শুরুর আগে
বাংলাদেশী সাহিত্যে থ্রিলার ঘরানাটি বেশ কিছুদিন হলো আসন গেঁড়ে বসেছে। আমাদের ধ্রুপদী সাহিত্যিকরা অনেকটা সময় ধরে কেবলই সামাজিক উপাখ্যান, নর-নারীর চিরন্তন প্রণয় নিয়েই লিখেছেন। এবং পাঠকের কাছেও সাহিত্যের সীমানা এই ঘেরেই বাঁধা ছিল। থ্রিলার এসেছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে। সেবা প্রকাশনী দীর্ঘদিন ধরে এই ঘরানাটি নিয়ে কাজ করেছে এবং করছে। কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নেই, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের বাতিঘরের হাত ধরে এটি মানুষের কাছে আরো বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখন তরুণ লেখকরা বাংলায় মৌলিক থ্রিলার লিখছেন। খাঁটি বাংলা গল্প, স্থান-কাল-পাত্র মিলেমিশে নিজের মতো করে গড়ে উঠছে এই শাখাটি। পাঠকও একে দারুণভাবে আপন করে নিয়েছেন। আজকাল প্রায় সব পাঠকের মুখেই ঘুরেফিরে শোনা যায় থ্রিলার বইগুলোর নাম।
এরকমই একটি বই নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। বইটির নাম ছায়া সময়। লেখক, শরীফুল হাসান। বইটি বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের গল্পে যাওয়ার আগে গল্পকারের ব্যাপারে একটুখানি বলে নেয়া যাক৷
গল্পকার পরিচিতি
শরীফুল হাসানের জন্ম ময়মনসিংহে৷ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন৷ থ্রিলারে এসেছিলেন অনুবাদ দিয়ে৷ তার অনুদিত প্রথম বই মেইজ অব বোনস৷ কিছুদিনের মধ্যেই মৌলিক থ্রিলার লেখা শুরু করেন৷ প্রথম উপন্যাস সাম্ভালা দিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে সেটা রূপ নেয় ট্রিলজিতে৷ এছাড়াও ঋভু, আঁধারের যাত্রী, মেঘ বিষাদের গল্প ইত্যাদি বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন তিনি৷ মূলত থ্রিলার হিসেবে লেখা হলেও তার শেষের দিকে লেখা উপন্যাসগুলোকে চট করে থ্রিলার ঘরানায় ফেলে দেয়ার কোনো উপায় নেই৷
এত ঘটা করে লেখক পরিচয় নিয়ে কথা বলার কারণ মূলত তার লেখার রূপান্তর৷ যে মানুষটি পুরোদস্তুর থ্রিলার দিয়ে লেখা শুরু করেছিলেন, তার এখনকার লেখাগুলোকে থ্রিলারের চেয়ে সামাজিক উপন্যাস বলেই বেশি মনে হবে৷ তবে, চট করে সামাজিক উপন্যাস বলেই কাজ সেরে ফেলার উপায় নেই৷ বরং সাদা-কালো-ধূসরের এক বিচিত্র অবগাহন বলা যেতে পারে৷ তাছাড়া, খুব বেশি মানুষের লেখায় মমতা জিনিসটা ফোটে না৷
শরীফুল হাসানের লেখায় এই জিনিসটা দারুণ ফোটে৷ প্রত্যেকটি চরিত্রকে প্রচন্ড জীবন্ত মনে হয়৷ তাদের জীবনের টানাপোড়েন, ভালো-খারাপ- দুই দিকই দেখতে পাই আমরা৷ গল্প একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এগোয় ঠিকই, কিন্ত চরিত্রদের জীবন সহসা নির্দিষ্ট কোনো দিকে এগোয় না৷ এলোমেলো, কিছুটা এদিকে তো কিছুটা ওদিকে৷ বাস্তবে যেমন হয় আর কী। সেরকমই একটি উপন্যাস এই ছায়া সময় ৷
ছায়া সময়
উপন্যাসের গল্প মূলত আশির দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা; স্থান ময়মনসিংহ৷ মফস্বল শহরটি তখনও ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি৷ সদ্য স্বাধীন দেশটির মানুষ ঠিক করে নিঃশ্বাস ফেলার আগেই দেখেছে, সব কিছু কেমন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নানা কিছু ঘটে গেছে তাদের জীবনে৷ তারপর কিছুদিনের বিরতি। আপাতত বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না দেখে মানুষ একটুখানি স্বস্তি পেতে শুরু করেছে৷ ঠিক এরকম অবস্থায় গল্পের সূচনা হয়৷
এ গল্প কামরুল আকন্দ নামের এক যুবকের, যে গুলি খেয়ে কোমায় আছে৷ এ গল্প ইউসুফ জালালের, যে কামরুল আকন্দের বোন জামাই৷ নিজের জীবনে তার টানাপোড়েন কম নেই৷ বোকাসোকা ঘরজামাই হিসেবে চুপচাপ দিনাতিপাত করলেও সে আসলে বোকা নয়। তার গভীর চোখের দিকে তাকালেই এ কথা বুঝতে পারেন করিম আকন্দ। এ গল্প অনন্যার, যে কাউকে ভালোবাসে৷ এ গল্প অর্ণবের৷ সে গান গায়, নেশা করে৷ কিন্তু ছেলেটা মানুষ হিসেবে খারাপ- এ কথা বলার কোনো উপায় নেই।
সর্বোপরি, এ গল্প করিম আকন্দের৷ এবং তার নিজের হাতে গড়ে তোলা আকন্দ পরিবারের৷ সবাই ভাবে, তিনি নরম মনের মানুষ৷ এসব দেখে তিনি বিরক্ত হন৷ ভাবেন,
গ্রাম থেকে খালি হাতে এই শহরে এসে যে জায়গা-সম্পত্তি, ব্যবসা আর সম্পদ করেছেন, নরম মনের হলে তিনি এসব করতে পারতেন না৷ এই সহজ জিনিসটা কেউ বোঝে না৷
আকন্দ পরিবারকে ঘিরে গল্পের ফাঁকে আমাদের পরিচয় হয় তপন চক্রবর্তীর সঙ্গে৷ বর্তমানে কলকাতায় থাকলেও একসময় তার পরিবার এই আকন্দ বাড়িতেই থাকতো৷ সে সময় এ বাড়ির নাম ছিল শ্রীলেখা ভবন৷ তপনকে সে বাড়ির সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মানুষটা গভীর সব কথা বলে৷ তাকে সহজ করে বলতে বললে সে উত্তর দেয়, “সহজ করে দ্যাখ, সহজ লাগবে!”
ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু এত সহজ না৷ এই গল্পে একটা থানাও আছে, যে থানার ওসি আমিন উদ্দিন৷ কামরুল আকন্দের কেস সুরাহা করার আগেই আলাল আকন্দকে হাসপাতালে ভর্তি করার খবর পান তিনি৷ কারা যেন পিটিয়েছে তাকে৷ আসন্ন নির্বাচনে বর্তমান ওয়ার্ড কমিশনার কাশেম আলীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছে সে৷ আলাল আকন্দের কথায় কাশেম আলীর বিরুদ্ধে কেস নেন আমিন উদ্দিন৷ কিন্তু সেই কেসে কাশেম আলীর জামিন হলেন আকন্দ পরিবারের প্রধান করিম আকন্দ৷ আমিন উদ্দিন টের পান, সবকিছু কেন পাকিয়ে উঠছে৷ মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তিন তিনটা লাশ ফেলে গেছে কেউ একজন৷ নিহতেরা হলো ইউসুফ আকন্দের বাপ-ভাই৷ আর যে খুন করেছে, তাকে এই এলাকায় সবাই তাকে একনামে চেনে৷ নিখুঁতভাবে গলা কেটে খুন করাই তার অভ্যাস৷ যে বাড়ি ছেড়ে অনেকদিন আগে বেরিয়ে এসেছিল ইউসুফ জালাল, সেই বাড়ির হাল কি এখন তাকেই ধরতে হবে?
ঘটনার মোড়ে মোড়ে আরো আরো চরিত্র ভীড় করে৷ অন্ধকার পাড়ার কইতরিও আছে এ গল্পে৷ আছে খাজু মিয়া, প্যাঁচ লাগিয়ে বেড়ানো যার কাজ৷ আছে রহমান আকন্দ আর চামেলি৷ আছে আমেনা, যে স্বামী ইউসুফকে অবহেলা করে প্রচন্ডভাবে৷ অনন্যার বাবা অনিমেষ চান সব ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে৷ অর্ণবের বাবাও তা-ই চান৷ কিন্তু অর্ণব রাজি না৷ শিকড় ছেড়ে মানুষ কি এত সহজে চলে যেতে পারে? এ নিয়ে ছোট্ট একটি অনুচ্ছেদে অর্ণবের ভাবনাটুকুর কথা বলেছেন লেখক৷ সেটা এমন:
অর্ণব এই রাতে আর ঘুমালো না৷ বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিল৷ ভোরের দিকে কাছের মসজিদে যখন আজান দিল মুয়াজ্জিন তাহের, তখন অর্ণবের মনে হলো, ভোরের এই পরিবেশ আর কোথাও পাওয়া যাবে না, কোথাও না৷
একইভাবে অনন্যার গল্প থেকে বোঝা যায়, সমাজ কী ভয়াবহ দানব হয়ে উঠতে পারে কখনো কখনো৷ মানসিক যন্ত্রণা কিংবা নিজের ইচ্ছেকে কী অবলিলায় সে গলা টিপে ধরতে পারে৷
অনন্যার কান্না পাচ্ছিল খুব৷ কিন্তু কাঁদতেও মানা করেছে সমাজ৷ রাস্তায় চলতে গিয়ে একটা মেয়ে কেন কাঁদছে, তা নিয়ে অনেক কৌতূহল মানুষের৷ ছোট শহর, সবাই জেনে যাবে৷ নিরুপমা আর অনিমেষের কাছে খবর চলে যাবে, তাদের একমাত্র মেয়ে রিক্সায় যেতে যেতে কাঁদছিল৷ সেটা শহরের সবাই দেখেছে৷
অনন্যা তাই কাঁদল না৷ শক্ত হয়ে বসে রইল৷ মানুষটা হয়তো এই শক্ত হওয়ার কথাই বলেছিল সেদিন ভোরে!
কিন্তু গল্পটা ঘুরেফিরে আমিন উদ্দিনের কাছেই আসে৷ তাকেই যে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে! কিসিঞ্জারি চাল চেলেছে কেউ একজন৷ সেজন্যেই আলাল এখন হাসপাতালে৷ কিন্তু কাশেম আলীর জামিনদার করিম আকন্দ কেন হলেন? এদিকে কামরুলের ব্যাপারটারও কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ একজনকে সন্দেহ করে থানায় পুরেছিলেন, করিম আকন্দ তার উপর থেকে মামলা তুলে নিয়েছেন৷ তার উপর তিন তিনটা খুন!
এতসব প্রশ্নের জবাব কি মিলবে আদৌ?
সমালোচনা
বইটিতে বানান ভুল আছে প্রচুর৷ বিশেষ করে ‘কি’ আর ‘কী’- এর ব্যবহার হয়েছে একদম উল্টোভাবে৷ এসব চোখে লাগে, মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায় অনেক সময়৷ এমনকি চরিত্রের নামের বানানেও ঝামেলা আছে৷ জলিল আকন্দ হঠাৎ হঠাৎ করেই হয়ে যায় জালাল আকন্দ৷ বোঝা যায়, সম্পাদনায় যত্নের অভাব ছিল খুব৷
এটুকু সমস্যার কথা বাদ দিলে ছায়া সময় পড়ার মতো একটি বই৷ বিশেষ করে আশির দশকে বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে কারো আগ্রহ থাকলে এ বই তার কাছে দারুণ লাগবে৷ গল্পের কোথাও এক মুহুর্তের জন্যেও ঝুলে যায়নি৷ আপাত উদ্দেশ্যহীন মনে হতে থাকা গল্পটা দারুণভাবে এগিয়েছে আপন গন্তব্যে৷
ছায়া সময়ের গল্পটা ময়মনসিংহকে ঘিরে৷ লেখক বইটা উৎসর্গও করেছেন ময়মনসিংহকে৷ অদ্ভুত এক আবছায়া শহরের গল্প বলেছেন তিনি এই বইতে৷ যে গল্প পড়তে পড়তে বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ হারিয়ে যাওয়া যায় অন্য এক সময়ে, অন্য কোনোখানে৷