সম্ভবত বছর দুই আগের কথা। আমার পাশের রুমের বন্ধু একটা বই পড়ছিল। নাম ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’। জিজ্ঞেস করলাম, কী নিয়ে লেখা? সে বলেছিল, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের জীবনী নিয়ে লেখা উপন্যাস। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার একটি বিশাল বই দেখে আর অতোটা আগ্রহ করিনি তখন। তবে,তাজউদ্দীন আহমেদের প্রতি একটা আগ্রহ সবসময়েই ছিল।
পরবর্তীতে একসময় তাজউদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে টুকটাক ঘাটাঘাটি শুরু করি। মানুষটির অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করতে শুরু করে। কিন্তু, যতটা পাচ্ছিলাম তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। আমার পড়া বইগুলোতে যেন পুর্ণাঙ্গভাবে উনার কথা আসেনি সেভাবে। তাই, খুঁজতে শুরু করলাম উনার সম্পর্কে মোটামুটি ভালো মানের কোনো বইয়ের। সে সময়ে এক স্বল্প পরিচিত মানুষ এই কোরবানীর ঈদের রাতে আমাকে পরামর্শ দিলেন ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ বইটি। ধন্যবাদ জানাই তাকে।
কাহিনী শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তার ফাঁকে ফাঁকে ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। তাজউদ্দীনের শৈশব, রাজনীতির শুরু, সংগ্রাম, ত্যাগ-সবকিছু ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে বইয়ের পাতায় পাতায়। অনেকগুলো গল্প চলে সমান্তরালভাবে। উঠে আসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা, উঠে আসে জেনারেল খালেদ মোশাররফ, ইয়াহিয়া খান, খন্দকার মোশতাক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শেখ মনি, মাওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানী, সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
আরো অনেক অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের নাম, তাদের ঘটনাসমূহ উঠে এর পাতায় পাতায়। কীভাবে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়, কীভাবে কীসব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয় এই স্বাধীন বাংলার সরকারকে এবং কী অসাধারণ বিচক্ষণতায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও তার অন্যান্য বিচক্ষণ সযোগীবৃন্দ সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন, তা উঠে আসে। উঠে আসে খন্দকার মোশতাকের পরিচয়, তার বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকা এবং তাজউদ্দীন আহমদের সাথে তার ক্ষমতার শীতল দ্বন্দ্ব।
উপন্যাসটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। পূর্বখণ্ড এবং উত্তরখণ্ড। পূর্বখণ্ড পড়ে পাঠক জানতে পারবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক না জানা ঘটনা।বুঝতে পারবেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামের পেছনে এক মাস্টারমাইন্ড গেইম চলেছে পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, যার একজন মূল খেলোয়াড় ছিলেন তাজউদ্দীন। এর মাঝেই উঠে আসবে তার শৈশবের ঘটনা, তার পরিবারের সংগ্রামের ঘটনা।
উত্তরখণ্ড লেখা হয়েছে দেশ স্বাধীনের পর কী পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় এই সরকারকে। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ হয়ে যান তখন অর্থমন্ত্রী। তিনি কীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের খোঁজে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান সেই ঘটনা উঠে আসে। দ্বারে দ্বারে সাহায্য খুঁজতে গিয়ে কীভাবে উনার দারুণ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে নতুন দেশের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিকে সচল করার চেষ্টা করেন সেই না জানা কাহিনী জানা হয় এখানে। সাথে উঠে আসে কত প্রতিকূলতার ভেতর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে এবং দেশের বাইরে সময় অতিবাহিত করেছেন। কীভাবে বিভিন্ন গুজব উঠে সরকারের নামে। উঠে এসেছে তখনকার সামাজিক পরিস্থিতির চিত্র। উঠে এসেছে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদের একা হয়ে পড়ার করুণ ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে এক সময়ের বাঘের মতো প্রতাপশালী চরিত্র কীভাবে কোণঠাঁসা হয়ে পড়েন, তা বুঝে যাবেন এখানে। হয়তো অনেক কষ্টও পাবেন, উনার করুণ পরিণতি দেখে।
কোনো সাহিত্যই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। এই বইটিতেও কিছু কথা বলা আছে, যা কিছুটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাই লেখক সুহান রিজওয়ান বইয়ের শেষে একটি পৃষ্ঠায় কোথা থেকে কী তথ্য সংগ্রহ করেছেন সেগুলো তথ্যসূত্র আকারে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্ন বাস্তব এবং কাল্পনিক চরিত্রের জবানীতে বর্ণনা করেছেন যেন পাঠকের বুঝতে সমস্যা না হয়। এদিক দিয়ে বলতে গেলে বলা যায় তিনি সফল।
পরিশেষে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ এবং জনাব তাজউদ্দীন আহমদের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য বইটি এক কথায় অসাধারণ। আমার ঝুলিতে এতদিন হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ ছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কথাসাহিত্যের সহজ সুন্দর উপন্যাস। ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ পড়ার পর আরেকটি অর্জন হলো আমার।
তথ্যগত এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরার দিক থেকে ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ অনন্য। কারো যদি আগ্রহ থাকে নীতিবান মানুষ, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং মমতাময় বাবা সম্পর্কে জানার তাহলে তাজউদ্দীনের জীবন অনুসন্ধান করুন। কারো যদি আগ্রহ থাকে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সৎ ও আদর্শবান একজন নেতা সম্পর্কে ধারণা নেবার তাহলে তাজউদ্দীনের জীবন অনুসন্ধান করুন। আর তাজউদ্দীনের জীবন অনুসন্ধান করতে চাইলে দেখুন ‘সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ’।
যদি আগ্রহ থাকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বিশ্বস্ততা, তার এবং তার পরিবারের ত্যাগের কথা জানার, তাহলে এই বই উপযুক্ত। আবিষ্কার করবেন বঙ্গবন্ধুর ছায়ার নিচে ঢাকা পড়ে ছিল আরেক পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব, যাকে ভুলতে বসেছিল বাংলার মানুষ। আবিষ্কার করবেন স্বাধীনতার পেছনে যে মানুষটার অবদান, তার ঋণ শোধ করার সামর্থ্য কোনোদিন হবে না, এই দেশের মানুষের।