মরুভূমি গ্রহ অ্যারাকিসে পাওয়া যায় বিশ্বজগতের সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ, মেলাঞ্জ, প্রচলিতভাবে যা ‘স্পাইস’ নামে পরিচিত। এই স্পাইসের মালিকানা, তত্ত্বাবধান, বাণিজ্য আর হস্তগত করার জন্য ইউনিভার্সের ক্ষমতাধর সত্ত্বাগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। এমপেরর শাদ্দাম দ্য ফোর্থের আদেশে অ্যারাকিসের দখল নেয় হাউজ অ্যাট্রেইডিসের ডিউক লেটো অ্যাট্রেইডিস। ডিউক লেটোর সম্পূর্ণ পরিবারের সাথে অ্যারাকিসে আসে তার ছেলে, পল অ্যাট্রেইডিস। পল অ্যাট্রেইডিসের অ্যারাকিস প্রবেশের মধ্য দিয়েই মরুভূমি এই গ্রহের পরিণতি ধাবিত হয় অতি বিস্ময়কর এবং তমসাচ্ছন্ন এক ভবিষ্যতের দিকে।
২০২১ সালে পরিচালক ডেনি ভিলেন্যুভ ব্যাপক সফলতার সাথে এই ক্ল্যাসিক উপন্যাসকে সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসলেন। ‘ডুন’ গুণগ্রাহীদের সাথে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের মন কেড়ে নেয় অবশেষে এই গল্পের উপযুক্ত এই অ্যাডাপ্টেশন। সামনের বছর আসছে ‘ডুন পার্ট ২’, যেখানে দর্শকরা দেখতে পারবেন প্রথম পর্বে শুরু হওয়া কাহিনীর সমাপ্তি। মাঝখানের এই সময়ে চলুন জেনে নেই এই ‘ডুন’ উপন্যাস এবং গল্পের নেপথ্যের কিছু ঘটনা।
‘ডুন’ লেখার পেছনের ঘটনা
১৯৫০ এর শেষার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন প্রদেশের মরুভূমি অঞ্চলের ঘূর্ণি খেতে থাকা বালুকে স্থির করার জন্য দেশটির কৃষি বিভাগ এক প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের কাজ ছিল বেলে বা অনুর্বর মাটিতে টিকে থাকতে পারে এমন ঘাস বা গাছ ব্যবহার করে মরুভূমির জায়গাগুলোকে স্থিতিশীল করা। অরিগনের ওই অঞ্চলের মরুভূমি এতটাই প্রতিকূল ছিল যে বালুঝড়ের প্রকোপে হাই ওয়ে, নদী, খাল, এমনকি সম্পূর্ণ শহরও আক্রান্ত হয়ে পড়ত।
এই প্রকল্পের উপরে ম্যাগাজিন আর্টিকেল লেখার জন্য অনুসন্ধানে বের হন তৎকালীন এক ফ্রিল্যান্স লেখক, ফ্র্যাংক হারবার্ট। পরিবেশের বাস্তুসংস্থান নিয়ে ইতোমধ্যে আগ্রহী এই লেখক উৎসুক হয়ে পড়েন এই বিষয় নিয়ে। তার মাথায় চিন্তা খেলা করতে থাকে যে এরকম কোনো ইকোসিস্টেম তৈরি করা সম্ভব কিনা যার মাধ্যমে এক প্রতিকূল মরুভূমি অঞ্চলকে সবুজায়ন করা যাবে। এরকম আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করতে করতেই যা হওয়ার কথা ছিল একটি ম্যাগাজিন স্টোরি, তা পরিণত হয় সমগ্র এক স্পেস অপেরার আবহযুক্ত সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসে। উক্ত প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার পরবর্তী ৬ বছর ধরে হারবার্ট রচনা করেন তার ম্যাগনাম ওপাস, ‘Dune’। ‘They Stopped the Moving Sands’ নামক এক অসমাপ্ত আর্টিকেলে ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের এই প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ‘ডুন’ লেখার পেছনে ফ্র্যাংক হারবার্টের মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে।
‘ডুন’ এবং রাজনীতি ও ধর্ম
‘ডুন’ উপন্যাসের যাত্রা যেরকম শুরু হয়েছিল বাস্তব জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, সেরকমই গল্পের প্রত্যেকটি উপাদান হারবার্ট নিজের সময়ের বাস্তবতা থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন। তার বয়স যখন ৩৫, তখন ওয়াশিংটনের এক রিপাবলিকান সিনেটরের স্পিচরাইটার হিসেবে চাকরি পান। ম্যাককার্থিইজমের চরম কাল চলছিল তখন, সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থির কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে তুমুল যজ্ঞের সময়। কম্যুনিজমকে ‘বুগিম্যান’ বা অমূল এক হুমকি বানিয়ে যেকোনো মূল্যে কম্যুনিস্ট বা কম্যুনিস্ট সমর্থকদের নির্মূল করাই ছিল এই ম্যাককার্থিইজমের মূল বিষয়বস্তু। আমেরিকান রাজনীতির ইতিহাসে এখনও যথেষ্ট বিতর্কিত এক সময় ছিল এই ম্যাককার্থিইজম। অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল এই সময়ে একদম কাছে থেকে সকল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ফ্র্যাংক হারবার্ট, এমনকি জোসেফ ম্যাককার্থি নিজেও হারবার্টের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।
তৎকালীন আমেরিকান এবং বিশ্ব রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে হারবার্ট নিজের দর্শন এবং চিন্তাধারার মিশেলে তৈরি করেছেন ডুনের রাজনৈতিক চিত্র। সম্পূর্ণ ডুন উপন্যাসের প্রধান বার্তা হচ্ছে ক্যারিশমেটিক নেতা বা ব্যক্তিত্বের কথায় প্রভাবিত হয়ে সমষ্টিগত চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করা। পল অ্যাট্রেইডিসের মধ্য দিয়ে ঠিক এই বার্তা উপেক্ষা করার ফলাফলই দেখিয়েছেন হারবার্ট। শক্তিশালী, ধর্মভীরু ফ্রেমেনদের কত সহজে বশ করে বিশ্বজগতের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে এই ‘মেসায়াহ’।
ধর্ম এবং রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগও দেখিয়েছেন হারবার্ট এখানে। উইচক্র্যাফট আর রাজনীতিকে সমানভাবে ব্যবহার করা ‘বেনে জেসেরিত’দের তৈরি করা প্রফেসির ঘোরেই ফ্রেমেনরা একযোগে সমর্থন করে মেসায়াহ পল অ্যাট্রেইডিসকে। ধার্মিক কলাকৌশলকে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করার চরম পরিণতিই হারবার্ট উপস্থাপন করেছেন পলের ‘মেসায়াহ’ হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ডুন এবং পুঁজিবাদ
পুঁজিবাদী লোভকেও চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন হারবার্ট ‘স্পাইস’ নিয়ে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ যা শুধুমাত্র এক মরুভূমি গ্রহে পাওয়া যায়- বুঝতে খুব সমস্যা হওয়ার কথা না এই স্পাইস দিয়ে যে মূলত আমাদের পৃথিবীর তেলকেই বোঝানো হয়েছে। পালাক্রমে একেক ‘গ্রেট হাউজ’ অ্যারাকিসে এসে স্পাইস মাইনিং করে গ্রহের নির্যাস শোসন করে নিয়ে যাচ্ছে, গ্রহের মূল বাসিন্দা ফ্রেমেনদের বর্বর জাতি হিসেবে গণ্য করছে। স্পাইস নিয়ে সর্বদা ক্ষমতার এবং বাণিজ্যিক বিবাদ লেগেই থাকে- ’৬৫ সালে লিখলেও আজকের পৃথিবীর সাথে কী ভয়ংকর মিল!
ডুন এবং জলবায়ুর পরিবর্তন
মরুভূমি গ্রহ, ইকোসিস্টেম ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়, পুঁজিবাদী লোভের কারণে তুচ্ছ কিন্তু ভয়াল যুদ্ধবিগ্রহ- সবকিছুতেই পাওয়া যায় জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়া। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে যে জরুরি একটি ইস্যু, ১৯৬০ এর দিকে মোটেও সেরকম কিছু ছিল না। তখন অধিকাংশ মানুষের কাছে এটা ছিল হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। তবে কীভাবে ১৯৬৫ সালে ফ্র্যাংক হারবার্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই বিশাল উপন্যাস লিখলেন?
হারবার্টের বাসা ছিল ওয়াশিংটন স্টেটে, যেখানে বসবাস ছিল দুই আমেরিকান আদিবাসী গোত্রের। তাদের সাথে হারবার্টের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। সব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তন তখনও না পৌঁছালেও তারা ইতোমধ্যে প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলেন এই বিপর্যয়ের প্রভাবে। তাদের কাছ থেকেই হারবার্ট জানতে পারেন উক্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এবং এর মূলে থাকা উগ্র শিল্পায়নের ভূমিকা সম্পর্কে। এভাবেই সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে ওঠে ‘ডুন’ সিরিজের আরেক মূল্যবান পটভূমি।
অদ্ভুত সব অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা, চমকপ্রদ অ্যাকশন, রাজনীতির মারপ্যাঁচ, সাথে বিশাল প্রশস্ত স্যান্ডওয়ার্ম- সব মিলিয়ে ‘ডুন’-এ রয়েছে এপিক সায়েন্স ফিকশনের প্রত্যেকটি উপাদান। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং সুপরিচিত ‘Star Wars’-সহ প্রচুর সায়েন্স ফিকশন প্রভাবিত হয়েছে ডুন থেকে। তবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশনের তালিকার শুরুর দিকে এই সিরিজের নাম আসে ভিন্ন আরেক কারণে।
৬টি বইয়ের এই সিরিজে লেখক ফ্র্যাংক হারবার্ট তুলে ধরেছেন ক্ষমতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কঠোর কিছু চিন্তা উদ্রেক করার মতো পর্যবেক্ষণ। হন তিনি রাজা, বাদশাহ, গণতন্ত্রের প্রতিনিধি বা স্বৈরশাসক- শাসকদের প্রকৃতি এবং ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে হারবার্ট গভীর অন্বেষণে গিয়েছেন ডুনের বইগুলোতে। ১৯৫০/৬০ এর আমেরিকান রাজনীতির একদম ভেতরে থেকে তিনি এই বিষয়ে সংগ্রহ করেছেন অসামান্য জ্ঞান। রাজনীতির মোড়ে, বিভিন্ন বাঁকে তিনি পরিচিত হয়েছেন মনুষ্যত্বের বিচিত্র ধরনের সাথে। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ক্যারিশমেটিক বা মধুভাষী নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে গিয়েছেন তিনি পল অ্যাট্রেইডিসের চরিত্রে। মনোমুগ্ধকর গল্প এবং চমকপ্রদ অ্যাকশনের মধ্যে মানবচরিত্র এবং মানবজাতি নিয়ে উপরে আলোচিত কিছু সত্যের কারণেই প্রায় ৬০ বছর পরে আজও ফ্র্যাংক হারবার্টের অনবদ্য এই সৃষ্টির আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি।