কাঞ্চন নামের একটা বাচ্চা ছেলে। প্রচন্ড দুরন্ত। কাকে যে ঠিক ভয় পায় সেটা বলা মুশকিল। তার অত্যাচারে সারা গ্রাম তটস্থ। এর খাবার কেড়ে খাওয়া, একে ধাওয়া করা, চুরি করা- কী সে করে না!
একদিন তার বাড়ির পুজোর ঠাকুর বিনোদ তাকে শাপ দিল। কাঞ্চনের বিদ্যে না হলেও বুদ্ধি হবে। কাঞ্চন সেই শাপ কাটানোর জন্য বেশ জোরাজুরি করছিল। কিন্তু বামুন কি পারে অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে?
এই থেকেই চূড়ান্ত ঝামেলার শুরু। বিনোদ পুজো শেষে কিছু খাবার পেয়েছিল কাঞ্চনদের বাড়ি থেকে। তার মধ্যে দই অথবা ক্ষীর হবে, কেড়ে নেয়ার জন্য বেশ ঝামেলা শুরু করে কাঞ্চন। শেষ পর্যন্ত বামুনের পৈতে ছিড়ে, মাথায় ক্ষীর ঢেলে সে এক অবস্থা।
বামুনের এহেন হাল করে বোধহয় সে নিজেই বুঝল মহা ভুল করেছে। এদিকে খবর পেল বাবা তার জন্য বেত নিয়ে অপেক্ষায়। বেতের বাড়ি থেকে বাঁচতে, বিদ্যে-বুদ্ধির খোঁজে কাঞ্চন পালাল বাড়ি থেকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে গেল কলকাতায়। পকেটে নেই কোনো পয়সা। সে কীভাবে পৌঁছাবে কলকাতায়?
অনেক কায়দা করে সে পৌঁছায় কলকাতায়। মাত্র ১৩ বছরের এক ছেলে। জল থেকে ডাঙ্গায় মাছ তুললে যেমন হয়, কাঞ্চনের অবস্থা খানিকটা সেরকম।
আজব শহর এই কলকাতায় কাঞ্চনের দিন কীভাবে কাটবে? কোথায় খাবে? থাকবে কোথায়? কে তাকে সাহায্য করবে? ছেলেধরার খপ্পরে পড়বে কি? কোনোদিন কি বাড়ি ফিরতে পারবে? সে যখন রেলগাড়িতে চেপে কলকাতায় এসেছিল, তখন কি সে ফেরার কোনো পথ রেখে এসেছিল? বাবা-মা-বিনোদ-ভাই-বোন, গাঁয়ের পথ, সবুজ, কেরোসিনের প্রদীপ- এই সবকিছুর হাতছানি নাকি কলকাতা শহরের চকমকে বিজলি বাতি? কার আহবানে সাড়া দেবে কাঞ্চন বা কনক?
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ কিশোরদের জন্য রচিত একটি বই। একে থ্রিলার কিংবা কিশোর উপন্যাস অথবা এডভেঞ্চার জনরাতে ফেলতে পারেন। ১৯৩৭ সালে রচিত এই বইটি ১৯৫৯ সালে আসে সিনেমার পর্দায়। ঋত্বিক ঘটকের চিত্রনাট্যে এই সিনেমায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসলেও মূলভাব একই ছিল।
বইটিতে কাঞ্চনের বয়স ১৩ বা ১৪ দেখানো হয়, সিনেমার গল্প অনুযায়ী সেটা ৮ বা ৯ বছর। দুটো ক্ষেত্রেই বাবার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালায় কাঞ্চন। কলকাতায় তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো কম-বেশি প্রায় একই ছিল। তবে বই আর সিনেমা যদি আলাদা করে পড়েন আর দেখেন, বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়বে। এত বছর পর সেই সিনেমার খুব ভালো সংস্করণ মেলে না। ইউটিউবে মিলবে এই অদ্ভুত সুন্দর সিনেমাটি। দেড় ঘন্টা সময় কীভাবে চলে যাবে টেরও পাবেন না।
দুটো ক্ষেত্রেই কাঞ্চন কলকাতায় গিয়ে নিজের জীবনকে বুঝতে শিখেছে। উঁচুতলার মানুষ থেকে একেবারে নিচুতলার মানুষ, স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের মতো কিছু মানুষের জীবন, রেসকোর্স ময়দানে কীভাবে ঘোড়দৌড় হয়, কীভাবে একজন অসহায় মানুষের দিন কাটে- সেসব কাঞ্চন দেখেছে। তাকে পুরো সময় এক বুলবুল ভাজাওয়ালা সাহায্য করেছিল। তবে তা বইয়ে নাকি সিনেমায় সেটা আমরা রহস্যই রেখে দিচ্ছি।
বইটি রচিত ত্রিশ বা চল্লিশের দশকের দিকে। সেখানে কলকাতার কিছু চিত্র এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে মনে হচ্ছিল এটা ২০২১-এর এক গল্প। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখায় যেমন জাদু আছে, তেমনই এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে ঋত্বিক ঘটকেরও।
সলিল চৌধুরী ছিলেন সুরকার। এই সিনেমার প্রতিটি গান, সুর এত অদ্ভুত রকমের, শোনার সাথে সাথে একটা মন খারাপ অনুভূতি কাজ করে। প্রত্যেকে এত সুন্দর অভিনয় করেছে। সে কাঞ্চন হোক, মিনি, বিনোদ কিংবা বুলবুল ভাজাওয়ালা। কোনো দৃশ্যে কমতি ছিল না। তবে বই পড়ে যদি ভাবেন একইভাবে গল্পগুলো পাবেন, তাহলে একটু আশাহত হবেন। কারণ মূল কাহিনী ধরে রেখে চিত্রনাট্যকার গল্প সাজিয়েছেন পুরো নতুনভাবে।
এই যে কাঞ্চন আর বিনোদের দ্বন্দ্ব, এটা কিন্তু আজও চলে আসছে। সমাজের উঁচু-নিচু স্তরের মানুষের প্রভেদ চলমান থাকবেই। এক্ষেত্রে যেমন কাঞ্চন ছিল বিনোদের চেয়ে একটু উচ্চস্তরের, আবার কলকাতায় গিয়ে সে টের পায় সে কত আলাদা, কত নিচে।
বেড়ার ওপাশের ঘাস যেমন বেশি সবুজ লাগে, ঠিক সেরকম কাঞ্চনের ধারণা ছিল কলকাতা শহর এল ডোরাডোর মতো। সেখানে কেবল সুখ আর সুখ। বড় বড় ভবন যেমন আকাশচুম্বী, সেরকম সুখ। আমরা যেমন শুনি ঢাকার আকাশে টাকা ওড়ে, ঠিক সেরকম কাঞ্চনের ধারণা ছিল কলকাতায় টাকা ভেসে বেড়ায় আকাশে। কিন্তু তাই কি?
বাস্তব আর কল্পনার কত ফারাক- ছোট্ট কাঞ্চন মাত্র ক’দিনে বুঝে গিয়েছিল। অনুধাবন করেছিল বাবা-মায়ের আদর, নাড়ির টান কী, যাদের বাবা-মা নেই তারা কত অসহায়। নিজের গ্রামে সে দু’মুঠো ভাত তো পেত। কিন্তু এই কলকাতা শহরে সে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরবে তো?
বই এর কাঞ্চন এল ডোরাডোর জন্য পালিয়েছিল কিনা, সেটা বলব না, তবে সিনেমার কাঞ্চনকে বইয়ের কাঞ্চন থেকে একটু বেশি জীবনঘনিষ্ঠ মনে হতে পারে। বইয়ের মিনি-কাঞ্চনের দু’বার দেখা হয়নি। তবে সিনেমাতে কাঞ্চন তার মিনির দেখা পেয়েছিল। বই পড়ে যদি সিনেমা দেখেন অথবা সিনেমা দেখে যদি বই পড়েন, তাহলে স্পয়লারের আশংকা নেই।
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখায় সহজাত হিউমার পাবেন, নিজের অজান্তে হেসে উঠবেন, তবে সিনেমা দেখতে গেলে সেরকম হাসির অংশ মিস করতে পারেন কিছুটা হলেও। বাড়ি থেকে পালিয়ে বইয়ের একটি সিক্যুয়াল লেখক লিখেছিলেন মূল বই প্রকাশের বহু বছর পর। তবে সেটা নিয়ে বোধহয় আর সিনেমা তৈরি হয়নি।
বাড়ি থেকে পালিয়ে দুনিয়া দেখার সাহস সেই ছোট্ট ছেলে করেছিল প্রায় ১০০ বছর আগে। আমরা কি এখন সেই সাহস দেখাতে পারব? মনে হয় না। কারণ, হয়তো আমরা অনেক কিছু জানি, প্রযুক্তি আর বাস্তবতা হয়তো বুঝি, কিন্তু কাঞ্চন যেভাবে বুদ্ধির অধিকারী হয়েছিল, তা কি বিনোদের সেই অভিশাপ, না ঠেকে শিখে? নাকি নেহাতই কাকতালীয় ছিল সব কিছু? আচ্ছা, কাঞ্চনের এই অ্যাডভেঞ্চার কি সত্যি, নাকি কল্পনা?