বাংলাদেশে কিংবা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসার এবং বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই যার নামটি চলে আসে, তিনি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। পেশায় একজন অধ্যাপক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) হলেও তার বড় পরিচয় তিনি একজন লেখক। তাকে বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ বললে বোধহয় ভুল হবে না। সায়েন্স ফিকশনের পাশাপাশি তিনি কিশোরদের জন্য রচনা করেছেন অত্যন্ত কোমল এবং বিপুলায়তন সাহিত্যজগত। তার রচিত কিশোর-সাহিত্যগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ দখল করে আছে ‘আমি তপু’ উপন্যাসটি; অন্য সব বইকে ছাড়িয়ে বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্যে এবং আবেদনে যে বইটি একজন সুদক্ষ কিশোর-সাহিত্যিকেরই সাক্ষ্য বহন করে!
‘আমি তপু’ শীর্ষক কিশোর উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ অমর একুশে বইমেলায়, পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে। এটি মূলত এক সঙ্গীহীন কিশোরের দুঃসহ জীবনের গল্প, অন্ধকার জীবন থেকে এক কিশোরের স্বপ্নের গল্প। উপন্যাসটি লেখকের পাঠকনন্দিত কিশোর উপন্যাসগুলোর একটি।
উপন্যাসের মূল চরিত্র আরিফুল ইসলাম তপু। সে-ই এই উপন্যাসের কথক চরিত্র। ডাকনামের মতো তার জীবনটাও খুব বেশি বড় নয়, সবেমাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। কিন্তু এই ছোট্ট জীবনেই সে সাক্ষী হয়েছে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার।
তপু যখন ক্লাস ফাইভে পড়তো, তখন এক ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবার মৃত্যু হয়, অল্পের জন্য রক্ষা পায় সে নিজে। কিন্তু স্বামী হারানোর শোকে বিহ্বল তপুর মায়ের বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় তপুই তার বাবার মৃত্যুর কারণ। ফলে তপুর সাথে তার আচরণ হয়ে পড়ে প্রচণ্ড রুক্ষ। কারণে-অকারণে তপুকে মারধর করেন, তাকে সরিয়ে দেন ঘর থেকে; ক্রমাগত ছেলেটি পেতে থাকে অনাদর, উপেক্ষা আর ঘৃণা। কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যাওয়ার সাথে সাথে লেখাপড়ারও অবনতি ঘটতে থাকে একসময়ের দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্র তপুর। একসময় ফার্স্ট হওয়া ছেলেটির জায়গা হয় ক্লাসের শেষ বেঞ্চে। সহপাঠী, শিক্ষকদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তপু। তাদের কাছে সে পরিচিত হয় বখে যাওয়া চরম উশৃঙ্খল একটি ছেলে হিসেবে।
নিঃসঙ্গ কিশোরের এই দুঃসহ জীবনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় নিতান্তই অপরিচিত একজন- প্রিয়াঙ্কা। তার স্পর্শে তপু ফিরে পায় বাঁচার আনন্দ, নতুন উৎসাহে সে আবিষ্কার করে হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য, লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো। অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্যের পর নতুন করে আলোর দিকে ছুটতে থাকে তপু।
‘আমি তপু’ নিঃসঙ্গ এই কিশোরের বেঁচে থাকার ইতিহাস!
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ‘আমি তপু’ জাফর ইকবালের কিশোর-সাহিত্যগুলোর মধ্যে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে বিশেষভাবে স্বতন্ত্র। ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘রাতুলের দিন রাতুলের রাত’, ‘আঁখি এবং আমরা ক’জন’ ইত্যাদি কিশোর উপন্যাস মূলত স্কুলগামী কিশোরদের মজা, হুটোপুটি আর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। কিন্তু ‘আমি তপু’তে সেই ধারণা সম্পূর্ণ’ই মুছে গেছে। একজন কিশোরের দুঃখময় জীবন এ উপন্যাসের কেন্দ্র।
ঔপন্যাসিক তার দরদী হাতে প্রথম থেকেই বর্ণনা করে গেছেন তপুর আবেগের ওঠা-নামা আর তার আবেগী বাঁকগুলো। তপুর কোনো বন্ধুবান্ধব নেই, পরিবারের লোকেরা থেকেও না থাকার সমান- চাতকের মতো সে তৃষিত থাকে একটু স্নেহ, আদর ও ভালোবাসার জন্য। কিন্তু কেউ তা বোঝে না। সেজন্য তার স্থান হয় বাড়ির স্টোররুমে। উপরন্তু, শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটা ঘায়ের দাগ, নোংরা কাপড়, উষ্কখুষ্ক চুল সাক্ষ্য দেয় তার দুর্বিষহ অবস্থার।একাকিত্বের বর্ণনা দিতে গেয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন,
আমি বুঝতে পারলাম এই পৃথিবীতে আমরা কেউ নেই, আমি একেবারে একা। আমার চোখের পানি হঠাৎ করে শুকিয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যার চোখের পানির কোনো মূল্য নেই, এই পৃথিবীতে তার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই।
সারাদিনে তার কথা বলার সঙ্গী থাকতো মাত্র দুজন- বাড়ির কাজের মহিলা দুলি খালা এবং মিচকি নামের ইঁদুর। ইঁদুরের সাথে কথা বলার বিষয়টি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক এবং ব্যঞ্জনাময়। একদিক দিয়ে বিষয়টি কৈশোরের স্বাভাবিক ‘অদ্ভুত’ সত্তাকে ধারণ করে, আবার নিঃসঙ্গতার কোন পর্যায়ে একজন কিশোর ইঁদুরকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, তা পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারেন। বিপর্যস্ত পারিবারিক এবং ছাত্রজীবনের অধিকারী দুর্ভাগা এই কিশোর আত্মহত্যা, বাড়ি থেকে পালানোর মতো পথ খুঁজতে থাকে যন্ত্রণাদায়ক একাকিত্বের হাত থেকে বাঁচতে।
প্রিয়াঙ্কা এ উপন্যাসের যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। চঞ্চলতা, উদারতা, চটুল বুদ্ধিমত্তা তার বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের একজায়গায় প্রিয়াঙ্কা তপুকে বলছে,
আমি তোর আম্মু হব, তোর ভাই হব, বোন হব, তোর বন্ধুবান্ধব হব- দেখিস তুই, খোদার কসম!
বস্তুত হয়েছিলও তা-ই। তপুর নিঃসঙ্গ জীবনকে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে প্রিয়াঙ্কাই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তপুর ভুলতে বসা প্রতিভাগুলো সম্পর্কে প্রিয়াঙ্কাই তাকে আবার সচেতন করে। তার স্বভাবসুলভ চপলতা স্পর্শ করে তপুর জীবনকেও। তার অনুপ্রেরণাতেই হোঁচট খাওয়া কিশোর করে স্বপ্নজয়!
তপুকে অন্ধকার জীবন থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যায় প্রিয়াঙ্কার বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসা ছেলেটি যে সবসময়ই খারাপের চূড়ান্ত নয়, কোনো দৈব দূর্বিপাক হয়তো তাকে ঠেলে দিয়েছে পেছনে, তারও হয়তো একটি গল্প আছে, একটু সহমর্মিতা হয়তো তার ভেতরের ভালো মানুষটাকে বের করে আনতে পারে। কিন্তু কদাচিৎ আমরা সেই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি- ঔপন্যাসিক কি সেদিকেই ইঙ্গিত করলেন? হয়তো বা তা-ই!
এছাড়াও কৈশোরের চপলতা, ছাত্র এবং সমাজ জীবনের চিত্র উঠে এসেছে এ উপন্যাসে, এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথাও। এসবের উর্ধ্বে পুরো উপন্যাস জুড়েই কাজ করে এক ঘোর লাগা অনুভূতি। তপুর জন্য মনের কোণে পাঠক অনুভব করেন অজানা ব্যথা। তপুর দুঃখের কথাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো ঔপন্যাসিকের সংবেদনশীল কলমে। তার এ গল্প নিষ্ঠুরতার, এ গল্প ভালোবাসার- এ গল্প দুই আনুভূতিক প্রতিযোগীর যুগপৎ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং আনুপাতিক হ্রাস-বৃদ্ধির। কখনও এ দ্বন্দ্ব মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত পীড়ন, ঘৃণার বিরুদ্ধে মাতৃরূপা আরেক নারীর স্নেহ-ভালোবাসার, কখনো বা সহপাঠী-শিক্ষকদের অবহেলা, অনাদর, উপেক্ষার বিপরীতে এক অচেনা অতিথির অচিন্তনীয় ভালোবাসা, সমবেদনা ও পরার্থপরতার। তবে ঔপন্যাসিক বিশ্বাস হারাননি মানুষের ওপর। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে মানবতারই। যাবতীয় নেতিবাচকতার এপিটাফে উৎকীর্ণ হয়েছে ভালোবাসার জয়গান- এরই তো নাম মানবতা!
“চোখে পানি, আর ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি- কী বিচিত্র একটি দৃশ্য!”
শেষ পরিচ্ছেদের পর অন্তিম লাইনটি যদি পাঠকের মধ্যে মূর্ত হয়েই ওঠে, বোধকরি সেটা খুব অস্বাভাবিক হবে না!
অনলাইনে বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে