বলা চলে, ফক্স সিস্টার ‘রাই’ স্পিরিচুয়ালিজমকে নতুনভাবে প্রকাশ করেছে। এবং এক নতুন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। মৃতদের সাথে এই ফক্স বোনেদের যোগাযোগের ঘটনা তো বহুল প্রচলিত। ‘প্যারাসাইকোলজি’তেও তাদের পড়া হয়। তবে তাদের ক্ষমতার উৎস কী এবং মৃত্যুর আসল কারণ কী, সেসব উত্তর এখনো রহস্যের ধুম্রজালেই রয়ে গেছে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে ফক্স বোনেদের সত্য ঘটনার ব্রিফিংয়ের পাশাপাশি কিছুটা কল্পনা ধার করে আকর্ষণীয় এক সূচনা করেছেন লেখক— কৌতূহলোদ্দীপক অবশ্যই। পরের গোটা উপন্যাসের বীজ যে এতেই প্রোথিত।
পরের অধ্যায়েই গল্পকথক সাইফুদ্দিন বারীর সাথে পরিচয় ঘটে। পেশায় ব্যাংকার। নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চাওয়া মানুষ। তার স্ত্রী একজন রহস্যোপন্যাস লেখিকা, ছদ্মনামেই লেখেন। তারা দুজনেই ভীষণ বইপড়ুয়া, যা নিয়ে সাইফুদ্দিন সাহেব বেশ গর্বিত মনে হয়। তাই প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই বলেছেন সেটা নিয়ে। চরিত্রের বৃত্ত প্রতিষ্ঠা করতে অতটা না বললেও চলত। নিজে যে সরল, ঝামেলাহীন মামুষ তা-ও বললেন। আবার নীতির পুরোহিত যে না- সেটাও বেশ ব্যাখ্যা করলেন। ‘বেশ’ ব্যাখ্যা করায় পরবর্তী একটা কারণে, ঐ যে ঘুমন্ত মানুষকে দেখতে পছন্দ করা এক অদ্ভুত লোকের দেওয়া ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াক’ বইটি পড়ে রিচুয়ালে বসার ব্যাপার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।
তিনি নিজের মুখে যদিও বলেছেন যে, এই প্রথম জেনেবুঝে একটা ঝামেলায় তিনি অনুপ্রবেশ করেছেন। কিন্তু সেটা তার চরিত্রের বৃত্তের এই জায়গাকে পুরোপুরি ন্যায্যতা দান করে না। তার কৌতূহলী স্বভাব নিয়ে ভালো রকম বর্ণনার দরকার ছিল, এই ঘটনায় যেহেতু সে ঢুকবেই। আর রিচুয়ালে বসতে তাকে যা যা করতে হয়েছে, তাতে কৌতূহলের সাথে ভীষণ সাহসও দরকার। চরিত্রের এই বিটগুলো অনুপস্থিত। এবং পরবর্তীতে সাইফুদ্দিন আরো যেসবের সাথে জড়ায় তার সাথে, শুরুতে নিজেকে সে যেভাবে খণ্ডন করে সেটা বেশ বৈপরীত্যই আনে তার চরিত্রে। কোনো সিরিয়াস কিংবা সম্পূর্ণ ক্যারেক্টার স্টাডির গল্পে এই ব্যাপারটি তাকে ‘অবিশ্বাসযোগ্য ন্যারেটর’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করত। তবে এখানে যেহেতু গল্প থ্রিল, রহস্যের পথে হেঁটেছে, তাই বিষয়টি যে গল্পের সামগ্রিক ন্যারেটিভে একটা সূক্ষ্ম অসংহতির জায়গা তৈরি করেছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাবেন অনেকেই। ওভাবে সমস্যার কিছু না হলেও সুসংহত ন্যারেটিভের পথে বাধা হয়েছে ঠিকই।
এই সাইফুদ্দিন সাহেব রিচুয়াল করার পর বেশ ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বেশ কিছুদিন কাটান। বাহ্যিকভাবে প্রচণ্ড জ্বরই চোখে পড়ে। ভেতরের পরিবর্তন তো তখন ধরা দেবে না স্বাভাবিকভাবেই। এর মাঝে দুঃস্বপ্নে সেই ঘুমন্ত মানুষদের দেখতে থাকা, সাইফুদ্দিন সাহেবকে ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াক’ বই দেওয়া, লোকটিকে তিনি দেখতে পান। নাকি বলা যায়, এক পরাবাস্তবতা (surreal) দেখেন! মূল ঘটনা শুরু হয়, সাইফুদ্দিন বারীর অফিসের কলিগ জামাল সাহেবের মেয়ে যুথীর উধাও হবার পর থেকে। জামাল সাহেব বলেন, ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছে! অফিসে কানাঘুষা চলে, “কোনো এক ভাতার নিয়া ভাইগা গেসে।”
তবে সাইফুদ্দিন সাহেব যুথীর রুমে বুঝতে পারেন, ঘটনা বেশ জটিল। গোটা রুম, এমনকি ছাদও বিচিত্র সব রঙে আঁকা। তার ভাষায়, “পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের মতো।” ভ্যান গগের ছায়া আছে বলে তার মনে হয়। গ্রীক পুরাণের ইকারাসের ধারণার ছায়াও অন্য আরেক রুমে তিনি দেখতে পান। এবং বুঝতে পারেন, আর যা-ই হোক, প্রেমিকের সাথে কিংবা প্রেমের কারণে উধাও হবার মেয়ে যুথী নয়। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই যে এত সৃষ্টিশীল হতে পারে, তার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে, এই ব্যাপারে সাইফুদ্দিন সাহেব দৃঢ় বিশ্বাসী। তারপর একে একে রাফায়েল সাবতিনের সাথে যুথীর প্রেমের গল্প উঠে আসে। যুথীর মধ্যে দুটো দুর্লভ ক্ষমতার কথা আসে। সেসব নিয়ে লড়াইয়ে যুথীর মানসিক অস্থিতি, দ্বন্দ্বের কিছুটা চিত্র আসে। এবং সাতদিনের সময়ে সেসবের গভীরে যেতে যেতে সাইফুদ্দিন সাহেব যুথীর কী হলো, কীভাবে হলো- সেসব প্রশ্নের উত্তর পেতে শুরু করেন। রিচুয়ালে বসার ফলও আকস্মিক এক ঘটনায় পেতে শুরু করেন।
‘কহশিমিয়ান: আগমনী বার্তা’, উপন্যাসের নামেই খেয়াল করা যায় এক বড় ইউনিভার্স আনবার আহবান লেখক এতে রেখেছেন। সিক্যুয়াল এনে জগতকে আরো বিস্তার করবেন, এই আর কী। তা-ই বলে প্রথম পর্ব যে অধরা রয়ে গেছে তেমনটি নয়। সন্তোষজনকভাবেই পাঠকের মনে উদিত হওয়া প্রাথমিক প্রশ্ন, টুইস্টের ক্ষুধা এবং একটা ঠিকঠাক উপসংহারে আসতে পেরেছে। পরের পর্বে হয়তো সাইফুদ্দিন বারীর যে নতুন এক ক্ষমতা জন্মেছে, তার ডালপালা বিস্তার করা হবে। যুথীর মাঝে যেসকল দুর্লভ বিষয় ছিল সেসব নিয়ে দৃশ্যপট আরো জটিল হবে। এই-ই। শেষটা তাই রহস্যের ধুম্রজাল তৈরি করেই করা হয়েছে। সেই ফক্স বোনেদের ঘটনার অনুপ্রেরণা আরো বিস্তারিত হবে। শেষের দুটো ভাগে, “তার আগমনের সময় আদম সন্তানদের মাঝে সৃষ্টি হবে অদ্ভুত সব ক্ষমতা” এবং “তার আগমন জন্ম দেবে ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনার,” এই দুটো উক্তি দিয়ে বড় চিত্রের আভাসই দেওয়া হয়েছে।
ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভেই মূলত উপন্যাসটি এগিয়েছে। মাঝে মাঝে থার্ড পারসন ন্যারেটিভ দিয়েই এগিয়েছে। অতীতের ঘটনা ছাড়াও, বর্তমানের বেশ কিছু জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে থার্ড পারসন ন্যারেটিভ। কিন্তু সমতা মাঝে মাঝে অসম হয়ে পড়েছে। টোনের সমতা রক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। লেখক নেওয়াজ নাবিদ থ্রিলার, মিস্ট্রির পাশাপাশি সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি ও হরর আমেজের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এবং বিভিন্ন জনরার একত্রীকরণ ভালোই হয়েছে। লেজেগোবরে হয়ে যায়নি, যেটা লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে প্রশংসাযোগ্যই। নিৎশে, দান্তে-দের রেফারেন্সও ভালোই কাজ করেছে। এখনকার অনেক থ্রিলার লেখকই তো এমন বড় বড় নামগুলো নিজেদের ‘শোয়ি’ প্রবণতা থেকেই ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে, লেখক রেফারেন্সগুলোকে চরিত্রের নিরিখে যথাযোগ্যভাবেই এনেছেন।
তবে চরিত্রগুলো তৈরিতে, তাদেরকে চরিত্র হিসেবে বেড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সময় দেওয়া উচিত ছিল লেখকের। ১৪৩ পৃষ্ঠার দৈর্ঘ্য তাতে খানিক বর্ধিত হলে বিশেষ ক্ষতির কিছু ছিল না। মূল চরিত্রের সাথে পাঠকের সংযোগ স্থাপন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বাকি চরিত্রের কথা বাদ দিলেও। এক্ষেত্রে সেই জায়গায় অভাববোধ হয়েছে। চরিত্রগুলো সেভাবে মজাদার করে তুলতে পারেননি, ওই ঘুমন্ত মানুষ দেখা চরিত্রটি ছাড়া। ইন্টারেস্টিং হবার উপাদান তো ওতে ছিলই। তাকে আনাও হয়েছে সেভাবে। আরো দুই-একবার তার উপস্থিতি দরকার ছিল এই পর্বে।
লেখকের লেখনী গতিশীল। প্রথমদিকে কিছু অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কার, অতিরিক্ত এক্সপোজিশন ব্যতিরেকে দ্বিতীয়ভাগ থেকে বাক্যগঠনে বাহুল্য কমই। এক্সপোজিশনের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়নি। তবে বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে তৈরি হওয়া এই গোটা গদ্যভাষা, সামগ্রিকভাবে আরো কিছুটা বিবরণসম্পন্ন এবং অন্তর্ভেদী হবে এই প্রত্যাশা লেখকের আগামী উপন্যাস থেকে রইল।
‘কহশিমিয়ান’-এর এই জগত অনেক কিছুর সম্ভাবনা জাগায়। স্পিরিচুয়াল ওয়াক, অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাধর কোনো সত্ত্বাসহ অনেককিছুর আভাস দিয়ে যায়। পরের কিস্তিগুলোতে এসবের রহস্য যথাযথভাবে বর্ণনায় আসলে দেশীয় সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি ঘরানার বইয়ে একটা ‘ভালো’ নাম হয়ে উঠতে পারে ‘কহশিমিয়ান’ সিরিজ।