কমিকস জগতের কুখ্যাত দুই ভাড়াটে খুনির উপাখ্যান

বাস্তব জীবনের অনেক ভাড়াটে খুনিদের কথা আমরা জানি। তেমনি কমিকসের জগতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এরকম ক’জন খুনে অপরাধী। খুন তাদের পেশা নয়, নেশা। নিজস্ব কায়দায় কিলিং মিশনে মেতে উঠার এসব বর্ণনা পড়লে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। আমাদের আজকের আলোচনায় আমরা সেই কমিক জগতের ভাড়াটে খুনিদের উৎপত্তি নিয়ে কথা বলব। কমিক জগতের অন্যতম কুখ্যাত কিলারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হচ্ছে- ডেডশট ও ক্যাপ্টেন বুমেরাং

ডেডশট

নাম তার ফ্লয়েড লটন। কমিকস জগতে তার বিচরণ শুরু হয়েছিল হয়েছিল ব্যাটম্যান কমিকসের ৫৪ নম্বর সংখ্যা দিয়ে। ১৯৫০ সালের জুন মাসে বের হওয়া সেই কমিকস বইয়ের রচনায় ছিলেন বব ক্যেইন, ডেভিড ভার্ন রিড এবং লিউ শোয়ার্জ। ‘গোল্ডেন এজ’ এর কমিকস সিরিজের কাহিনীগুলোতে তার অতীত সম্পর্কে তেমন কিছু উল্লেখ না থাকলেও, পরে ‘মর্ডান এজ’ এবং ‘নিউ ৫২’তে তার উৎপত্তি তুলে ধরা হয়। সে একজন অভিজ্ঞ মার্কসম্যান। উপযুক্ত বন্দুক দিয়ে অনেক দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা তার অসাধারণ। এছাড়াও হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটে সে অনেক পারদর্শী।

কমিকসে ডেডশটের খুন করার কিছু দৃশ্য © Infinite ecoolness

ফ্লয়েড জন্মগ্রহণ করে সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। তার বাবার নাম জর্জ লোটন ও মায়ের নাম জেনেভিভ লোটন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ফ্লয়েড ছিল ছোট এবং তার ভাইয়ের নাম ছিল এডওয়ার্ড। ফ্লয়েড তাকে খুব সমীহ করে চলতো। একে তো অনেক বড়লোক, এর মাঝে মাত্র চারজন সদস্যের পরিবার; কিন্তু তা-ও শান্তি ছিল না তাদের মাঝে। বাবা-মা একে অপরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো এবং বাবার অনবরত দুর্ব্যবহারে, দুই ছেলেও একসময় তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জেনেভিভ শেষমেশ দুই ছেলেকে তাদের জঘন্য পিতাকে খুন করতে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এডওয়ার্ড তাতে রাজি হয়ে গেলেও, বাধ সাধে ফ্লয়েড। সে মায়ের এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে চায়নি। এডওয়ার্ড তখন চিন্তা করে দেখে, ঘটনার সময় যদি ফ্লয়েড উপস্থিত থাকে, তাহলে সেটি অন্যদিকে মোড় নিতে পারে, তাই সে ফ্লয়েডকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজেদের বোট হাউসে বন্দী করে রেখে আসে।

বোট-হাউসে বন্দী অবস্থায় বসে সে বড় ভাইয়ের ভয়ানক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেখান থেকে পালানোর উপায় খুঁজতে শুরু করে। বহু কষ্টে সেখান থেকে বের হবার পর, সে একটি রাইফেল জোগাড় করে তাদের বাড়ির পাশের এক গাছের ডালে উঠে লুকিয়ে বসে থাকে। তার উদ্দেশ্য ছিল, বড় ভাই বাবাকে গুলি করার আগে সে ভাইয়ের হাত থেকে বন্দুকটি নিয়ে গুলি করে দেবে। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য সেদিন অন্য কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছিল। গুলি করার ঠিক আগ মুহূর্তে সে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে গেলে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এডওয়ার্ডের মাথায় আঘাত করে। যে বাবাকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো, তাকেই বাঁচাতে গিয়ে ভুলবশত প্রিয় ভাইকে মেরে ফেলার ব্যাপারটি সে কখনও মেনে নিতে পারেনি। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করে সে, নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলবে, যাতে আর কখনও তার একটি গুলিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।

ডেডশট © DC Comics

আততায়ী বা মার্সেনারি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে সে মেরিন কর্পসে ছিল এবং এর কিছুদিন সে লিগ অফ অ্যাসাসিন্সে যোগ দেয়। পরে এক সময় সে গোথামে ফিরে আসে। ব্যাটম্যানের অবর্তমানে নিজের দক্ষতাগুলো কাজে লাগিয়ে সে আত্মপ্রকাশ করে একজন ভিজিলান্টে ক্রাইম ফাইটার হিসেবে। এদিকে ব্যাটম্যান ফিরে এসে টের পায়, ফ্লয়েড ভালো মানুষের মুখোশ পরে আসলে তলে তলে ক্রিমিনালদের সাথেই কাজ করছে। ব্যাটম্যান আর গর্ডন মিলে জনসম্মুখে তার আসল রূপ তুলে ধরে এবং তাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠানো হয়। এর বেশ কিছুদিন পর ফ্লয়েড জেল থেকে পালিয়ে যায় এবং ব্যাটম্যানের উপর প্রতিশোধ নিতে সে ডেডশটরূপে আবার গোথামে ফিরে আসে। বেশ ক’বার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর সে মরিয়া হয়ে উঠে। নতুন করে পরিকল্পনা করে। এবারে ব্যাটম্যানকে বাগে পাওয়ার সাথে সাথে সে আশেপাশের নিরপরাধ মানুষের তোয়াক্কা না করে ব্যাটম্যানের উপর গুলি চালানো শুরু করে। ব্যাটম্যান আবারো তাকে প্রতিহত করে এবং ধরে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ফ্লয়েডকে বেলে রিভে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই আমান্ডা ওয়ালার তাকে টাস্ক ফোর্স এক্স বা সুইসাইড স্কোয়াডে নিযুক্ত করে।

সুইসাইড স্কোয়াডে ডেডশট © DC Comics News

ফ্লয়েডের অতীতের এই সংস্করণে, তার যয়ি এবং এডওয়ার্ড নামে দুই সন্তান ছিল, তবে প্রথমদিকে যয়ির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। ব্যর্থ হওয়া এক পুরনো মিশন তাকে দিয়ে জোর করে শেষ করানোর জন্য তার নিয়োগকর্তা তখনকার অ্যান্সেম ব্রাদার্স গ্যাংকে ভাড়া করে। অ্যান্সেম ব্রাদার্স তার ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ছেলেকে মুক্ত করতে ফ্লয়েড অ্যান্সেমদের হেডকোয়ার্টারে হানা দেয়। তবে ফ্লয়েড পৌঁছানোর আগেই গুণ্ডা দুই ভাইয়ের একজন, এডওয়ার্ডকে অন্যত্র সরিয়ে নেয় এবং তার উপর অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন চালায়, যার এক পর্যায় এডওয়ার্ড মারা যায়। এই ঘটনাটি তার জীবনে আরও একবার প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। একসময় সে আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে উঠে। তারপর একদিন সে হঠাৎ আবিষ্কার করে, যয়ি নামে তার একটি মেয়ে আছে, যার মধ্যে দিয়ে সে আবার নতুন করে বাঁচার কারণ খুঁজে পায়।

পরবর্তীতে ‘নিউ ৫২’ সিরিজ চালু হবার পর তার পরিবার এবং উৎপত্তি একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, ফ্লয়েডের জন্ম গোথামের সঙ্কীর্ণ অঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে। দুর্ঘটনাক্রমে দুই গ্যাংয়ের মধ্যকার গোলাগুলির সময় তার মা-বাবা এবং ছোট বোন প্রাণ হারায়। প্রতিশোধের নেশায় সে একজন শার্প শ্যুটার হওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু করে। পরে অবশ্য গল্পের প্রয়োজনের এই পুরো ব্যাপারটিকে ফ্লয়েডের মনগড়া কাহিনী বলে চালিয়ে দেওয়া হয় এবং ‘মডার্ন এজে’ এর কাহিনী পুনরায় নতুন করে একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়। তার দুই সন্তানের ব্যাপারটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। নতুন কাহিনী অনুযায়ী তার একটি ছেলে রয়েছে, নাম সুচিন।

ক্যাপ্টেন বুমেরাং / জর্জ ‘ডিগার’ হার্কনেস

ক্যাপ্টেন বুমেরাং নামে পরিচিত জর্জ হার্কনেস হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান এক ভয়ংকর দুর্বৃত্ত, যার ট্রেডমার্ক অস্ত্র হল উন্নত জাতের বুমেরাং। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি আর যন্ত্রপাতি দিয়ে সে তৈরি করতে পারে মারাত্মক সব বুমেরাং, যেগুলো সে প্রয়োগও করতে পারে খুব নির্মমভাবে।

ফ্ল্যাশের ১১৭ নম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ © DC Comics

জর্জ হার্কনেসকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুপারহিরো ফ্ল্যাশ নিয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত কমিকস বইয়ের ১১৭ নম্বর ইস্যুতে। অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সৈনিক উইলার্ড ওয়াল্টার উইগিন্স (ওয়াল্ট) এবং অস্ট্রেলিয়ার এক গৃহিণী বেটি হার্কনেসের অবৈধ সন্তান জর্জ হার্কনেস। যুদ্ধরত আরেক অস্ট্রেলিয়ান সৈনিকের স্ত্রী বেটি হার্কনেসের সাথে ওয়াল্টের পরিচয় হয় এবং তারা একসময় পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু আর্মি থেকে অবসর নেওয়ার পর অন্ত:সত্ত্বা প্রেমিকাকে ফেলে ওয়াল্ট পাড়ি জমায় সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে সেন্ট্রাল সিটিতে সে এক খেলনার কোম্পানির সেলসম্যানের চাকরি নেয় এবং ধীরে ধীরে নিজেকে সে প্রতিষ্ঠিত করে সেই কোম্পানির প্রধান হিসেবে। জর্জ হার্কনেস তার আসল বাবা ওয়াল্টার উইগিন্সের কথা জানতো না। পরে তার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন হার্কনেসের কাছে ওয়াল্ট তাকে বলে যে, সে তার আসল বাবা।

ক্যাপ্টেন বুমেরাং © DC Comics

জর্জ বেড়ে উঠে অস্ট্রেলিয়ার এক ছোট শহর কুরাম্বুরাতে; তার মা এবং সৎ বাবা ইয়ানের ঘরে। দরিদ্রতা আর সন্দেহভাজন বাবার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ জর্জের ছেলেবেলা খুব একটা সুখের ছিল না। কৈশোরেই সে আবিস্কার করে, বুমেরাং চালনায় রয়েছে তার সহজাত প্রতিভা এবং ওই বয়সেই এর ব্যবহার পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে সে।

অল্প বয়সেই এক ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে জর্জ হার্কনেস। বুঝতে পেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় তার সৎবাবা। তার মা তাকে সেন্ট্রাল সিটি যাওয়ার প্লেনের টিকেট কিনে দেয় এবং ডব্লিউ. ডব্লিউ. উইগিন্সের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলে। এদিকে নতুন বুমেরাং জাতীয় খেলনার জন্য মুখপাত্র খুঁজছিল উইগিন্স। জর্জ গ্রিন নামে সেখানে অডিশন দেয় হার্কনেস এবং কাজটি পেয়েও যায়। কস্টিউমের পাশাপাশি তাকে নতুন একটি নামও দেয় ওয়াল্টার।

সুইসাইড স্কোয়াডের সাথে ক্যাপ্টেন বুমেরাং © DC Comics

সেন্ট্রাল সিটিতে ক্যাপ্টেন বুমেরাং নামে পরিচিতি পায় জর্জ হার্কনেস। সেখানে ভালোভাবে জীবন শুরু করলেও, খুব শীঘ্রই আবার অপরাধ জগতে ফিরে যায় সে। নতুন পাওয়া ছদ্মনাম (ক্যাপ্টেন বুমেরাং) ব্যবহার করে জুয়েলারি চুরি করা শুরু করে সে এবং সুপারহিরো ফ্ল্যাশের নজরে আসে। পরে ফ্ল্যাশ বিরোধী ‘দ্য রোগস’ দলে যোগদান করে জর্জ। বেশ ক’বার মোকাবেলার পর ফ্ল্যাশ তাকে ধরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। পরে আমান্দা ওয়ালার প্রায় জোর করেই তাকে সুইসাইড স্কোয়াডে নিযুক্ত করে।

কমিকস বইয়ের প্রত্যেকটি চরিত্র আসলে রীতিমতো গবেষণা করার মতো। তাছাড়া ডিসি কমিকস তাদের সিরিজগুলো প্রায়শই নতুন করে রচনা করে, তাই বিভিন্ন কাহিনীতে চরিত্রগুলোর অতীত সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলা হয়েছে। সেগুলো থেকেই তাদের অতীত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কমিক জগত মূলত বিভিন্ন সুপারহিরোকে নিয়ে গড়ে উঠলেও, সেখানে দুর্ধর্ষ ভিলেনদের অংশও কম নয়। বলতে গেলে, ভিলেনদের নিষ্ঠুরতাই সুপারহিরোদের সার্থক করে তুলে। তাই যতদিন কমিকগুলো বেঁচে থাকবে, ততদিন সুপার ভিলেনদের গল্পও সমান ভাবে কমিকের পাতায় রচিত হতে থাকবে।

ফিচার ইমেজ- DC Comics

Related Articles

Exit mobile version