rabble; but the idea of Ravan elevates and kindles my imagination; he was a grand fellow.”
বঙ্গানুবাদটি এরকম,
মানুষ এখানে প্রায়ই অপবাদ দেয় যে ‘মেঘনাদবধ’-এর কবির হৃদয় রাক্ষসেরা অধিকার করে আছে। আর, এটিই প্রকৃত সত্য। আমি রাম ও তার বানরদের ঘৃণা করি। কিন্তু রাবণের বিষয়টি আমার কল্পনাকে উন্নত ও প্রশস্ত করে। রাবণ ছিলেন একজন মহান পাত্র।
‘মেঘনাদবধ’-এর ব্যাপারে কবি মাইকেল বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে এমন মন্তব্য করেছিলেন। ‘মেঘনাদবধ’ নিয়ে কথা উঠলেই কয়েকটি বিষয় আসবেই আসবে। সেগুলো হলো অমিত্রাক্ষর ছন্দ, মানবীয় দৃষ্টিতে রামায়ণের নবসংস্করণ, বাংলা সাহিত্যের নতুন একটি ধারার সৃষ্টি। ‘মেঘনাদবধ’ নিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে শুধু প্রশংসাই প্রচলিত রয়েছে, এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না। শত আলোচনা-সামালোচনার মধ্যেও সবাই একে মাইকেলের এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদের তকমা প্রদান করেছেন।
‘মেঘনাদবধ’ প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ১৬০ বছর আগে, ১৮৬১ সালের ৪ জানুয়ারি। এতে রয়েছে মোট নয়টি সর্গ। প্রথম পাঁচটি নিয়ে সাজানো হয় প্রথম খণ্ড এবং পরবর্তী চারটি নিয়ে দ্বিতীয়টি। প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৩১ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ১০৪। প্রথম খণ্ড প্রকাশের সাত মাস অন্তর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। মেঘনাদবধের প্রথম সংস্করণ প্রকাশকালে কবির বয়স ছিল সাঁইত্রিশ। এ মহান মহাকাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ব্যয়ভার কবির পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। তখন কবির পাশে দাঁড়ালেন রাজা দিগম্বর মিত্র। রাজা তার উপাধি।
মুক্তমনা ও দেশহিতৈষী দিগম্বর মিত্র রেশম ও নীলের ব্যবসা করে ধনপতি হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কলাপ্রেমী, সংগঠক ও সুলেখক। দিগম্বর মিত্রের অর্থসাহায্যে ‘মেঘনাদবধ’ প্রকাশ করা হল। কবি এ মহাকাব্য তাকেই উৎসর্গ করলেন। ‘মেঘনাদবধ’-এর প্রথম পাঁচটি সংস্করণ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ষষ্ঠ সংস্করণ থেকে খণ্ড দুটো একীভূত করা হয়।
মধুসূদন দত্ত জমিদারনন্দন হলেও যৌবনের প্রারম্ভেই প্রবল অর্থসংকটে পড়েছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে যশোরের সাগরদাঁড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস করা শুরু করেন। ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। পিতা শ্রী রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতা দেওয়ানি আদালতে ওকালতি করতেন। তৎকালীন কলকাতার মুক্তমনা আবহাওয়া মধুসূদনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কলকাতাতেই তিনি ইউরোপীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পরে মধুসূদন পিতা কর্তৃক ত্যাজ্য হলে জমিদারি ও সকল অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলা সাহিত্যের দীনদশা মাইকেলকে বড় পীড়িত করেছিল। ইংরেজি সাহিত্য রচনা করে খ্যাতিলাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি একনিষ্ঠভাবে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় মন দেন। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেও তার লেখায় ভারতীয় তথা আর্য সাহিত্যের উপাদান, অলংকার, রস বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সে যুগে আধুনিকতার মানদণ্ডে ইংরেজি ও গ্রিক সাহিত্য ছিল সবার উপরে। তারা দেব-দেবীর স্তব-স্তুতির উর্ধ্বে উঠে মানবের জয়সূচক সাহিত্য রচনার সাহস দেখিয়েছিল মাইকেলের জন্মের বহু আগেই। মাইকেল সেগুলো পড়ে বাংলাভাষায় নতুন সাহিত্যধারা সৃষ্টিতে উদ্যোগী হন।
বলে রাখা ভালো, মাইকেল ছিলেন একজন বহুভাষাবিদ। তিনি মোট তেরোটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। বাল্যেই বাংলা, আরবি ও ফারসির হাতেখড়ি হয়েছিল তার। কৈশোরে ইংরেজি ও সংস্কৃত। মাইকেল নিজ উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা শেখায় ব্রতী হন। ইউরোপীয় ভাষাগুলো নিয়েও তিনি প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। গ্রিক ও ইংরেজি ভাষার মহাকাব্যগুলো তাকে অনুপ্রাণিত করত। মহাকাব্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, দান্তের ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’, ভার্জিলের ‘ইনিড’, মিল্টনের ‘দ্য প্যারাডাইস লস্ট’, ব্যাসের ‘মহাভারত’ এবং বাল্মিকীর ‘রামায়ণ’-কে অনুসরণ করেছেন। মাইকেল আদি বাংলার পয়ার ছন্দকে ভেঙে কাব্যে নতুন অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন। পয়ার ছন্দটি এরকম–
“আদিকাণ্ডে রামজন্ম, সীতা পরিচয়
অযোধ্যা কাণ্ডেতে রাম বনবাস হয়
অরণ্য কাণ্ডেতে হয় জানকী হরণ
কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডেতে হয় সুগ্রীব মিলন”
(কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে উদ্ধৃত)
অর্থাৎ, এক চরণের শেষ মাত্রা পরের চরণের শেষ মাত্রার সাথে মিলবে। এটিই অন্ত্যমিলযুক্ত পয়ারছন্দ। মাইকেল তার রচনায় চরণের চৌদ্দ মাত্রা বজায় রাখেন ঠিকই, তবে এক চরণের অন্ত গিয়ে ঠেকান আরেক চরণের ভেতরে এবং যতিচিহ্নের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। তার রচিত কাব্যে দুটো চরণের শেষে পয়ারের ন্যায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, একটি চরণ শেষ হয় আরেকটি চরণের মাঝে। বাংলা কাব্যে এমন দুঃসাহস মাইকেলই প্রথম দেখিয়েছিলেন। একবার এক সাহিত্যসভায় তিনি পয়ার ছন্দ বাদ দিয়ে অমিত্রাক্ষরে কাব্য রচনার বিষয়টি তুলে ধরলে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেন,
“পয়ার বাদ দিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দ! বাংলায় কি তা সম্ভব?”
মাইকেল প্রমাণ করে দেখান, তা সম্ভব। মাত্র দু’বছরের মধ্যে কবি অমিত্রাক্ষরে চারটি মহৎ কাব্য রচনা করেন। অমিত্রাক্ষরে রচিত প্রথম কাব্য ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ (১৮৬০)। ‘মেঘনাদবধ’ দ্বিতীয়। পরেরগুলো হলো ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২) ও ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২)। ‘মেঘনাদবধ’-এর কাহিনী রামায়ণ থেকে নেওয়া হলেও কবি মাইকেল পুরো কাব্যে আগাগোড়া বাল্মিকীর রামায়ণকে অনুসরণ করেননি। কাহিনীতেই অমিল লক্ষ করে সেযুগে কেউ কেউ একে দূষিত সাহিত্যের তকমা দিয়েছিল। মূল রামায়ণের নায়ক রাম।
বাল্মিকী রামকে চিত্রায়ণকালে তার দেবত্ব, মহানতা, মহানুভবতা প্রভৃতি সদগুণই শুধু বর্ণনা করে গেছেন। রামকে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’-এ ভূষিত করেছেন। রাবণকে সেখানে অসুর, পাপী, লোভী, অহংকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। পুরাণ রচয়িতা ঋষিগণের ‘অসুরমাত্রেই খারাপ’ মনোভাবকে মধুসূদন দত্ত একদম গ্রহণ করেননি। ‘মেঘনাদবধ’-এ রামের দৈবিক গুণগুলো এবং রাবণের অসুরিক গুণগুলো ছেঁটে তাদের উভয়কেই মানবীয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
দুই শিবিরের দুই মহানায়ক ছাড়াও আর যাকে কেন্দ্র করে কাহিনী এগিয়েছে, তিনি রাবণপুত্র মেঘনাদ। মহাকাব্যের কায়া গঠনের ক্ষেত্রে গ্রিক ও ইংরেজি মহাকাব্যগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। মিল্টনের ঈশ্বর বন্দনা ও নরক বর্ণনাকে আশ্রয় করে মাইকেল কাব্যের প্রারম্ভে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের অন্য গুণগুলো পূরণের স্বার্থে কাব্যটি অষ্টাধিক সর্গে রচনা করেছিলেন। এখানে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, রাত্রি, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তবুও, এটি কলেবরে খুব একটা বড় হয়নি।
কলেবরে বাল্মিকীর রামায়ণের তুলনায় মেঘনাদবধ নিতান্ত ক্ষুদ্র একটি কাব্য। মাইকেল একে সরাসরি মহাকাব্য না বলে ‘একটি ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্য’ এভাবে উল্লেখ করেছেন। মাত্র দুইদিন তিন রাতের কাহিনী এতে উঠে এসেছে। মহাকাব্য সাধারণত সর্বরসের আধার হয়ে থাকে। এতে সবরকম রস থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে, যেহেতু যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা বেশি থাকে, তাই আশা করা হয় মহাকাব্যে প্রধানত বীররসের ধারা প্রবাহিত হবে। মাইকেল কাব্যের প্রারম্ভে সরস্বতীকে উদ্দেশ করে বলেছেন,
উর তবে, উর দয়াময়ি
বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত; উরি, দাসে দেহ পদচ্ছায়া।
অর্থাৎ,
কবি সরস্বতীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে এ মহাগীত বা মহাকাব্য বীররসে প্রচার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ‘মেঘনাদবধ’ বিশুদ্ধ বীররসের মহাকাব্য হয়নি। এখানে বীররসের চেয়ে করুণরসের প্রাধান্য বেশি। রাবণ-মন্দোদরীর পুত্রবিলাপ, মেঘনাদের আহাজারি প্রভৃতি ঘটনা কাব্যে বীররসের চেয়ে করুণরসই বেশি স্খলিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতেরো বছর বয়সে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের একটি সমালোচনা লিখেছিলেন। সেটিই সম্ভবত ‘মেঘনাদবধ’-এর সবচেয়ে কঠোর, কঠিন এবং প্রচলিত সমালোচনা। কবির তরুণ হৃদয় নির্মমভাবে মাইকেল ও তার মেঘনাদবধকে আক্রমণ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ-সমালোচনা শুরুর পূর্বে যারা সাহিত্য সমালোচনা করতে ভয় পায় এবং যারা আধুনিকতার নামে যা দেওয়া যায়, তা-ই চোখবুজে গোগ্রাসে গিলে ফেলে, তাদের সমালোচনা করেছিলেন।
অত্যন্ত চতুরতার সাথে তরুণ রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ’-এর মূল রামায়ণ থেকে বিচ্যুতি, চরিত্রগুলোকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে চরিত্রের স্বগুণ নষ্ট হওয়া, প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে মাইকেলের অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া, বীররস সঞ্চার করতে গিয়ে পাঠকদের করুণরসে ভিজিয়ে দেওয়া এবং দুর্বোধ্য শব্দের অত্যাধিক প্রয়োগ ঘটিয়ে পাঠকমনে বিরক্তির উদ্রেক করা ইত্যাদি বিষয় সমালোচনায় তুলে ধরেছেন। শব্দের দুর্বোধ্যতা, ছন্দ, ঘটনাপরম্পরা, চরিত্রগুলোর স্বজাত্য প্রভৃতি বোঝাতে তিনি বাংলা ভাষায় রচিত আরেকটি মহাকাব্য ‘বৃত্রসংহার’-এর সাথে ‘মেঘনাদবধ’-এর তুলনা করেছেন। সেটি ছাড়াও হোমারের ‘ইলিয়াড’-এর সাথে মেঘনাদবধের তুলনা দিয়ে মধুসূদনের চরিত্র চিত্রায়ণের সীমাবদ্ধতার দিকটি বর্ণনা করেছেন।
তবে রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ’-এর সমালোচনা করছেন ঠিকই কিন্তু মাইকেলের প্রতিভার প্রশংসাও করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত মাইকেল রবীন্দ্রনাথের সে সমালোচনা পড়ে যেতে পারেননি।
‘মেঘনাদবধ’ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তি বিভিন্ন মন্তব্য করেছিলেন। স্বামীজী বলেছিলেন, “এ গ্রন্থটি বাংলাভাষার মুকুটমণি”। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর এ রচনাটিকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মূল্যবান রচনা বলে অভিহিত করেছিলেন। বিদ্যাসাগর মেঘনাদবধকে বলেছিলেন ‘সুপ্রিম পোয়েম’। কেউ কেউ তাদের মন্তব্যে ‘মেঘনাদবধ’-এর ছোটখাটো সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনার দিকে ইঙ্গিত দিলেও সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, মেঘনাদবধ কাব্যই বাংলাভাষায় রচিত প্রথম আধুনিক সার্থক মহাকাব্য। বাংলা নাটকের প্রবাদপুরুষ গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘মেঘনাদবধ’কে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্যোগে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল।
‘মেঘনাদবধ’ তৎকালীন বঙ্গীয় রেনেসাঁয় একটি তারা হয়ে দেখা দিয়েছিল। এপার-ওপার দুই পারের বাঙালিদের কাছেই ‘মেঘনাদবধ’ এখনও নব নব আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যমুকুটে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সবচেয়ে দামি মাণিক হয়ে আজও সমানভাবে দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে।