সিনেমার জনক হিসেবে খ্যাত ডি.ডব্লিউ. গ্রিফিথের হাত ধরে সিনেমার ন্যারেটিভ সম্পর্কিত ধারণা জন্মের পর, ১০০ বছরের দীর্ঘ এই সময়টায় সিনেমার ভাষা আর আঙ্গিক কলাকৌশলে এসেছে একের পর এক অভাবনীয় পরিবর্তন। সিনেমা নির্বাক থেকে সবাক হওয়ার এই গোটা সময়টায় জড়িয়ে আছে অনেক বিপ্লবের ইতিহাস। অনেক অনেক ‘চলচ্চিত্র আন্দোলন’-এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী আন্দোলনের একটি হলো ‘ফরাসি নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলন’।
ধ্রুপদী সিনেম্যাটিক কলাকৌশলকে প্রত্যাখ্যান করা এই আন্দোলনের নেতা জাঁ-লুক গোদার। সিনেমা নির্মাণে গোদারের ‘গার্ল অ্যান্ড আ গান’ ফর্মুলাই তখন এই আন্দোলনের মূল স্পন্দনকে ধরতে পেরেছিল। গোদার, জাঁক দেমি, অ্যালা রেঁনে, ফ্রাঁসোয়া ক্রুফোর মতো এই আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিবর্গের মাঝে একইসাথে উচ্চারিত একমাত্র নারী নামটি হলো অ্যানিয়েস ভার্দা।
ফরাসি নবকল্লোলের মাতা, পরবর্তী সময়ে ‘দাদীমা’ বলে ডাকা হয় ভার্দাকে। ডকুমেন্টারি স্টাইল, নারীবাদী বক্তব্য এবং নানা নিরীক্ষাধর্মী কৌশলের জন্য পরিচিত ভার্দার কাজগুলো। তিনিএকদা বলেছিলেন, “একটি কম্পিউটার, একটি ক্যামেরা এবং একটি বিড়াল; এগুলোই সব, যা কিছু দরকার তোমার জীবনে।” ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ অব্দি ভিন্নধারায় সিনেমাকে দেখেছেন এবং নির্মাণ করে গিয়েছেন তিনি।
‘ভার্দা বাই অ্যানিয়েস’, তার সর্বশেষ সিনেমা। গঠনের দিক থেকে ডকুমেন্টারি। তবে ‘স্মৃতিকথা’ হিসেবে উল্লেখ করলেই ঠিকঠাক ধারণাটা পাওয়া যাবে এই ডকুমেন্টারি সম্বন্ধে। ভার্দা এই ডকুমেন্টারিতে কথা বলেন তার গোটা ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ার নিয়ে, উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো নিয়ে। ২০১৯ সালে তার মৃত্যুর মাসখানেক বাদেই মুক্তি পায় এই ডকুমেন্টারি। দুই অংশের টিভি ডকুমেন্টারি হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, ভার্দা বাই অ্যানিয়েস। ফরম্যাটটা সাধারণ। আড়ম্বরতা নেই। দু’রঙা বোল-কাট চুল, যার প্রান্তভাগের রঙ স্ট্রবেরি ফলের মতো, আর কেন্দ্রভাগ তুষারশুভ্র; মোলায়েম, বন্ধুত্বপূর্ণ একটা কন্ঠস্বর নিয়ে ভার্দা সিনেমাহলের মঞ্চে পাতা চেয়ারটায় বসে আছেন।
মঞ্চে বসে থাকার শটগুলোও অনাড়ম্বরভাবে ব্লক করা। একটা সরল হাসির রেখা ভার্দার মুখে জড়িয়ে আছে সবসময়। কথা শুনতে সামনে জড়ো হয়েছে অনেকে। ভণিতা নেই তার কথায়। খোলাখুলিই কথা বলেন ভার্দা। কথার প্রসঙ্গ ধরে ধরে পেছনের পর্দাটায় ভেসে ওঠে ভার্দার বিভিন্ন সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য। ভার্দা সেই দৃশ্যগুলো নিয়ে কথা বলেন, ভেতরের ভাব নিয়ে কথা বলেন, দৃশ্যগুলোতে তার আর্টিস্টিক চয়েজ কী এবং কেমন ছিল, তা প্রকাশ করেন। মাঝে মাঝে তার সিনেমাগুলোর বিভিন্ন অভিনয়শিল্পীদের সাথে কথোপকথনের ফুটেজ ও পাওয়া যায় ডকুতে।
দু’ঘণ্টার এই কথামালায় ভার্দা শুরুতেই বেছে নেন তার সর্বাপেক্ষা পরিচিত সিনেমা ‘ক্লেও ফ্রম ৫ টু ৭’ (১৯৬২)-কে। বলেন, নামমাত্র বাজেট পেয়েছিলেন এই সিনেমা নির্মাণের জন্য। বাজেট স্বল্পতার কারণে ঠিক করেন, একটি দিনের গল্পে বাঁধবেন এই সিনেমাকে। পরে দিন থেকে বিকাল, ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার নির্দিষ্ট সময়সীমায় বাঁধেন এই সিনেমাকে। কোনোরকম অসঙ্গতি ছাড়া কীভাবে সরলরেখার মতো এই সিনেমায় সময়টাকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সে ব্যাখ্যা দেন। সিনেমায় বাস্তব সময়ের মধ্য দিয়ে একটি চরিত্রের নানান অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি তুলে ধরার এক ভিন্ন ন্যারেটিভ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, ‘ক্লেও ফ্রম ৫ টু ৭ দিয়ে’- তা নিয়েও কথা বলেন।
ইউরোপে ক্যান্সার তখন মহামারি রূপ ধারণ করেছিল। ক্যান্সারের সেই বিষয়টিকে কেন্দ্রে এনেই সিনেমার গল্প দাঁড় করেছিলেন ভার্দা। মানুষের অগোচরেই তাকে ক্যামেরায় ধারণ করার মধ্যে যে মজা লুকিয়ে আছে, তা উল্লেখ করতে গিয়ে ৯০ বছরের প্রৌঢ়া ভার্দার চোখের সে চপল ভাষা, তা চোখ এড়ায় না দর্শকের।
ভার্দা কথা বলেন ‘ভ্যাগাবন্ড’ (১৯৮৫) নিয়েও। কী করে সফল হয়েছিলেন ওই সিনেমার ট্র্যাকিং শটগুলো ধারণ করতে গিয়ে, সে গল্প করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভার্দা জানান, সিনেমাকে তিনি কিছু ভাঙা ট্র্যাকিং শটের জোড় হিসেবে দেখেন। কারণ সিনেমাতে ক্যামেরা তো সবসময় চরিত্রকেই ট্র্যাক বা অনুসরণ করছে। ভার্দা নারীবাদী ছিলেন সবসময়ই। গর্বিত একজন নারীবাদী। সিনেমায় নারীবাদী বক্তব্যগুলোকে কীভাবে উপস্থাপন করতেন তিনি, তা নিয়ে কথা বলেন। বলেন, নারীবাদে নিজের বিশ্বাসের জায়গাটি নিয়েও। সঙ্গীত ভার্দার সিনেমায় সবসময় গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হয়ে ছিল। সমসাময়িক সঙ্গীতের ব্যবহারের দিকটিতেও আলোকপাত করেন ভার্দা।
‘হ্যাপিনেস’ (১৯৬৫) সিনেমা দিয়ে সুখকে অন্য এক উপায়ে তিনি উপস্থাপন করেছেন। সিনেমায় কোনো একটি দৃশ্যের ফেডিং টেকনিকে সবসময় কালো পর্দা ব্যবহারের যে নিয়ম, সে নিয়ম ভেঙে লাল, নীল, হলুদ রং ব্যবহারের পেছনের কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেন। ভার্দার এই টেকনিক পরিচালক ‘মার্টিন স্করসেজি’, তার ‘দ্য এইজ অভ ইনোসেন্স’ (১৯৯২) সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন।
ভার্দা সফলতা নিয়েই শুধু নয়, কথা বলেন ব্যর্থতা নিয়েও। সিনেমার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশাল এক তারার মেলা নিয়ে বানানো ‘অ্যা হান্ড্রেড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ (১৯৯৫) সিনেমার ব্যর্থতা নিয়েও কথা বলেন। মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নি’, আলাইন ডেলন, রবার্ট ডি নিরো, ক্যাথরিন ডিনুয়েভ, হ্যারিসন ফোর্ড সহ সিনেমার বড় বড় সব রত্নের সমাহার ঘটেছিল সে সিনেমায়।
শুধু ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ার, স্টাইল নিয়েই নয়; ফিল্ম তার ব্যক্তিজীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, স্বামী জাঁক দেমির প্রতি তার ভালোবাসা- এসবও উঠে এসেছে এই ডকুটিতে। ডকুমেন্টারির নামটা খেয়াল করলে দেখা যায়, ভার্দা নিজের নামটিকে এমন করে দুটি অংশে ভাগ করেছেন, যেন দুজন ভিন্ন মানুষ। মানুষ অভিন্ন হলেও, ভিন্ন দুটি সত্ত্বার পরিচায়ক হয়ে ওঠে এই ডকুমেন্টারি। ভার্দা সৃষ্টিশীল জননী (তার ফিল্মমেকার সত্ত্বা)। অন্যদিকে অ্যানিয়েস আটপৌরে একজন মানুষ। এই আটপৌরে মানুষটির চোখ দিয়েই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে দেখার, মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে ডকুমেন্টারিতে।
একজন শিল্পী এবং শিল্পীর উত্তরাধিকার নিয়েই এই ডকু যেখানে সত্ত্বা ভিন্ন হলেও, একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত নিবিষ্টচিত্তে। জীবন, শিল্প, মানবীয় আবেগ- তিনটিকেই এক সুতোয় বাঁধে ‘অ্যানিয়েস বাই ভার্দা’। তাই তো জাঁক দেমির অসুস্থতার সময়ে তার পাশে কাটানো দিনগুলোকে সিনেমার এক্সট্রিম ক্লোজআপ ফ্রেমের মধ্য দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন ভার্দা।
গভীর মনুষ্যত্ববোধই ভার্দার ফিল্মমেকার সত্ত্বাকে আলোড়িত করেছে। সাধারণ কিছু, যা মানুষ একবারের বেশি আরেকবার লক্ষ্য করে না, সেসবই দৃষ্টিগোচর করে ভার্দা স্বকীয়তা অর্জন করেছেন। সে কারণেই তো তিনি বলে ওঠেন, “শূন্য সিনেমাহল একজন ফিল্মমেকারের দুঃস্বপ্ন”। কারণ, ভার্দা তার সিনেমাগুলোকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চান। চারপাশের মানুষগুলোকে ধরতে চান। তাদেরকেই দেখাতে চান তার সিনেমা। শুধু সিনেমাই নয়, শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্র নিয়েও আলোচনা করেন ভার্দা। ইনস্টলেশন আর্ট, ফটোগ্রাফিতেও আছে তার দারুণ দক্ষতা। শিল্পের সবক’টি ক্ষেত্রের মাঝেই সংযুক্তি খুঁজে পান তিনি।
একটা সম্পূর্ণতা জড়িয়ে আছে গোটা ডকুমেন্টারিটিতে। হয়তো ভার্দা নিজেও বুঝেছিলেন, তার দীর্ঘ, বৈচিত্র্যময় ক্যারিয়ারের শেষ কাজই হতে চলেছে এটি। তাই নামটিও রেখেছেন ‘ভার্দা বাই অ্যানিয়েস’। ডকুমেন্টারির শেষভাগে বিষণ্ণতার ক্ষীণ সুর শুনতে পাওয়া যায়। ডকুমেন্টারি মুক্তির কিছু সময় পূর্বে ভার্দার মৃত্যুই হয়তো সেই ক্ষীণ সুরটিকে আরো গাঢ় করেছে। গোটা ডকুটি একটি স্ক্র্যাপবুকের মতো। সিনেমা নিয়ে উদ্যমীদের জন্য যার প্রতি পাতার টুকরো-টাকরা অংশগুলোতেই আছে অমূল্য শিক্ষা এবং নির্দেশনা। ‘ভার্দা বাই অ্যানিয়েস’ শুধু স্মৃতিকথায় ভারি একটি ডকুমেন্টারিই নয়, একজন মাস্টার ফিল্মমেকারের ‘মাস্টারক্লাস’ এটি।