ধরুন আপনি অবসর সময়ে নিতান্তই তাচ্ছিল্যভরে রিমোট হাতে নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল বদলে চলেছেন। বিশেষ কিছু দেখার ইচ্ছা আপনার আদৌ নেই। হঠাৎ কোনো একটি চ্যানেলে একটি চলচ্চিত্র বা অন্য যেকোনো অনুষ্ঠান দেখে আপনার এতটাই ভালো লেগে গেল, কিংবা সেটির টানটান উত্তেজনাকর কাহিনী আপনাকে এমনভাবে সম্মোহিত করে ফেলল যে, সেটির শেষ না দেখে আপনি উঠতেই পারলেন না।
এই যে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করে সময়-জ্ঞান হারিয়ে ফেলা এবং অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়া অবধি দৃষ্টি টিভি সেটে নিবদ্ধ রাখা, আর্বান ডিকশনারিতে একটি চমৎকার শব্দের মাধ্যমে বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। শব্দটি হলো Shawshanked (শশাঙ্কড)।
মজার ব্যাপার হলো, এই শব্দটির উৎপত্তি গত ১১ বছর ধরে ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেস (আইএমডিবি) টপ ২৫০ তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রাখা দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন চলচ্চিত্রটি থেকে। বাণিজ্যিকভাবে বক্স অফিসে সফলতা না পেলেও, ক্যাবল টিভি চ্যানেলে প্রচার শুরু হওয়ার পর সাধারণ দর্শক এভাবেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল চলচ্চিত্রটির এবং বর্তমানে অনেকের কাছেই এটি সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র। আদতেই তা হোক বা না হোক, অধিকাংশ ইন্টারনেটবাসীর কাছে যে এটিই সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্র, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আধুনিকমনস্ক দর্শকের কাছ থেকে এতটা ভালোবাসা পেল? কেনই বা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এই ছবিটিকে এগিয়ে রাখে দ্য গডফাদার, দ্য ডার্ক নাইট, ১২ অ্যাংরি ম্যান কিংবা শিন্ডলার্স লিস্টের থেকেও, যেখানে ক্যাসাব্লাঙ্কা ও সিটিজেন কেইনের মতো ছবিগুলোর অবস্থান যথাক্রমে ৪৮ ও ৯২!
বিস্ময়ের পরিধি আরো বেড়ে যাবে, যখন জানবেন প্রথম দিকে এই ছবিটি ছিল ব্যবসায়িকভাবে চরম ব্যর্থ। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিলাভের পর ২৫ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি ঘরোয়া বক্স অফিস থেকে প্রথম দফায় আয় করেছিল মাত্র ২৮ মিলিয়ন ডলার। তাহলে বুঝতেই পারছেন, প্রাথমিকভাবে দর্শকের এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে আগ্রহ কতটা কম ছিল। অথচ মাত্র বছর তিনেক পর, ১৯৯৭ সালে এই চলচ্চিত্রটিই কিনা প্রথমবারের মতো উঠে এসেছিল আইএমডিবির তালিকার এক নম্বরে! যদিও তার কিছুদিন পরই এটি আবার দ্য গডফাদারের কাছে শীর্ষস্থান খুইয়ে দুইয়ে নেমে যায়। তবে ২০০৮ সালে এটি শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করে, এবং সেই থেকে ইন্টারনেট রেটিংয়ে এটিই একতরফা রাজত্ব করে চলেছে।
এই অভাবনীয় ঘটনার কার্যকারণ বের করার জন্য আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে আরো অনেকটা আগে, ১৯৮০ সালে। ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট নামক উচ্চাকাঙ্ক্ষী চিত্রনাট্যকার-নির্মাতার বয়স তখন সবে ২১ বছর। সাহিত্যের প্রতি প্রবল ঝোঁক তার, আর সমসাময়িক প্রিয় সাহিত্যিক স্টিফেন কিং। একদিন তিনি সাহস করে কিংয়ের কাছে চলে গেলেন ‘দ্য ওম্যান ইন দ্য রুম’ নামক গল্পটি অবলম্বনে একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণের জন্য অনুমতি চাইতে।
ড্যারাবন্ট তখন নিতান্তই অখ্যাত একজন নির্মাতা। তাই কিংয়ের কাছ থেকে তার অনুমতি না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, এর কিছুদিন আগেই কিং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তরুণ ও অখ্যাত নির্মাতারা চাইলে তার ছোট গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবে, আর এজন্য তাদেরকে দিতে হবে মাত্র ১ ডলার। তবে শর্ত হলো, চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর তারা সেটি বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন তখনই, যদি কিং অনুমোদন দেন।
কিংয়ের অনুমতি লাভের পরও ড্যারাবন্টের শর্ট ফিল্মটি সম্পন্ন করতে তিন বছর লেগে যায়। এবং শেষ বছরে তিনি এতটাই আর্থিক দুরবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে, জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রপ অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেই চাকরি থেকে প্রাপ্ত ১১,০০০ ডলারের মধ্যে ৭,০০০ ডলারই খরচ করেছিলেন শর্ট ফিল্মের পোস্ট প্রোডাকশনের কাজে। অবশিষ্ট ৪,০০০ ডলার দিয়ে তিনি কোনো রকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে ছিলেন।
কিন্তু শর্ট ফিল্ম নির্মাণের পেছনে এই যে অসামান্য সাধনা, তা বৃথা যায়নি। শেষমেশ শর্ট ফিল্মটি যা দাঁড়িয়েছিল, তা খুবই পছন্দ করেছিলেন কিং। সবচেয়ে বড় কথা, ড্যারাবন্টের প্রতি একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার। তাই বছর কয়েক পরে যখন ড্যারাবন্ট আবারো তার কাছে এসে অনুমতি চাইলেন তার আরেকটি গল্প, কিংবা বলা ভালো উপন্যাসিকা, ‘রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাবেন, তাতে দ্বিমত করলেন না তিনি। তবে এই ভেবে আশ্চর্য হলেন যে, এই উপন্যাসিকাটির কাহিনী তো এমন কিছু আহামরি নাটকীয় নয় যাকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপান্তর করা যাবে।
মূল কাহিনীর রচয়িতা নিজেই যখন এতটা সন্দিহান, তাহলে বুঝতেই পারছেন এই ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করা ছিল ঠিক কতটা দুরূহ একটি ব্যাপার। কিন্তু ড্যারাবন্ট বিশ্বাসী ছিলেন আলফ্রেড হিচককের বলা একটি উক্তিতে, “অসাধারণ একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে তোমার প্রয়োজন তিনটি জিনিস – চিত্রনাট্য, চিত্রনাট্য এবং চিত্রনাট্য।” তাই ডারাবন্টও মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন এই চলচ্চিত্রের জন্য দুর্দান্ত একটি চিত্রনাট্য রচনার কাজে।
শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য হলোও অভাবনীয় মাত্রায় ভালো। রক এন্টারটেইনমেন্টের প্রযোজক লিজ গ্লোটজার সেটি পড়ে বললেন, “আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য।” চিত্রনাট্যটি মন জয় করে নিলো রব রেইনারেরও, যিনি মাত্র কিছুদিন আগেই স্টিফেন কিংয়ের আরেকটি গল্প অবলম্বনে স্ট্যান্ড বাই মি (১৯৮৬) বানিয়ে দর্শক-সমালোচক নির্বিশেষে সকলের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ব্যবসায়িক সাফল্যও পেয়েছেন। তিনি ড্যারাবন্টকে প্রস্তাব দিলেন ৩ মিলিয়ন ডলারের, যেন চিত্রনাট্যটি তার কাছে বিক্রি করে দেন।
বলাই বাহুল্য, অত্যন্ত লোভনীয় একটি প্রস্তাব ছিল সেটি, বিশেষত ড্যারাবন্টের মতো একজনের জন্য, যার তখন দিন আনি দিন খাই গোছের অবস্থা। এই ৩ মিলিয়ন ডলার পেলে তার আর্থিক দুরবস্থাই শুধু ঘুচবে না, বরং তিনি পরিণত হবেন হলিউডের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক-প্রাপ্ত চিত্রনাট্যকারদের একজনে। কিন্তু এই প্রলোভনে টললেন না ড্যারাবন্ট। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, এই চিত্রনাট্য দিয়ে তিনি নিজেই নির্মাণ করবেন তার ক্যারিয়ারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি।
ড্যারাবন্টের এমন একগুঁয়ে স্বভাবের কারণে তিনি যে শুধু ৩ মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া করলেন, তা-ই কিন্তু নয়। পাশাপাশি দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের নিশ্চিত ব্যবসায়িক সাফল্যের সম্ভাবনাকেও গলা টিপে হত্যা করলেন তিনি। কেননা, চলচ্চিত্রটিতে অ্যান্ডি চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন টম ক্রুজ, কিন্তু অখ্যাত কোনো পরিচালকের অধীনে কাজ করে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ঝুঁকি তিনি নিতে চাননি।
তবে টম ক্রুজকে না পেলেও শেষ পর্যন্ত ড্যারাবন্ট দারুণ একটি দলকেই পেলেন চলচ্চিত্রটির জন্য। টিম রবিন্স বা মরগান ফ্রিম্যান তো বটেই, সেই সাথে তিনি পেলেন রজার ডিকিন্সের মতো একজন সিনেমাটোগ্রাফারকেও।
এবার চলে আসা যাক চলচ্চিত্রটি মুক্তির সময়কালে। শুরুতে যখন চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার ও বিশেষ প্রদর্শনগুলো হলো, তখন কিন্তু খুবই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেল চলচ্চিত্রটি। সমালোচকরা অকপটে স্বীকার করে নিলেন চলচ্চিত্রটির অসাধারণত্ব। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য যখন ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেয়া হলো, তখন দেখা গেল একদমই ভিন্ন চিত্র। সিনেমা থিয়েটার ও মাল্টিপ্লেক্সগুলো খাঁ খাঁ করছে। একটার পর একটা শো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দর্শকদের আগমন ঘটছে না।
কী কারণ হতে পারে দর্শকদের এমন অনাগ্রহের পেছনে? একটি তত্ত্ব হলো, প্রভাবশালী পত্রিকা লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে সমালোচক কেনেথ টুরান চলচ্চিত্রটি নিয়ে যে নেতিবাচক রিভিউ করেছিলেন, তা প্রভাবিত করেছিল দর্শকদের। এছাড়া অভিনেতা ফ্রিম্যানের বিশ্বাস, চলচ্চিত্রটি প্রত্যাশিত ‘ওয়ার্ড অভ মাউথ’ পায়নি। এবং সেটি না পাওয়ার কারণ নাকি এর নাম। মানুষ নিজেরা ‘শশাঙ্ক’ উচ্চারণ করতে পারলে না অন্য কাউকে বলবে!
এসবের সাথে যুক্ত হলো ভীষণ রকমের বাজে টাইমিং-ও। ১৪ অক্টোবর আরো বিস্তৃত পরিসরে চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেয়া হলো। ঠিক সেদিন, যেদিন ১,১০০ স্ক্রিনে মুক্তি পেল কোয়েন্টিন টারান্টিনোর পাল্প ফিকশন। পাল্প ফিকশন নিয়ে মুক্তির আগে থেকেই দর্শকদের মাঝে বেজায় উন্মাদনা, কেননা কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাল্ম দর পুরস্কার পেয়েছে সেটি। ফলে মুক্তির সাথে সাথেই সকল আকর্ষণ নিজের করে নিলো সেটি, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল তৎকালীন প্রজন্মের অন্যতম পপ কালচার ফেনোমেননে।
এছাড়া ভুলে গেলে চলবে না রবার্ট জেমেকিসের ফরেস্ট গাম্পের কথাও। ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি টানা ৪২ সপ্তাহ থিয়েটারে চলেছিল, বনে গিয়েছিল সর্বকালের অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। অর্থাৎ দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন যখন প্রথম পর্দায় আসে, তখনো মানুষ ফরেস্ট গাম্পেই বিভোর। তারা কেন যাবে সেটি ছেড়ে একটি প্রিজন ড্রামা দেখতে!
তবে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনকে পুরোপুরি দুর্ভাগাও বলা যাবে না। কারণ সে-ও পেয়েছিল একটি দ্বিতীয় সুযোগ। ১৯৯৫ সালের দিকে অস্কারের জন্য মনোনয়নের তালিকা ঘোষিত হলে দেখা গেল, বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ এই চলচ্চিত্রটি পেয়ে বসে আছে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা সিনেমাটোগ্রাফিসহ মোট সাতটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন! শেষ পর্যন্ত অস্কারে এই চলচ্চিত্রের ভাগ্যে কোনো পুরস্কারই জোটেনি, গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো নিয়ে গেছে ফরেস্ট গাম্প। তারপরও যে লাভটি দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের হলো, তা হলো অস্কার মনোনয়নের সুবাদে পুনরায় থিয়েটারে মুক্তির সুযোগ। এবং এবার বেশ অনেক দর্শকই থিয়েটারে গিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখল, ফলে আর্থিক ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেল। পাশাপাশি ভিডিও হোম সিস্টেম মাধ্যমেও এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক ভাড়াকৃত চলচ্চিত্রগুলোর একটির খেতাব জুটল এটির কপালে।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে যে ‘ক্লাসিক’ তকমা আজ সেঁটে গেছে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের নামের পাশে, তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য টেলিভিশনের। এক্ষেত্রে নাম করতে হবে ক্যাবল ম্যাগনেট টেড টার্নারেরও। টেলিভিশনে মানসম্মত অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য মুখিয়ে ছিলেন তিনি। তাই ১৯৯৩ সালে তিনি ক্যাসল রক এন্টারটেইনমেন্ট অধিগ্রহণ করেন। এই ক্যাসল রকই ছিল দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এরপর দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের দুর্বল বক্স-অফিস রেকর্ডের সুবাদে, তিনি নিজের কাছেই নিজে খুব কম দামে বিক্রি করে দেন চলচ্চিত্রটির টেলিভিশনে প্রচার স্বত্ব।
১৯৯৭ সালে টেড টার্নারের টিএনটি নেটওয়ার্কে প্রথম প্রচারিত হয় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। টেলিভিশনের তৎকালীন রেকর্ড ভেঙে দেয় চলচ্চিত্রটি। এবং তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই প্রচারিত হতে থাকে এটি। কেননা এই চলচ্চিত্রটির স্বত্ব টেড টার্নার পেয়েছেন অনেক কম দামে, কিন্তু এটির টিভি রেটিং বেশি হওয়ায়, এটি প্রচার করলে বিজ্ঞাপনদাতাদের পকেট থেকে বেশি ডলার খসানো যেত। ফলে টেলিভিশনের একটি নিয়মিত অনুষ্ঠানে পরিণত হয় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। তখনকার দিনে এমন কৌতুকও প্রচলিত ছিল, “টিভি ছাড়লে আর কিছু পাও বা না পাও, দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন অবশ্যই দেখতে পাবে!”
এভাবেই পুরো একটি প্রজন্ম, যাদেরকে আমরা বলে থাকি নাইন্টিজ কিডস, তারা নিয়মিত টেলিভিশনে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন দেখে বড় হয়ে উঠল। এদিকে সময়টাতে অনলাইনে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার সংস্কৃতিটাও ধীরে ধীরে চালু হতে শুরু করেছে। ১৯৯৭ সালে, অর্থাৎ দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন প্রথম টেলিভিশনে প্রচারকালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ পরিবারে ইন্টারনেট ছিল। আর চার বছর পর, ২০০১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। তো ওই সময়ে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করত, স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে অন্য যেকোনো ছবির চেয়ে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন তুলনামূলক বেশি রেটিং পেত। তাই আইএমডিবির তালিকায় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন সবসময়ই শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে।
আইএমডিবির প্রতিষ্ঠাতা কোল নিধাম মনে করেন, স্নোবল ইফেক্টের মাধ্যমে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রেখেছে তার ওয়েবসাইট। স্নোবল ইফেক্ট বলতে তিনি বুঝিয়েছেন গুটিকতক মানুষ যা শুরু করেছিল, তা পরবর্তীতে বিশালাকার ধারণ করেছে। শুরুতে হয়তো অল্প কিছু মানুষ দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনকে উচ্চ রেটিং দিয়েছে, কিন্তু তাদের দেখে বাকিরাও একই কাজ করতে শুরু করেছে, এবং এক পর্যায়ে অন্য সব চলচ্চিত্রকে পেছনে ফেলে শশাঙ্ক রিডেম্পশন চলে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন থিয়েটারে না চললেও ঘরে বসে টেলিভিশনে দেখা দর্শকদের মাঝে কীভাবে এত সাড়া জাগিয়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভ্যানিটি ফেয়ার ব্যবহার করেছে ‘গাই ক্রাই’ শব্দদ্বয়। তাদের মতে, এই চলচ্চিত্রটির প্রায় সব চরিত্রই যেহেতু পুরুষ, তাই পুরুষ দর্শকরা এই চলচ্চিত্রটি দেখতে বসে বিভিন্ন ঘটনার সাথে নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পায় এবং তাদের মধ্যে ক্যাথারসিস হয়, তারা নীরবে-নিভৃতে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নেয়, যা থিয়েটারে বসে বা থিয়েটার থেকে বের হয়ে সকলের সামনে সম্ভব নয়।
এই ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় কিন্তু নেই। কেননা আইএমডিবির রেটিং বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, নারীদের চেয়ে পুরুষরাই এই ছবিটিকে বেশি রেটিং দিয়ে থাকে। নারীরা যেখানে এই ছবিটিকে দিয়েছে গড়ে ৯.২ রেটিং, পুরুষেরা দিয়েছে ৯.৩।
সব মিলিয়ে ২১ লক্ষাধিক মানুষের দেয়া ভোটে ৯.৩ রেটিং নিয়ে আইএমডিবির তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন। আর ১৫ লক্ষের কম মানুষের ভোটে ৯.২ রেটিং নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দ্য গডফাদার (১৯৭২)। সুতরাং আমরা ধরে নিতেই পারি, খুব শীঘ্রই শীর্ষস্থান হারাবে না দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন।
তবে শেষ করার আগে বলা প্রয়োজন, এইসব জটিল রেটিংয়ের হিসাবকে যদি দূরে সরিয়েও রাখি, তাহলেও কিন্তু দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের অসাধারণত্ব এতটুকু ম্লান হবে না। চলচ্চিত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য যদি হয় দর্শকের মানসিকতাকে একটু হলেও উন্নত করা, সেক্ষেত্রে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন পুরোপুরি সফল। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে আশার প্রয়োজন এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকলে মানুষ যে পাহাড়কেও টলিয়ে দিতে পারে, সেই শিক্ষা আমরা পাই দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন থেকে। মানবজীবনে মুক্তি বা স্বাধীনতার গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা-ও আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই চলচ্চিত্র। আজকের এই অস্থির সময়ে তাই এই চলচ্চিত্রের তাৎপর্য অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েও শতগুণে বেশি।
বই-সিনেমা সংক্রান্ত চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/