Stories remain in our hearts, even when all else is gone
– The Breadwinner
বিশেষ কিছু মুহূর্ত আর মুহূর্তের কিছু বিশেষ গল্প নিয়েই তো সাজানো আমাদের জীবন! ‘দ্য ব্রেডউইনার’ ছবিটিতে তাই গল্পচ্ছলেই তুলে ধরা হয়েছে ৯০ এর দশকে তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পরবর্তীকালীন সমাজ ব্যবস্থাকে। তালেবানদের অত্যাচারের মুখে ঘরে বন্দী এক জীবন কাটাতে হতো নারীদের। কোনো নারীর পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এমনকি পানি ভরার মতো কাজের জন্যও একজন পুরুষের সাহচর্য লাগত মেয়েদের। এমনই কঠিন সমাজ ব্যবস্থায় বড় হওয়া পারভানা নামের একটি মেয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এই ছবিটিতে, যার ঠোটের আগায় বাসা বেঁধে থাকে হাজার রকমের গল্প।
মেয়েটি যেন গল্পের সওদাগর আর আর রাজ্য জুড়ে সবাই যেন তার গল্পের শ্রোতা। যাকে পেত তাকেই গল্প শোনাত মেয়েটা! সমাজে ঘটে চলা নৃশংসতার ছোবল থেকে চোখ ফেরাতে ছোট ভাই যাকি থেকে শুরু করে পারভানা এমনকি নিজেকেও গল্প শোনাত, গল্প শুনিয়ে সাহস জোগাত বারংবার।
পারভানাদের পরিবারে অভাব ছিল, কিন্তু সুখের কোনো কমতি ছিল না। সারাদিন পঙ্গু বাবার সাথে বসে বাজারে নিজেদের পুরনো জিনিস আর শব্দ ফেরি করে বেড়াত দুজন। ঘরে ফিরে মা, বড় বোন আর ছোট ভাইয়ের সাথে কাটাত বাকিটা সময়। ভালই চলছিল, কিন্তু সমস্যা বাঁধে যখন তালেবানের এক সৈন্যের নজর পড়ে পারভানার উপর। প্রাক্তন শিক্ষক বাবা ভয়ে মিথ্যা বলে পারভানাকে বাঁচাতে চাইলে তাকে নিয়ে জেলে পুরে দেয় তালেবানরা। এর সাথে সাথে শোকের ছায়া নেমে আসে পারভানাদের পরিবারে।
এমনিতেই বাবা নিরুদ্দেশ, তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। তার ওপর পারভানা এবং তার মা তালেবানদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে, ভর্ৎসনা শুনে ফিরে আসে। বাবাকে খুঁজতে গিয়ে নির্যাতিত হয় পারভানার মা, আর সে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচে সাথে কোনো পুরুষ সঙ্গী না থাকায়। এমনকি তালেবানদের অত্যাচার এত বেশি ছিল যে দোকানীরা ভয়ে পারভানার কাছে কিছু বেচতে পর্যন্ত সাহস পেত না একজন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ।
দিনের পর দিন তো এভাবে না খেয়ে কাটানো যায় না! আর বাবার কোনো খোঁজও পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পারভানা বেছে নেয় তার পরিবারকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়টি। চুল কেটে, বেশভূষা বদলে বনে যায় আতিশ। নিজের পরিচয় বিলীন করে সে নেমে রাস্তায় নেমে পড়ে পরিবারের অন্ন সংস্থানের উদ্দেশ্যে।
সেই মুহূর্ত থেকেই যেন গল্পটা আর পারভানার থাকে না, হয়ে যায় আতিশ নামের এক ব্রেডউইনারের। হঠাৎ করে যেন এক অন্য জগতের দেখা পায় পারভানা। কোনো কিছুই যে দুনিয়ায় আর অসম্ভব নয়। রাস্তায় ঘুরেফিরে বেড়ানো থেকে শুরু করে বাজারে একলা বসে ব্যবসা করা, সমাজে ছেলে হলে যেন সব সম্ভব! একদিন ঘুরতে গিয়ে তার স্কুলের এক বান্ধবী, শওজিয়ার দেখা পেয়ে যায়। সে-ও তার মতো ছেলে সেজেই দোকানে দোকানে কাজ করছে।
পারভানা জীবনের মোড় যেন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করে। সারা দিন সে কাজ করে, খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত থাকে, সময় পেলেই শওজিয়ার সাথে বসে মুক্ত একটা জীবনের স্বপ্ন বুনে দু’দন্ডের সুখ উদযাপন করে । আর রাতে সে ছোট ভাইকে শোনায় হাতি রাজ এবং সুলায়মানের গল্প। একদিন হঠাৎ সে তার বাবার খোঁজে বের হয় এবং একইসাথে তাদের পরিবারের সবাইকে, তার বড় বোনকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে নিতে আসে তাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়। কিভাবে পারভানা আর তার পরিবার তাদের জীবনে আসন্ন সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে তা নিয়েই কাহিনী ছবির অন্তিম অধ্যায়ে পদার্পণ করে।
ছবিটি বেশ সুচারু রূপেই কাহিনীটি বর্ণনা করতে সক্ষম হয়, তবে কিছু জায়গায় কাহিনীর সাথে তাল মেলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে দর্শকের জন্য। যেমন, হাতির রাজার গল্পটি দিয়ে পারভানার মৃত ভাইয়ের কাহিনী সম্পর্কে অবগত করার এবং পারভানাকে একজন ভাল গল্পকথক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে তা মূল গল্পের প্রবাহে বড়সড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পারভানা এবং তার মা-ভাইবোনকে যখন তাদের আত্মীয় নিতে আসে এবং তারপরের কিছু দৃশ্যের কাহিনী উদ্দেশ্যবিহীন জটিলতা বলেই মনে হয়। এছাড়াও কাহিনীটি সনাতন ধারার এনিমেটেড ছবি থেকে কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছে, যা বিমুখ করতে পারে অল্পবয়সী দর্শকদের, যাদের জন্যই মূলত বানানো হয় এনিমেটেড ছবি।
কাহিনীটি খুব সহজেই একটি ফিচার ফিল্ম হতে পারত, কিন্তু পরিচালক এবং প্রযোজকেরা একটি এনিমেটেড ছবির সাহায্যে গল্পটা শোনাতে চেয়েছেন। যদিও গল্পটা কিছুটা বিষাদময় এবং ভয়ংকর কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যা শিশু-কিশোরদের অন্যান্য এনিমেটেড ছবির মতো আমোদ-উল্লাসে মাতাবে না। কিন্তু এই ছবি ছেলে-বুড়ো সকলকে ভাবাবে অবশ্যই। আর বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের জন্য এটি বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ ছবি। কারণ পারভানার মতো মেয়েরাই পারে এখানকার নিপীড়িত মেয়েদের সাহস জোগাতে, যুদ্ধ করতে, এগিয়ে চলতে সামনে।
ছবিটি চিত্রায়িত হয়েছে পাকিস্তানি-কানাডিয়ান লেখক ডেবোরাহ এলিস এর বহুল আলোচিত বই ‘দ্য ব্রেডউইনার (২০০০)’ বইটি থেকে। এর নির্মাণের পিছনে হাত ছিল ‘দ্য বুক অফ কেলস (২০০৯)’ এবং ‘সং অব দ্য সী (২০১৪)’ খ্যাত আয়ারল্যান্ড কেন্দ্রিক প্রোডাকশন সংস্থা ‘কমিক স্যলন’ এর। কমিক স্যলন নিজেদের ছবিগুলোকে অন্য সব এনিমেশন থেকে আলাদা করে চেনাতে শুরু করেছে একদম প্রথম থেকেই। স্টুডিও জিবলির মতো তাদের এনিমেশনে রয়েছে নিজস্বতা এবং কাহিনীতে নতুনত্ব। তাদের পরপর দুটি ছবি- সং অব দ্য সী এবং দ্য ব্রেডউইনার, দুটি ছবিই অস্কার মনোনয়নে স্থান পায় ‘সেরা এনিমেটেড চলচ্চিত্র’ এর জন্য।
পরিচালক নোরা টওমির এটি প্রথম ছবি হলেও সং অব দ্য সী এবং দ্য বুক অব কেলস দুটি ছবিতেই তার অসামান্য অবদান ছিল। অন্যান্যবারের মতো পিক্সার আর ডিজনির আধিপত্যের কারণে দ্য ব্রেডউইনার অস্কারটা না জিতলেও সবার মন জয় করে নিয়েছে সহজেই। যারা দেখেছে সবাই একবাক্যে এই ছবির প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে।
এই ছবির সাথে জড়িয়ে আছেন আরেকজন, যার অবদান সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। জোলির নাম ছবিটির জন্য নাম কুড়াতে ব্যবহার করা হয়নি। তবে জাতিসংঘের হয়ে আফগানিস্তানের মেয়েদের নিয়ে অনেক বছর কাজ করার তার অভিজ্ঞতাটিকেই তারা কাজে লাগাতে চেয়েছেন বলে পরিচালক টওমির দাবি। জোলিও নিজের সবটুকু চেষ্টা করেছেন ছবিটিকে যথাযথভাবে দর্শকদের সামনে নিয়ে আশার। এমনকি, যখন পারভানা চরিত্রের জন্য উপযুক্ত একজন ভয়েস আর্টিস্টের দরকার পড়ে, তখন জোলিই সন্ধান দেন নবাগত সারা চৌধুরীর। এছাড়াও ছবিটিকে সবদিক থেকে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ছবির সাথে জড়িত কারোরই উদ্যমে কোনো কমতি ছিল।
হ্যাঁ, কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা আছে ছবিটির। কিন্তু পরিচালক যে প্রত্যয়ে পারভানার সাহসিকতার গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাতে তিনি সফলই হয়েছেন বলতে হবে। ছবিটিতে একটি পরিবারের দুঃখগাঁথা ছাপিয়ে উঠে এসেছে শেষপর্যন্ত অদম্য চিত্তে লড়াই করে যাওয়ার বাণী, শত বাঁধাকে ভয় না করে দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জয়গান। ছবিটি আমাদের মনে অশুভকে জয় করার আশা জাগায়, সাহস যোগায়। ছবিটি গল্পচ্ছলেই শিখিয়ে যায় স্বপ্ন দেখতে, লড়ে যেতে।
ফিচার ইমেজ- Twitter