হঠাৎ জ্ঞান ফেরার পর চোখ খুলে আপনার মনে হলো ঘুঁটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পারছেন না, আপনার মুখ, হাত-পা বাঁধা, অসহ্য গরম লাগছে সেই সাথে কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে এবং আপনি মাটির নিচে একটি কফিনে বন্দী! সে সময়ে আপনার “অনুভূতি কী হবে”-এমন নির্বোধ প্রশ্ন না করেই এ কথা বলে দেওয়া যায় ঘটনার প্রাথমিক আকস্মিকতাতেই আপনি আতংকে হতবিহ্বল হয়ে পড়বেন।
ঠিক এমন একটি পরিস্থিতির অবতারণা করেই শুরু হয় ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইংরেজি ভাষায় নির্মিত স্প্যানিশ চলচ্চিত্র ‘ব্যেরিড’। আমেরিকান নাগরিক পল কনরয়, বেসমারিক ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন ইরাকে। হঠাৎ একদিন চোখ খুলে তিনি দেখলেন মুখ, হাত বাঁধা অবস্থায় নিকষ কালো অন্ধকারে আবদ্ধ। কোনোমতে লাইটারের আলোতে নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটি কফিনের ভেতর! মুখ, হাতের বাঁধন কোনোমতে খুলে আর্তচিৎকার আর দাপাদাপি করে একটু পর বুঝতে পারলেন যে কফিনের চেয়ে আকারে একটু বড় এক বাক্সে করে তাকে পুঁতে রাখা হয়েছে মাটির নিচে!
আবদ্ধ অবস্থায় থাকার আতঙ্কটা টের পাচ্ছেন? লাগছে Claustrophobic? স্প্যানিশ ডিরেক্টর রদ্রিগো কর্তেজের পরিচালিত মুভি; ব্যেরিড দেখার সময় এমন দমবন্ধ করা পরিবেশ কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হাড়ে-হাড়ে টের পাবেন, বলে দেওয়া যায় নির্দ্বিধায়। ৯৫ মিনিটের এই চলচ্চিত্রে ক্রিস স্পার্লিংয়ের লেখা কাহিনী আপনাকে ‘আটকে’ থাকতে বাধ্য করবে একদম শেষ পর্যন্ত। চলচ্চিত্রটি শেষ করেও তাই আপনি এর থেকে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে সরাতে পারবেন না, যা এই ধাঁচের চলচ্চিত্র অর্থাৎ সাইকো থ্রিলারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এদিকে, আর্তচিৎকার আর শরীরের সবটুক জোর দিয়েও বাক্সরূপী খাঁচা ভাঙ্গার চেষ্টায় কোনো লাভ হলো না, বরং প্রচণ্ড ক্লান্তি আর আতঙ্কে নিস্তেজ হয়ে আবার সংজ্ঞা হারালেন পল। বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারে ডুবে থাকার পর এবার একটা যান্ত্রিক শব্দে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলেন, পায়ের থেকে একটু দূরে কী যেন একটা থেকে আলো জ্বলছে-নিভছে আর সাথে যান্ত্রিক কম্পনের শব্দ, মনে হচ্ছে একটা মোবাইল ফোন!
মুভিটিতে ২:৩৩ অনুপাতের ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের ব্যবহারে পরিচালক এরকম আবদ্ধ পরিস্থিতিতে থাকার ব্যাপারটিকে অত্যন্ত জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন। সেইসাথে পল চরিত্রে দারুণভাবে রায়ান রেনল্ডসের মিশে যাওয়াই প্রমাণ করে কেন এই চরিত্রে পরিচালক রদ্রিগোর প্রথম এবং একমাত্র পছন্দ ছিলেন তিনি। মুভিটিতে দৃশ্যপট যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতাকেই অনুসরণ করে মাত্র ১৭ দিনে বার্সেলোনার একটি স্টুডিওতে শুটিং করে নির্মিত হয় এই সিঙ্গেল সেট প্রোডাকশনের মুভিটি। জিপো লাইটার, মোবাইল ফোন, পানির পাত্র, ওষুধের কৌটা, খালি মানিব্যাগ, পেনসিল, টর্চ, ছুরি, দুটি গ্লো-স্টিক এবং সাতটি কফিন বাক্স ব্যবহার করে নির্মিত চলচ্চিত্রটি তাই এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া অন্যতম ‘মিনিমালিস্ট’ চলচ্চিত্রের উদাহরণ।
আবার ফিরে যাই প্লটে, পলের পা থেকেও একটু দূরে রিং হতে থাকা মোবাইল নিতে তাই তাকে বেশ বেগ পেতে হয় যেহেতু কফিনের মতো বাক্সটিতে বাড়তি জায়গা খুব একটা বেশি নেই। কষ্ট করে কোনোমতে ফোনটা হাতে নিতে নিতেই আসা কলটি যায় কেটে। ফোন হাতে নিয়ে দেখেন ইরাকের স্থানীয় ভাষা সেট করা অপশনে। যেখানে তিনি কাজ করেন সেখানে যে কোনো জরুরি অবস্থার জন্য একটি সেইফটি নাম্বার দেওয়া হয়েছিলো, কিন্তু নাম্বারটি নিজের কাছে খুঁজে না পেয়ে কোনোভাবে ফোন দিলেন আমেরিকান হেল্প লাইন ৯১১-এ সাহায্যের জন্য, এরপর বাসস্থানে, এফবিআইতে, নিজের কর্মস্থলে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ভাবে নিজেকে শান্ত করার মতো সাড়া পেলেন না তিনি। হঠাৎ খেয়াল হলো তখনকার সেই ইনকামিং কলটির কথা, যে নাম্বার থেকে কল এসেছিলো, সেটি খুঁজে নিয়ে কল করলেন। অপরপাশ থেকে রিসিভ হওয়ার পর এবার একটি ক্রুর কণ্ঠ বলে উঠলো,
“শ্বাস নিচ্ছ নাকি নিচ্ছ না, আমেরিকান?”
অপরপাশের লোকটির সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে লোকটি কল কেটে দেওয়ার পর পল যা ভালোমতোন বুঝতে পারলেন তা হলো রাত নয়টার মধ্যে এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিতে হবে নয়তো এই মরণবাক্সেই জ্যান্ত কবর হবেন তিনি!
টান টান উত্তেজনার এই চলচ্চিত্রটি যেকোনো থ্রিলারপ্রিয় দর্শকের অবশ্যই ভালো লাগবে। তবে আর দশটি থ্রিলার মুভির থেকেও ব্যেরিড ভিন্নমাত্রা পায় তার সংলাপে; পরিস্থিতির বিচারে চলচ্চিত্রটি অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক থ্রিলারও।
উদাহরণ হিসেবে পল আর মুক্তিপণদাবীকারীর কথোপকথন তুলে ধরা যায়, যেমন-
– তুমি আমেরিকান?
– হ্যাঁ
-তাহলে তুমি একজন সৈনিক।
আরেকটি অংশ ছিল এমন-
-তুমি কথা বলেছ?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি কথা বলেছি, কিন্তু তারা বলেছে তারা কোনো টাকা দিতে পারবে না। তারা কোনো টেররিস্টের সাথে সমঝোতায় যাবে না।
-টেররিস্ট? আমি টেররিস্ট?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই একটা টেররিস্টই (গালাগাল দিয়ে)।
-তুমি আমার ভয়ে ভীত, তাই এখন আমি টেররিস্ট হয়ে গেলাম?
মুক্তিপণদাবিকারীকে কথোপকথনের অন্য এক অংশে বলতে শোনা যায়,
“৯/১১ আমার দোষ ছিল না, কিন্তু তোমরা ঠিকই এখনো এখানে আছো, ‘সাদ্দাম’ আমার দোষ ছিল না, তারপরও তোমরা এখানে।”
সাধারণ মানুষেরা কীভাবে ক্ষমতাবানদের স্বার্থের জালে আবদ্ধ হয়ে একে অপরের শত্রু হয়ে পড়ে, একজন সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য আদতে কতটুকু তা-ও যেন উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে। পরিচালক পল কনরয়কে উপজীব্য করে হয়তো সকল সাধারণ মানুষ যে আসলে চারপাশের স্বার্থান্বেষী শোষক-শাসকের ক্ষমতার অশুভ ও বিভীষিকাময় শক্তির দ্বারা এমনভাবেই ‘বাক্সবন্দী’ তা-ও হয়তো পরিচালক এ চলচ্চিত্রে দেখাতে চেয়েছেন।
লাইটার, ফোন, টর্চ এবং গ্লো-স্টিকের আলো দিয়ে, ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে পরিচালক রদ্রিগো কর্তেজ এবং সিনেমাটোগ্রাফার এদুয়ার্ড গ্রাউ যেভাবে চোখের সামনে একজন বাক্সবন্দী অসহায় ব্যক্তিকে হাজির করেছেন, তা প্রশংসনীয়। এছাড়াও ভূ-তলের নৈঃশব্দের সাথে সাথে সময়ে-সময়ে সাসপেন্সে কম্পোজার ভিক্টর রিয়িসের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরগুলোও দারুণভাবে মানিয়ে গেছে। আরো একজনের প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য, তিনি হচ্ছেন অভিনেতা রায়ান রেনল্ডস। আমরা জানিই যে চলচ্চিত্রে যা দেখানো হচ্ছে তা আসলে ঘটছে না, এসব অভিনয়, কিন্তু অভিনয়ের জন্য যে পরিশ্রম-কষ্ট তা কিন্তু সত্যিই করতে হয় একজন অভিনেতাকে। পল কনরয় চরিত্রে অভিনয় করতে করতে রায়ান রেনল্ডস নিজেও আক্রান্ত হয়ে যান ক্লস্ট্রোফোবিয়াতে। এজন্য কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দিতে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো প্যারামেডিক্স টিম। শুটিংয়ের শেষ দিন রায়ান তাই বলেছিলেন, “আর কখনো এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে চাই না”।
‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ খ্যাত অ্যালফ্রেড হিচককের ‘রোপ’ (১৯৪৮), ‘লাইফবোট’ (১৯৪৪) চলচ্চিত্রগুলো ব্যেরিড পরিচালক রদ্রিগো কর্তেজের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। দুই মিলিয়ন ডলার বাজেটে তৈরি চলচ্চিত্রটির আইএমডিবি ও রোটেন টমেটোতে স্কোর বেশ ভালো, যথাক্রমে ৭ এবং ৮৬%। বক্স অফিসে প্রায় ২১.৩ মিলিয়ন ডলার আয় করে চলচ্চিত্রটি। সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। পুলিৎজারজয়ী সমালোচক রজার এবার্ট, রদ্রিগো কর্তেজের কাহিনী দৃশ্যায়নের পরিমিতবোধের সাথে সাথে প্রশংসা করেছেন পল চরিত্রে রায়ান রেনল্ডসের শারীরিক ভাষাকে। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি নির্মাণের আগেই এর চিত্রনাট্যটি ২০০৯ সালে ‘পছন্দসই চিত্রনাট্য’-এর তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে ছিল।
আপনার মন যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে; কোনো কিছুতে মনোযোগ দিয়ে সাময়িকভাবে একটু মানসিক মুক্তি পেয়ে ডুবে যেতে চান একটি নিখুঁত সাইকো থ্রিলারে বা আপনি এমন কোনো মুভি খুঁজছেন যা দেখার পরও রেশ রয়ে যাবে, একই সাথে দেখা শেষে চোখ থেকে ঝরে পড়তে পারে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও। তাহলে ব্যেরিড দেখতে বসে যেতেই পারেন।
আশা করা যায় তাহলে খুব শীগগিরই জেনে ফেলবেন মুভির শেষটা দেখে আনন্দে কান্না পাবে না দুঃখে!
Featured image: imdb.com