বর্তমান বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের যে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ক্লাসের পড়াশুনার বাইরে সর্বপ্রথম কার বই পড়েছিলেন কিংবা ফেসবুকে বর্তমানে যারা লিখালিখির চর্চা করে থাকেন তাদের প্রেরণার উৎস কী বা কে? তাহলে অনেকের উত্তরে অবধারিতভাবে আসবে একটি নাম। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। এই কিংবদন্তী সাহিত্যিকের সবচে’ বড় গুণ তিনি তার জাদুকরী লিখনি শক্তির মাধ্যমে পাঠকের সম্পূর্ণ হৃদয় আচ্ছাদিত করে তুলতেন। কোনো পাঠক হুমায়ূন আহমেদের একটি বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা পড়েছেন, কিন্তু পুরোটা শেষ করেননি এমনটা বোধহয় কখনো হয়নি। তার প্রতিটি লেখাই পাঠক পড়েছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কীভাবে পড়তে, লিখতে ও কল্পনা করতে হয়, কীভাবে সৌন্দর্যের প্রতি বিমোহিত হতে হয়, কীভাবে বাঁচতে হয়, ভালবাসতে হয়- এমন জিনিসগুলো এক অন্য আঙ্গিকে তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন।
বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। শুভ্র, বাকের ভাই, হিমু, মিসির আলিসহ অসংখ্য কালজয়ী চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন তিনি। এবং এসব চরিত্রকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ জীবন্ত রুপে। পাঠক বার বার বিভ্রান্ত হয়েছে এই ভেবে যে আসলে সে উপন্যাস পড়ছে নাকি বাস্তবতা লোপিত কোনো গল্প। পাঠককে বিভ্রান্ত করেছেন তার বিখ্যাত দুটি চরিত্র হিমু ও মিসির আলির লজিক এবং এন্টি লজিক দিয়ে। দুটি চরিত্র একই মুদ্রার দুটি ভিন্ন পিঠ হলেও দুটি চরিত্রকেই তিনি বেঁধেছেন অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক আবেগীয় সেতু বন্ধনে। আর এই সেতু বন্ধনের এক পাড়ে বেশ জোরালো ভিত্তি স্থাপন করে বহু পাঠকের মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন হুমায়ূন সাহিত্যের অনন্য এক সৃষ্টি, মিসির আলি।
বাংলাদেশের শার্লক?
শার্লক হোমসকে আমরা কে না চিনি! যিনি ইংল্যান্ডের এপার থেকে ওপার চষে বেড়ান চোখের নিমিষেই। তিনি ব্যবহার করেন ল্যাবরেটরি। সরকারী প্রয়োজনীয়তাও মেটান, এ জন্য অবশ্যি সব ধরনের সুযোগ সুবিধাও পেয়ে থাকেন। প্রযুক্তির ব্যবহার তার কাজের ধারাকে করেছে আরো গতিশীল। এর পাশাপাশি ঘড়ির কাটা মেনে চলা ইংল্যান্ডের পথে প্রয়োজনীয় তথ্য মিলে যায় বেশ সহজেই।
সেখানে থেকে একটু ফিরে আসুন বাংলাদেশের দিকে। চোখ বুজে কল্পনা করুন এখানকার অবস্থা। কী দেখছেন? সরকারী সুযোগ সুবিধা নেই, নেই ভাল কোনো ল্যাব যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাবে। এমনকি অনেক সময় প্রয়োজনীয় বইয়েরও সঙ্কট দেখা যায়। এর মধ্যে কোনো প্রকার লাভের আশা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র স্ব-ইচ্ছাকে পুঁজি করে কাজ করে যাচ্ছেন একজন বাংলাদেশি রহস্য উন্মোচনকারী। তিনি মিসির আলি, যার কোনো সহযোগী কিংবা কোনো বন্ধুকেও আমরা চিনি না যার কথা আমরা সাগ্রহে বলতে পারি।
কে এই মিসির আলি?
উপন্যাসে অনুযায়ী ৪০-৫০ বছর বয়স্ক মিসির আলির মুখ লম্বাটে। লম্বাটে মুখে রয়েছে এলোমেলো কিছু দাঁড়ি, চুলগুলো উসকো খুসকো। তবে এত বয়সের মাঝেও খুব শক্ত করে ধারণ করেছেন তার স্মৃতিশক্তি। এই বয়সেও নির্বিঘ্নে ধূমপান করেন এবং অবধারিতভাবে যেতে হয় হাসপাতালে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। চাকুরি জীবনে কাজ করে যাচ্ছেন বেশ সম্মানের সাথে।
মিসির আলি যুক্তিতে বিশ্বাসী। তার মতে দুইয়ে দুইয়ে সবসময় চার হবে। তিনি মনে করেন সমগ্র পৃথিবী যুক্তি এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা নির্ভর, এখানে রহস্যময়তার কোনো স্থান নেই। প্রতিটি কাজেরই একটি বাস্তবসম্মত কার্যকারণ আছে। আর তাই যেকোনো রহস্য পেলেই তা উদঘাটনে নেমে পড়েন মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্নসহ নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অপার আগ্রহী এই ব্যক্তিত্ব। এ সম্পর্কে মিসির আলির স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ বলেন, “মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা”। (১)
‘দেবী’ নামক উপন্যাসের মাধ্যমে আবির্ভাব হয় মিসির আলির। দেবীতে একটি দম্পতি এবং মিসির আলির একজন ছাত্রীর গল্প উঠে আসে। নানান রহস্যময়তার মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যেতে থাকলেও মিসির আলি সেসব রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন। কিছু রহস্য উদঘাটনের পরও আরও কিছু রহস্য থেকে যায়। সে অব্যাখ্যাত রহস্য সম্পর্কে জানতে হলে পড়তে হবে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’।
মিসির আলি সিরিজের পরবর্তী উপন্যাস ‘নিশীথিনী’। এ উপন্যাস ভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠলেও চরিত্রগুলো ছিল প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’র অনুকরণে। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে মিসির আলির জনপ্রিয়তা। একে একে প্রকাশ পেতে থাকে নিষাদ, অন্য ভূবন, বৃহন্নলা, বাঘবন্দি মিসির আলি, কহেন কবি কালিদাস, হরতন ইশকাপন, মিসির আলির চশমা, মিসির আলি, আপনি কোথায়? এর মতো জনপ্রিয় সব উপন্যাস।
এসব উপন্যাসে মিসির আলির মূল বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন স্তরের মনোরোগী। যারা এমনিতে সুস্থ, কিন্তু ভেতরে মারাত্মক রকমের অসুস্থ। এরকম কোনো কোনো উপন্যাসে দেখা যায় শারীরিক অক্ষমতা সম্পন্ন কোনো যুবকের কথা উঠে এসেছে, কোথাও আবার কোনো যুবককে বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এসবের মধ্যে কেউ ছিল প্রচণ্ড পরিমাণে ভীত, আবার কেউ ছিল ভয়ঙ্কর রকমের খুনি। কোনো কোনো গল্পে এসেছে বিভিন্ন জীন, ভূতের গল্প। তবে এসব ভয়-ভীতি, সিজোফ্রেনিয়া রোগী, ভুত-জীন কোনো কিছুই স্থায়ী হতে পারেনি মিসির আলির তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সুচারু জ্ঞানের প্রয়োগের সামনে। তিনি যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন একেকটি জটিলতা এবং ক্রমে দূর হয়েছে রহস্যময়তার ধোঁয়াশা।
তবে এর মানে এই নয় যে, সকল রহস্যই তিনি সমাধান করতে পেরেছেন। অনেক ঘটনা রয়ে গেছে যেসব তিনি পরিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পারেননি। আবার অনেক স্থানে তিনি রহস্য উদঘাটনের চাইতে সমস্যা আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের দিকেই বেশি পরিমাণে মনোনিবেশ করেছেন। এতে করে তার বহুমাত্রিক রুপের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
মিসির আলির অমনিবাস
হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ উপন্যাসে হিমুর সাথে মিসির আলির সাক্ষাৎ হয়। তবে সেই উপন্যাসে মিসির আলি শুধুমাত্র নাম চরিত্রে ছিলেন, কিন্তু তার বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না, তাই সেটি মিসির আলি সম্পর্কিত উপন্যাস হিসেবে গৃহীত হয় না। এটি বাদে হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি সম্পর্কিত উপন্যাসের সংখ্যা ২০টি এবং গল্পগ্রন্থ ১টি। চোখ, জিন-কফিল ও সঙ্গিনী নামের তিনটি ছোট গল্পের মিশ্রণে প্রকাশিত হয়েছে ‘ভয়’ নামক গল্প গ্রন্থটি। যারা মিসির আলির সাথে পরিচিত নন তারা চাইলেই পড়ে নিতে পারেন বইটি। প্রচণ্ড পাঠক প্রিয়তার কারণে মিসির আলি অমনিবাস ১ ও ২ নামে মিসির আলি সিরিজের দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আর মিসির আলির ১৬টি উপন্যাস একত্রিত করে অনন্যা প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছে ‘মিসির আলি সমগ্র’।
মিসির আলির তুমুল জনপ্রিয়তায় চরিত্রটি নিয়ে বেশ কয়েকটি নাটক তৈরি করা হয়। এবং প্রচারিত হয় বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী টিভি চ্যানেলে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে এবং প্রস্তুতি চলছে মুক্তি প্রদানের। চলচিত্রটিতে মিসির আলির ভূমিকা অলঙ্কৃত করেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। এছাড়া সিনেমাটিতে আরো অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, শবনম ফারিয়া, অনিমেষ আইচসহ অনেকে।
মিসির আলি’র চরিত্রের একটি বিশেষ দিক হলো তিনি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে পছন্দ করেন এবং সে অনুযায়ী চলেন। তিনি যেকোনো কিছু খুব সাধারণভাবেই দেখেন। দেখতে দেখতে যখন কোনো খুঁত ধরা পড়ে, তখন সেই খুঁত থেকে শুরু করেন। প্রথমে বিভিন্ন প্রকল্প (হাইপোথেসিস) দাঁড় করান এবং অনুসন্ধান চালান। অনুসন্ধান কাজে তিনি পুলিশি ফাইল, পুরাতন ক্যালেন্ডার, ডাক বিভাগসহ সম্ভাব্য সকল স্থান থেকেই তথ্য সংগ্রহ করেন। এতে তার অনুসন্ধান অনেকটা অর্থবহ হয় এবং পূর্ণতার দিকে এগোতে থাকে। এক সময় ঠিকই রহস্য উন্মোচন করেন। আর এখানেই সাধারণ মানুষের সাথে মিসির আলির মূল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
মিসির আলির প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে অনেকই মিসির আলিকে বাস্তব ভেবে তালগোল পাকিয়েছেন। অনেকে আবার মিসির আলির স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদকেই মিসির আলি বলে অভিহিত করেছেন। এরুপ বিড়ম্বনায় থাকাকালীন হুমায়ূন আহেমদ বলেন, “না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি- আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনও মিসির আলির মতো মনে করি না প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।”
হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি নাকি মিসির আলির সত্যিই কোনো বাস্তব রুপ আছে তা আমরা জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি মিসির আলি বলতে কেউ থাকুক আর না থাকুক, মিসির আলি সম্পর্কিত আর নতুন কোনো উপন্যাস আমরা পাচ্ছি না। মিসির আলির নতুন কোনো রহস্য উদঘাটনের সাক্ষীও হতে পারছি না। কারণ মিসির আলির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন তারই স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ। কেননা তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক দূরের একটা দেশে। হয়ত সেখানেও পেতেছেন অন্য কোনো মিসির আলির গল্পের আসর। তবে পৃথিবীর মিসির আলির এখন কোনো কাজ নেই। সে কারণে মিসির আলি প্রেমীদের আক্ষেপেরও শেষ নেই।
ফিচার ইমেজ সোর্স – ফ্লিকার
তথ্যসূত্র ১ – মিসির আলির কথা”, হুমায়ূন আহমেদ, মিসির আলি অমনিবাস ১; ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩