বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে প্রিয় বলিউড সিনেমার কথা জিজ্ঞেস করলে, অধিকাংশই সাত-পাঁচ না ভেবে অকপটে থ্রি ইডিয়টস সিনেমার নাম বলে দেবে। ২০০৯ সালে মুক্তির পর পরই আমির খানের এই সিনেমা সিনেপাড়ায় জমিয়েছিল ব্যাপক হৈ-হুল্লোড়। হিরানি তার চমকপ্রদ প্রদর্শনীতে বুঁদ করে রেখেছিল ছেলে-বুড়ো সকলকে। মুক্তির পাক্কা একযুগ পার হয়ে গেলেও থ্রি ইডিয়টস তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে এখনো, হয়ে গেছে বলিউডের কাল্ট-ক্লাসিক। এই সিনেমার দর্শকপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম, ভবিষ্যতেও আলোচনা হবে সমানে। বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্রের জানা-অজানা নানা দিক নিয়েই আজকের এই লেখা।
১.
র্যাঞ্চোকে পুরো সিনেমাতেই ছাত্রাবস্থায় দেখা গেছে। ২০০৯ সালে যখন থ্রি ইডিয়টস মুক্তি পায়, র্যাঞ্চোর চরিত্রে অভিনয় করা আমির খানের বয়স তখন ৪৪ বছর! কলেজের প্রিন্সিপালের চরিত্রে হাজির হওয়া বোমান ইরানির সাথে আমির খানের বয়সের পার্থক্য ছিল মাত্র ৫ বছর।
২.
এই সিনেমার জন্য আমির খানের জায়গায় প্রথম শাহরুখ খানকে নিতে চেয়েছিলেন রাজকুমার হিরানি। কিন্তু বলিউড কাল্ট ক্লাসিক ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমার জন্য থ্রি ইডিয়টস মুভির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে শাহরুখকে। এমন দুর্দান্ত এক সিনেমার অংশ না হতে পারায় অবশ্য শাহরুখের আফসোসের কমতি নেই। বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ে তিনি তা উল্লেখ করেছেন। মাধবন ও শারমান জোশিকে প্রাথমিকভাবে বাছা হয়নি এই সিনেমায়। শুরুতে পরিচালকের ইচ্ছা ছিল ফারহান ও রাজুর চরিত্রে জন আব্রাহাম ও সাইফ আলী খানকে নেওয়ার। শোনা যায়, এরশাদ ওয়ারসিকেও রাজু অথবা ফারহান যেকোনো একটা চরিত্র বেছে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন হিরানি। কিন্তু অন্য মুভির শুটিং শিডিউল জটিলতায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
৩.
এই ফিল্মের শুটিং হয়েছে একটু উল্টোভাবে। মুভিতে দেখানো বর্তমান দিনের কাহিনির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে প্রথমে, কলেজের কাহিনি ক্যামেরায় ধারণ করা হয় এর পরে। আমির খান র্যাঞ্চো চরিত্রের জন্য পোশাকআশাক এবং বাচনভঙ্গির ধারণা নিয়েছিলেন এ. আর. মুরুগাদোসের কাছ থেকে, যিনি আমির খানের গজনী সিনেমার পরিচালক।
৪.
আমির খানের র্যাঞ্চো চরিত্রটি উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারের স্পষ্ট এক প্রতিচ্ছবি। ওখানের এক দৃশ্যে র্যাঞ্চো বোঝাতে চেয়েছিল- মানুষ প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, তারপর ম্যানেজমেন্টে যায়, এরপর ব্যাংকার হয়ে যায়, এবং এটাই দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মূল চক্র। ভারতীয় লেখক চেতন ভগত তার ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ বইয়েও ঠিক একই সুরে কথা বলেছেন। এমনকি চেতন ভগত নিজেও আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং আইআইএম থেকে ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি নিয়ে শেষমেশ ব্যাঙ্কের চাকরি নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, থ্রি ইডিয়টসের গল্প চেতন ভগতের এই ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান বই থেকেই অনুপ্রাণিত।
৫.
সিনেমায় র্যাঞ্চো, রাজু এবং ফারহানের মাতাল হবার একটা দৃশ্য আছে। আমির খানের পরামর্শ অনুযায়ী ওই দৃশ্যে সবাই বাস্তবেই মাতাল হয়েছিলেন। ফলে, নিখুঁত শট পাওয়ার জন্য অনেকগুলো রিটেক শট নিতে হয়েছিল। এর জন্য ক্যামেরা রোলও শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং পুরো ইউনিটকে ব্যাঙ্গালোরে (যেখানে ফিল্মের বেশিরভাগ অংশ শুট করা হয়েছে) গিয়ে পুনরায় শট নিতে হয়েছে।
৬.
২০১৩ সালে প্রখ্যাত হলিউড পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ এই মুভিকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছেন। তিনি তার অন্যান্য প্রিয় পাঁচ সিনেমা “The Godfather” (1972), তার নিজ মুভি “E.T. the Extra-Terrestrial” (1982), “Saving Private Ryan” (1998) and “Jaws” (1975) এর সাথে থ্রি ইডিয়টসকে স্থান দিয়েছেন।
৭.
এই সিনেমা ভারতীয় মুভি হিসেবে আইএমডিবিতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত সিনেমা। আইএমডিবি টপ ২৫০ লিস্টে এর অবস্থান ৮৬ তম। বর্তমানে প্রায় ৪ লক্ষ ১০ হাজার ভোটে এই সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৮.৪ এবং রোটেন টম্যাটোজে এটি ১০০% ফ্রেশ।
৮.
শরীর ভাঙা-গড়া যেন আমির খানের জন্য বাঁ হাতের খেল। চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য শরীরকে যেকোনো আকৃতিতে নিতে রাজি থাকেন তিনি। থ্রি ইডিয়টসও এর ব্যতিক্রম নয়। ৪৪ বছরের আমির খান নিজের চেহারায় ছাত্রসুলভ ভঙ্গি আনার উদ্দেশ্যে মোট ৮ কেজি ওজন কমিয়েছিলেন। খুবই টাইট শিডিউলের ডায়েট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। পেটানো শরীরের গজনী মুভির সেই এইট প্যাক থেকে থ্রি ইডিয়টসের সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীর রূপে নিজেকে রূপান্তর করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। তা-ও মাত্র এক বছরের ব্যবধানে। কিন্তু সেটা করে দেখিয়েছেন বলিউডের পারফেকশনিস্ট আমির খান।
৯.
এই সিনেমার অধিকাংশ শুটিং সম্পন্ন হয়েছে ব্যাঙ্গালোর শহরে। ছাত্রদের স্বভাব ভালোভাবে আয়ত্ত করার জন্য আমির খান হোটেলের বদলে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেছিলেন। শারমান জোশি তা মেনে নিলেও মাধবন তা মানতে চাননি। পরে আমির খানের জোরাজুরিতে তিনিও রাজি হয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, শুটিং বিরতিটা আমির খান হোস্টেলের ছাত্রদের সাথে দাবা আর টেনিস খেলে পার করতেন।
১০.
শুধুমাত্র থ্রি ইডিয়টস মুভিতেই যে আমির খান, মাধবন, আর শারমান জোশি একসাথে জোট বেধেছেন ব্যাপারটা এমন হয়। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাং দে বসন্তী’ মুভিতেও তাদেরকে একইসাথে রূপালী পর্দায় দেখা গেছে। রাজকুমার হিরানি হয়তো বা এই সিনেমার কাস্টিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদেরকে বেছে নিয়েছেন।
১১.
রাজু হিরানি প্রথমে সিনেমার নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘ইডিয়টস’। কিন্তু এই নাম রেজিস্টার করে রেখেছিলেন দীপক শিভদাসানি। থ্রি ইডিয়টসের প্রযোজক অনেক অনুরোধ করেও মন গলাতে পারেননি দীপকের। উল্টো তিনি এই টাইটেল বিক্রির জন্য মোটা অংকের অর্থ দাবী করে বসেন। সিনেমার টাইটেল ‘থ্রি ইডিয়টস’ রাখার বুদ্ধি রাজু হিরানিকে দেন আমির খান। সিনেমা মুক্তির পর ব্যাপক সাড়া পাওয়া ‘থ্রি ইডিয়টস’ শব্দটাই একটা ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপমহাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনজনের গ্রুপকে মজার ছলে প্রায় সময়ই থ্রি ইডিয়টস বলে ডাকতে দেখা যায়।
১২.
ফুংসুক ওয়াডুর চরিত্রটি নেওয়া হয়েছে বাস্তব জীবনের প্রকৌশলী সোনম ওয়াংচুকের থেকে। লাদাখে তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করেছেন, যেখানে পুঁথিগত বিদ্যা বাদ দিয়ে সব হাতে কলমে শেখানো হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের লে জেলার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করা সোনম নিজ প্রচেষ্টায় শ্রীনগর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ চুকান। তখন তিনি নিজ গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে গিয়ে দেখেন, সেখানে দশম শ্রেণী পাশের হার মাত্র ৫%। এই সমস্যা সমাধানে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে ভর্তি হলে দশম শ্রেণীতে ফেল করা হবে। এরপর থেকে শুরু হয় সোনমের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ। পিছিয়ে পড়া লাদাখি সমাজের উন্নয়নে তার ম্যারাথন লড়াই আজ সারা পৃথিবীর অনুপ্রেরণা। বাকি গল্প সকলেরই জানা।
১৩.
থ্রি ইডিয়টস চারিদিকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি।
২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চেতন ভগত তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটের এক ব্লগপোস্টে জানান,
“আমাকে বলা হয়েছিল থ্রি ইডিয়টস মুভিতে আমার ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান বই থেকে ২-৫% অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিনেমা দেখার পর মনে হলো, আমার ৭০% কাহিনি এই মুভির গল্পে মেরে দেওয়া হয়েছে।”
১৪.
এই সিনেমার একমাত্র রোমান্টিক গান “জুবি ডুবি” গানটি মূলত বলিউড কিংবদন্তি রাজ কাপুর এবং তার ‘শ্রী ৪২০’ মুভির বিখ্যাত গান ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’কে নিবেদন করা হয়েছে। রাজ কাপুরের জায়গায় আমির খান এবং নার্গিসের জায়গায় কারিনা কাপুর অভিনয় করেছেন। এই কারিনা কাপুর আবার সম্পর্কে রাজ কাপুরের নাতনি।
১৫.
রাজকুমার হিরানি তার প্রথম মুভি ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ (২০০৩) বানানোর সময়ই তিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া বন্ধুকে নিয়ে একটা গল্পের খসড়া বানিয়েছিলেন। থ্রি ইডিয়টসই রাজকুমার হিরানির একমাত্র সিনেমা যেটাতে সঞ্জয় দত্ত নেই। তবে, সাঞ্জুর ক্যামিও থাকার কথা ছিল এই সিনেমায়, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি পরে। বলিউড অভিনেত্রী কাজলেরও লিড রোল কিংবা ক্যামিওতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা ব্যাটে-বলে আর মেলেনি।
১৬.
আনুশকা শর্মা পিয়া চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন। এক ছাত্রের চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন বর্তমান বলিউডের জনপ্রিয় মুখ ও ভার্সেটাইল অভিনেতা বিজয় ভার্মা। বোমান ইরানি শুরুতে ভাইরাস চরিত্রে অভিনয় করতে মানা করে ইরফানকে খানকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কী মনে আবার নিজেই ফিরে এসেছিলেন।
১৭.
থ্রি ইডিয়টস মুক্তির পর বলিউডের সকল বক্স অফিস রেকর্ড আবার নতুন করে লিখতে হয়। ১২.৭৮ কোটি রুপির ওপেনিং দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এর। প্রথম উইকেন্ডে নেট ৪০.৬৫ কোটি রুপি পকেটে পুরে গজনীর উইকেন্ড রেকর্ড ভেঙে দেয় থ্রি ইডিয়টস। ১ সপ্তাহে ৭৯.০৭ কোটি রুপি আয় করে আবার এটি ভাঙে গজনীর রেকর্ড। ১০ সপ্তাহে শেষে প্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসেবে ডমিস্টিকে ২০০ কোটির ল্যান্ডমার্ক স্পর্শ করে থ্রি ইডিয়টস। এর আগে আমির খানই প্রথম ১০০ কোটির ঘর ছুঁয়েছিলেন গজনী দিয়ে।
ওভারসীসেও জমিয়ে ব্যবসা করেছে এই ফিল্ম। ১১৮ কোটি রুপির গ্রোস কালেকশন নিয়ে এই সিনেমার বিশ্বব্যাপী গ্রোস কালেকশন ছিল ৪৫০ কোটি রুপির উপরে। ৫৫ কোটি রুপি বাজেটে নির্মিত এই সিনেমা সেই হিসেবে অলটাইম ব্লকবাস্টার খেতাব পেয়েছে।
১৮
অ্যাওয়ার্ড শো’তেও একপ্রকার আগুন লাগিয়ে দিয়েছে থ্রি ইডিয়টস। ৫৫তম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে ১৪ মনোনয়নের ৬টি (সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা ডায়লগ, সেরা চিত্রনাট্য ইত্যাদি), ৫৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে ৩ মনোনয়নের মধ্যে সবগুলো, ১১তম আইআইএফএ অ্যাওয়ার্ডে ২২ মনোনয়নের মধ্যে ১৬টি সহ সারাবিশ্ব থেকে মোট ৬৬টি পুরস্কার নিজ ঝুলিতে পুরে নেয় কাল্ট ক্লাসিক এই সিনেমা।