একটি গণপরিবহনে যেমন অনেক ধরনের মানুষ ওঠে, বইকে যদি মস্তিষ্ক নামক রাস্তার পরিবহন ধরি, সেখানেও যাত্রীবেশে দেখা মিলবে সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প, বিজ্ঞান, ধর্মসহ নানাবিধ তথ্য ও তত্ত্বের। যা কিছু সুন্দর, সবটাই উঠে আসে বইয়ের পাতায়। মানসিকতার বিকাশ কিংবা আধুনিকতার চর্চা থেকে শুরু করে অতীতের সঙ্গে সংযোগ আর ভবিষ্যতের পথে পদচারণে বইয়ের চেয়ে বড় মাধ্যম দ্বিতীয়টি নেই।
সুস্থ ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটায় বই। মস্তিষ্কে সৌন্দর্যের ফুল ফোটায় বই। একজন বইপ্রেমীর ভালো থাকার সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ বই। মন খারাপে পড়া হয়, মন ভালোতে পড়া হয়। বইয়ের জন্য আলাদা দিন লাগে না। তবু, ১৯৯৫ সাল থেকে বছরের একটি দিন শুধুই বইপ্রেমীদের। তেইশে এপ্রিল!
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৯৯৫ সালে প্রথমবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব বই দিবস। যদিও ১৯২৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল স্পেনে পালিত হয়ে আসছিল বই দিবস। বই দিবসের মূল ধারণা আসে স্প্যানিশ লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত লেখক মিগেল দে কার্ভেন্তেসের অন্ধ অনুরাগী। কার্ভেন্তেসের মৃত্যু হয়েছিল ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। দিনটিকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে স্পেনে দিবসটির প্রচলন করেন ক্লাভেল আন্দ্রেস।
২৩ এপ্রিলকে বিশ্বসাহিত্যের এক অদ্ভুত দিন বলা চলে। এই দিনে জন্ম নেন কলম্বিয়ান লেখক ম্যানুয়েল মেহিয়া। একই দিনে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, মিগেল দে কার্ভেন্তেস, এবং স্প্যানিশ পেরুভিয়ান লেখক ইনকা গার্তিলাসো লা ভেগা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হওয়া ইউনেস্কোর সম্মেলনে গৃহীত হয় প্রস্তাবটি।
প্রতি বছর বই দিবসে জাতিসংঘ ঘোষণা করে বইয়ের রাজধানী। পরবর্তী এক বছরের জন্য বইয়ের রাজধানী হিসেবে ঠিক করা নির্দিষ্ট একটি শহরকে। এতে মূলত সেই শহরে বইয়ের প্রচার, প্রসার, মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে কাজ করা হয়। ২০২৩ সালে বইয়ের রাজধানী ঘানার আক্রা শহর। ২০২২ সালে এটি ছিল মেক্সিকোর গুয়াদালাজারা এবং ২০২৪ সালে রাজধানী হবে ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ।
আমরা প্রায়ই বলি, পৃথিবী বইয়ের হোক। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, পৃথিবী সবসময় বইয়েরই ছিল। আমি, আপনি বই না পড়লেও দুই এই মলাটের বিস্ময়ের সদম্ভ পদচারণায় মুখর ছিল পৃথিবী, থাকবে আগামীতেও। একটা সময় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখতো বইপ্রেমীরা। নব্বইয়ের দশকের বাঙালি কিশোর-কিশোরীরা লুকিয়ে, ঘুম বাদ দিয়ে বই পড়তে গিয়ে মায়ের হাতে মার খায়নি- এমন খুব কমই পাওয়া যাবে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নে এখন পড়ার আগ্রহ কমেছে। নতুন পাতার ঘ্রাণ মাখার বদলে হাতের মুঠোয় এসেছে পিডিএফ, ইবুকের মতো আধুনিক সংস্করণ। তবু, যারা পড়ুয়া তারা সবসময়ই পড়েন। পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের এগিয়ে নেন বাকি আর দশজনের চেয়ে।
বই পড়ার মাহাত্ম্য বলে শেষ করা ভীষণ কঠিন। বিশ্বব্যাপী বইয়ের প্রচারণা বাড়াতে একটি গতিশীল পৃথিবী গঠনে ইউনেস্কোর এই উদ্যোগ সারাবছরই বয়ে চলে বইপোকারা। লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিনটি যেন উৎসব নিয়ে আসে সংশ্লিষ্টদের মনে। বই দিবস ছাড়াও ২৩ এপ্রিল পালিত হয় কপিরাইট বা গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষণ দিবস; বইয়ের সঙ্গে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বইপড়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে উন্মাদনা বাড়ছে গত দশক থেকেই। বিশেষত, বর্তমানে অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠেছে, যারা কাজ করছে তরুণদের পঠনে উদ্বুদ্ধ করতে। উপহার হিসেবে বই এখন বেশ প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে চাই সব ধরনের, সব বয়সের মানুষের মানসিকতার সুষ্ঠু বিকাশ। এক্ষেত্রে বইয়ের বিকল্প শুধুই বই-ই।