স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতো বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের এই বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় এসেছিল, সেই যুদ্ধের শুরু একই বছরের ২৫ মার্চ, এক নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে। ইতিহাসে এই বর্বরতম হত্যাযজ্ঞকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে অভিহিত করা হয়। এই মিলিটারি মিশনে সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাও ফরমান আলী। সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তা ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার ও তার দেশের ভূমিকা নিয়ে ‘How Pakistan got divided’ নামে এক বই লেখেন। সেখানেই ২৫ মার্চ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। কালরাত্রির সেই ঘটনাবলি নিয়ে বইয়ে লেখা তার অভিমতই জানানো হবে এই লেখায়।
নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার পক্ষে ছিল সেনাবাহিনী?
রাও ফরমান আলীর ভাষ্য অনুযায়ী, একাত্তরের ২২ মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনী জানতই না প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে কী সিদ্ধান্ত আসছে বা কী ঘটতে যাচ্ছে। ফরমান আলী তখন বেসামরিক প্রশাসনের মেজর জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গভর্নর ছাড়াই সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু ছিল। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ডিভিশনের (১৪ তম) জিওসি। ফরমান লিখেছেন, তিনি সহ তার সহকর্মীদের সত্তরের নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার পক্ষে মত ছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দেওয়া উচিত বলেও তাদের মনে হয়েছিল। এজন্য আলোচনা ব্যর্থ হচ্ছে জেনেও সেনাবাহিনী কোনো মারাত্মক প্রস্তুতি নেয়নি বলে দাবি ফরমান আলীর।
টিক্কা খানের নির্দেশনায় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি
প্রেসিডেন্ট হাউজে কী ঘটছে সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম ২২ মার্চ সকাল ও রাতে মোট দুবার জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু টিক্কা খান তাদের সেদিন আশাহত করেন, পরদিন খবরাখবর জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
২৩ মার্চ ভোর বেলাতেই টিক্কা খান তাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। বলেন, “কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, নিজেদের প্রস্তুত করো।” এই নির্দেশনার পরই প্রস্তুতির কাজ শুরু করেন ফরমান আলী, খাদিমসহ অন্য কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ছিল?
অপারেশনের পরিকল্পনা করতে গিয়ে রাও ফরমান আলীসহ বাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের বেশ কিছু বিষয়কে মাথায় রাখতে হয়েছিল। রাও ফরমান আলী তার বইয়ে লিখেছেন, অপারেশন শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের প্রায় ১২ হাজার সৈনিক এবং আরও প্রায় লাখখানেক মুজাহিদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা কাজ করছিল তাদের মনে। আর এমন বাধার মুখে পড়লে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত মাত্র হাজার দশেক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়াটা নিশ্চিত ছিল।
এত কম সময়ের নোটিশে বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডারদের ঠিকঠাক ব্রিফিং দেওয়াও একপ্রকার চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছিল উধ্বর্তন এই সেনা কর্মকর্তাদের জন্য। এজন্য তাড়াহুড়ার মধ্যেই হেলিকপ্টারে করে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারগুলোতে গিয়ে ব্রিফিং দেওয়ার চেষ্টা চলছিল।
রাও ফরমান আলীর দাবি অনুযায়ী, তারা সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই বন্দি করার পক্ষে ছিলেন। কারণ তাদের ধারণা ছিল একমাত্র এই একটি উপায়েই রক্তপাত এড়ানো যেত। সে অনুযায়ী, তারা তাদের সুপারিশ প্রেসিডেন্ট হাউজে পাঠান। কিন্তু সেটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে কিছু উল্লেখযোগ্য নেতার তালিকা প্রস্তুত করে তাদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন দলকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য শুধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় সেনাবাহিনী। কারণ, নেতারা গ্রেফতার হবেন- এই পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অনেকেই গা ঢাকা দেন বলে দাবি ফরমান আলীর।
ইয়াহিয়ার ঢাকায় অবস্থানের পক্ষে ছিল সেনাবাহিনী?
রাও ফরমান আলী তার বইয়ে দাবি করেছেন, সে সময়কার সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকাতেই অবস্থান করা উচিত- এমন সুপারিশ করা হয়েছিল তাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই সুপারিশ প্রত্যাখান করে তাদের জানানো হয়, বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করার এবং দেশের স্বার্থে সাধারণভাবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়াকে পাকিস্তান ফিরে যেতে হবে। এমনকি সেনাবাহিনীকে এই নির্দেশনাও দেওয়া হয় যে, ইয়াহিয়াকে বহনকারী বিমানটি করাচির ৪০ মাইলের মধ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা যাতে কোনো রকম অ্যাকশনে না যায়। কেন এমন সিদ্ধান্ত? এটি নিয়ে অবশ্য খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি তার বইয়ে।
২৫ মার্চ প্রেসিডেন্টের অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল। একটি ছোট গাড়িতে কোনোরকম নিরাপত্তা প্রহরা ছাড়াই তাকে বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এত গোপনীয়তার পরও শেখ মুজিব জেনে গিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া করাচি চলে যাচ্ছেন। এই খবর তাকে দেন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। তিনিই বিমানবন্দরে ইয়াহিয়াকে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন সে সময়।
মূল অপারেশন শুরুর আগের প্রস্তুতি যেমন ছিল
মিলিটারি অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ আগে থেকে নির্ধারণ করা হয়নি। রাও ফরমান আলী লিখেছেন, তাদের অবশ্য সময় কম ধরে নিয়েই প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও চলছিল। ফরমান আলীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঢাকায় ব্রিগেড কমান্ড করার দায়িত্ব পান ব্রিগেডিয়ার আরবাব। আরবাবের ঢাকা শহর সম্পর্কে বেশ ভালোই ধারণা ছিল। শহরের আনাচে-কানাচে বেশ ভালোভাবেই চিনতেন তিনি। কিন্তু তা-ও শত্রুদের অবস্থান জানা, তথ্য অনুসন্ধান এবং চিহ্নিত নেতাদের বাড়ি চেনার উদ্দেশ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদেরকে সাদা পোশাকে টহল দেওয়ার নির্দেশ ছিল। প্রস্তুতিতে কোনো খুঁত রাখতে চায়নি পশ্চিম পাকিস্তানিরা, এটা অন্তত স্পষ্ট রাও ফরমানের বর্ণনায়।
বাঙালিদের প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ঢাকায় সেদিন বেশ উত্তেজনাপূর্ণ তৎপরতাই লক্ষ্য করেছিলেন বলে লিখেছেন রাও ফরমান আলী। অসংখ্য সড়ক প্রতিবন্ধক ও ব্যারিকেড তৈরি করে রাখতে দেখেছেন তিনি। রাস্তা বন্ধ করার জন্য বিরাট বিরাট গাছ কেটে ফেলা হয়, রাস্তাগুলোকে পুড়ে আলকাতরা ও কয়লা দিয়ে আগুন ধরানোর আয়োজন করা হয় যাতে যানবাহন চলাচল বাধার মুখে পড়তে পারে। রাও ফরমান আলীর মতে, বাঙালিরা সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বেরোতে না দেওয়ার প্রস্তুতিই নিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা আশঙ্কা ছিল যে বিমান বন্দর দখল করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ নিজেই একটি অপারেশন চালাতে পারে। এই আশঙ্কার প্রমাণও পেয়েছিল তারা। ফরমানের দাবি, এই ধরনের একটি রিপোর্টও তারা পেয়েছিল।
মধ্যরাতে হানাদারদের নৃশংসতা
২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬ টায় সেনাবাহিনীকে জানানো হয়, সেদিন রাতেই অপারেশন চালাতে হবে, তবে সেটি যেন রাত ১টার আগে না হয়। কারণ, প্রেসিডেন্ট করাচি পৌঁছাতে ততক্ষণ সময় লেগে যাবে।
স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের একটি প্লাটুন রাত দেড়টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। এর পরপরই মূল অপারেশন শুরু করে হানাদাররা।
আধঘন্টা পর টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পিলখানায় অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের প্রায় আড়াই হাজার সদস্যকে নিরস্ত্র করা হয় রাত আড়াইটায়। এরপর নিরস্ত্র করা হয় রিজার্ভ পুলিশের প্রায় হাজার দুয়েক সদস্যকে। এই দুই বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয় বলে রাও ফরমান আলী তার বইয়ে লিখেছেন। এজন্য কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
ভোর পাঁচটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেয় সেনাবাহিনী। দখল করতে গিয়ে ইকবাল, লিয়াকত ও জগন্নাথ হলের ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় সেনাবাহিনীকে। কিন্তু হলগুলোতে হতাহতের ব্যাপারটি এড়িয়ে গেছেন রাও ফরমান আলী।
শহরজুড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞের যে তান্ডবলীলা চলেছিল সে রাতে সেটিও তার বইতে উঠে আসেনি। তবে আর্মি ছাত্রদের হত্যা করেছে- এই অভিযোগ তিনি মানতে নারাজ। তিনি লিখেছেন, “এ কথাও একজনের জিজ্ঞেস করা উচিত, ‘একজন ছাত্র কখন আর ছাত্র থাকে না’, তখনই একজন ছাত্র আর ছাত্র থাকে না, যখন সে অস্ত্র বহন করে – এই উত্তরটিই আর্মিকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট।” তার দাবি, ছাত্ররা গুলিবর্ষণ বন্ধ না করায় এবং আত্মসমর্পণে রাজি না হওয়ায় মৃত্যুর মতো পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল তাদের।
বাড়িয়ে বলা হয়েছে গণমাধ্যমে?
রাও ফরমান আলী তার বইয়ে দাবি করেছেন, সে সময় সেনাবাহিনী ব্যাপক রক্তপাত এড়াতে চেয়েছিল। এজন্য কৌশলগত বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে জিপের ওপর লাইট মেশিন গানের স্তূপ করে সেগুলোর ব্যারেল আকাশের দিকে উঁচিয়ে ট্রেসারমিশ্রিত বুলেট ফায়ার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি তার। এতে মানুষকে রাস্তা থেকে দূরে রাখা সহজ হবে বলে ধারণা ছিল তাদের। সড়ক প্রতিবন্ধক হিসেবে নির্মিত দেয়াল ভেঙে ফেলার জন্য রকেট লঞ্চারের সঙ্গেও বন্দুক যুক্ত করা হয়েছিল। মানুষের জীবনহানি না ঘটিয়ে তাদের বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যই এতসব আয়োজন করেছিল সেনাবাহিনী- এমনটাই দাবি রাও ফরমানের।
কিন্তু ফরমান আলীর এই দাবির সাথে বাস্তবতার মিল পাওয়া যায় না। অপারেশন সার্চলাইট নামে ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী হয়েছিল ২৫ মার্চের সেই রাত। কিন্তু ফরমানের দাবি অনুযায়ী, বিদেশী সংবাদমাধ্যম তাদের উদ্দেশ্য ও চেষ্টার ভুল ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করেছিল। এমনকি জীবনহানি না ঘটানোর কৌশলকে গণহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়েছিল বলে রাও ফরমান আলী তার বইতে দাবি করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকার রাজপথে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেটি খুব সামান্য ছিল।
কে এই রাও ফরমান আলী?
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেলের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন রাও ফরমান আলী। তার জন্ম ১৯২৩ সালে, ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের রোহতাক-এ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে মিলিটারি পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন ফরমান। এরপর তিনি বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সামরিক পুলিশ এবং শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানকে হত্যা ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে দমন করার জন্য, অপারেশন সার্চ লাইট নামক সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। বাঙালিদের হত্যার এই নীলনকশা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ফরমান আলীর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে প্রমাণ হয়েছে। অপারেশন সার্চ লাইট শেষ হওয়ার পর তিনি নির্বিচারে বাঙালি নিধনের সকল পরিকল্পনার অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। তার নাম এসেছে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবেও। ২০০৪ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।