মার্কিন রহস্যলেখক জেমস রোলিন্সের বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য জুডাস স্ট্রেইন’। ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের অন্যান্য বইয়ের মতোই এই বইটিতেও বিজ্ঞান ও ইতিহাসের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।
‘দ্য জুডাস স্ট্রেইন’ এর কাহিনীর শুরু রহস্যময় এক ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণার মাধ্যমে। বিখ্যাত অভিযাত্রী মার্কো পোলো চীনা সম্রাট কুবলাই খানের সাম্রাজ্য থেকে বিদায় নিয়ে ভেনিস প্রত্যাবর্তনের পথে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছিলেন।বাবা-চাচার কাছে মায়ের মৃত আত্মার নামে শপথ করেছিলেন মার্কো, এই দুর্যোগের কথা কখনো প্রকাশ করবেন না। কী ছিল সেই দুর্যোগ? তার সাথে বর্তমানে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের কি সম্পর্ক?
ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ক্রিসমাস আইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছে রহস্যময় এক সংক্রামক রোগ। বিভিন্ন বিষয়ে ডক্টরাল ডিগ্রি থাকা প্রাক্তন স্পেশাল ফোর্সের সদস্যের নিয়ে গড়া ‘ডারপা’র গবেষণা এবং উন্নয়ন বিষয়ক গোপন বিভাগ ‘সিগমা ফোর্স’ এর দুই সদস্য ড. মঙ্ক কক্কালিস আর ড. লিসা কামিংসকে পাঠানো হল ক্রিসমাস আইল্যান্ডের সেই রহস্যের কিনারা করতে।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর ভাইরাস ‘দ্য জুডাস স্ট্রেইন’। আর তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করার নামে পৃথিবীতে বায়োটেরোরিজম ছড়িয়ে দিতে চাইছে রহস্যময় গুপ্তসংগঠন ‘দ্য গিল্ড’। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে ঘনিয়ে আসছে এক মহাপ্রলয়।
এদিকে স্বাধীনতা দিবসের রাতে কমান্ডার গ্রেসন পিয়ার্সের বাড়ির দরজায় বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেল দুধর্ষ গিল্ড এজেন্ট, ড্রাগন লেডি শেইচানকে। শেইচানের কাছে জানা গেল, মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে পৃথিবী। পৃথিবীর রক্ষাকবচ নাকি এঞ্জেলিক স্ক্রিপ্ট খোদিত প্রাচীন এক স্মারক স্তম্ভ। এই স্মারক স্তম্ভের ভিত্তি প্রোথিত আছে ইতিহাসের অনেক গভীরে। এর সাথে জড়িয়ে আছে রহস্যময় অভিযাত্রী মার্কো পোলোর জীবনকাহিনী। এই জটের সমাধান করতে মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে কমান্ডার গ্রে তার দলবল নিয়ে ছুটল প্রাচীনত্ব আর আধুনিকতার মিশেল ঐতিহাসিক নগরী ইস্তাম্বুলে।
তারপর তাদের দাপিয়ে বেড়াতে হলো পার্সিয়ান আইল্যান্ডের দ্বীপ হরমুজ থেকে কম্বোডিয়ার ভাঙা মন্দির এঙ্কর ওয়াটে।
একদিকে বাবা-মার নিরাপত্তা সংকট, অন্যদিকে পৃথিবীর মহাবিপদ- কমান্ডার গ্রে কি পারবেন এই মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করতে? বইটিতে সিগমা এবং গোপন সংগঠন ‘দ্য গিল্ড’ এর চিরাচরিত দ্বন্দ্বকে উপস্থাপন করা হয়েছে সুনিপুণভাবে। বিজয় কার ভাগ্যে জোটে? সিগমা না গিল্ড? কীভাবে? ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া- তিন মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত বইটির পটভূমি। চার্চ, দুর্গ, মন্দির থেকে নরখাদকদের দ্বীপ- এরকম চমকপ্রদ আর রহস্যঘেরা অদ্ভুতুড়ে সব জায়গায় পরিচালিত সিগমা সদস্যদের রোমাঞ্চকর অভিযানগুলো পাঠককে শিহরিত করে। বইটিতে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উন্মোচন করেছেন ইতিহাসের একের পর এক অজানা অধ্যায়কে। মার্কো পোলোর রহস্যময় জীবন, ভেনিসে ফিরতি সফরে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ, মৃত্যুর পর তার লাশের অন্তর্ধান প্রভৃতি ঘটনার প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায় এই বইটিতে।
মৃত্যুশিয়রে বসে মার্কো তার প্রাচ্যসফর নিয়ে হেঁয়ালিপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন- “যা দেখেছি, তার অর্ধেকও আমি বলিনি।” মার্কোর এ কথা যে কতখানি সত্যি, তা বোঝা যায় বইটি পড়লে। মার্কোর না বলা অনেক কথাই যেন জেমস রোলিন্স বলেছেন এই বইটিতে ।
“নরকের দরজা খুলে গিয়েছিল সেখানে, আর বন্ধ হয়েছিল কিনা জানা নেই।” গোপন সিল্কের স্ক্রলে মার্কোর লিখে রাখা এই কথাটির অর্থ কী? “দ্য জুডাস স্ট্রেইন” এর সাথে কি সম্পর্ক এর? সত্যিই কি অস্তিত্ব আছে ফেরেশতাদের ভাষা এঞ্জেলিক স্ক্রিপ্টের?এসব কিছু জানতে হলে পড়ে ফেলুন বইটি। বইটিতে ভাষাতত্ব, ভূগোল আর পুরাণের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। আর বিজ্ঞান তো আছেই। ব্যাকটেরিওলজি, ভাইরোলজি, সংক্রামক রোগ, জেনেটিক্স প্রভৃতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে বইটিতে। জীববিজ্ঞানে আগ্রহী বা যারা সায়েন্স ফিকশনে জীববিজ্ঞান পছন্দ করেন- এরকম পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই এটি। একে তো জেমস রোলিন্সের বই, তার উপর ‘সিগমা ফোর্স’; তাই, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই।
বইটিতে রয়েছে ‘সিগমা ফোর্স’ এর দ্বিতীয় উপন্যাস, তুমুল আলোচিত বই ‘ম্যাপ অব বোনস’ এর গ্রে-শেইচান-ভিগর ভেরোনা রত্নত্রয়ী। ভিগরের বুদ্ধিদীপ্ত বচনে চলে যাওয়া যায় ইতিহাসের গহীনে। গ্রের ব্যক্তিত্বপূর্ণ নেতৃত্ব আর শেইচানের চাতুর্যে ভর্তি প্রতিটি অভিযান থেকে পাওয়া যায় অসাধারণ রোমাঞ্চের সাক্ষাৎ।
ওদিকে মঙ্ক আর লিসা তো রইলই বিজ্ঞানের নানা রহস্যভেদ করতে। ‘দ্য জুডাস স্ট্রেইন’ এ জেমস রোলিন্স গ্রের সহকারী হিসেবে এনেছেন বিশালদেহী গার্ড কোয়ালস্কিকে। তার ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘আইস হান্ট’ বইয়ে কোয়ালস্কির উপস্থিতি ছিল। বইটিতে সিগমা সদস্য মঙ্ক কক্কালিস পার্টনার লিসাকে উদ্ধার করতে গিয়ে হারিয়ে যায় ভারত মহাসাগরের অতলে।
নিউইয়র্ক টাইমস’ স্বীকৃত বেস্টসেলার এই বইটি সম্পর্কে গণমাধ্যমের রিভিউ জেনে আসি চলুন।
“জেমস রোলিন্সের সাথে পরিচিত নন এমন থ্রিলার/এডভেঞ্চার প্রেমীদেরকে বইটি পড়তে জোর আহ্বান জানানো হচ্ছে।”
– বুকলিস্ট“অবিশ্বাস আর যুক্তি নিয়ে খুঁতখুতে কাজগুলো বাদ দিতে পারলে বইটি পাঠকদের জন্য অসম্ভব মজার হবে বলা যায়। সংগ্রহে রাখার মতো অসাধারণ একটি থ্রিলার।”
– লাইব্রেরি জার্নাল“চিত্তাকর্ষক সব জায়গায় একের পর এক অ্যাকশন আর কল্পবিজ্ঞানের প্রাচুর্য বাস্তবজ্ঞান এবং শ্বাসরুদ্ধকর কিছু কাকতালীয় ঘটনা থেকে চিত্তবিক্ষেপ ঘটাতে যথেষ্ট।”
– কিরকাস
এটি সায়েন্স ফিকশনের ক্যাটাগরিতে পড়লেও উপস্থাপিত বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং যুক্তিগুলো যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। বিজ্ঞানের এমন নিখু্ঁত বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, লেখকের নিশ্চয়ই লাইফ সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। এই ধারণাটি আসলে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। জেমস রোলিন্স ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরি থেকে ভেটেরেনারি সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন। তারপর পশুচিকিৎসা থেকে পুরোপুরি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। জনপ্রিয় এই মার্কিন লেখক মূলত থ্রিলার, এডভেঞ্চার, রহস্যসাহিত্য জাতীয় লেখার জন্য বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে তার অবাধ বিচরণ রয়েছে ফ্যান্টাসি সাহিত্যেও। ‘উইচ ওয়ার’, ’উইচ স্টার’, ’উইচ গেইট’ প্রভৃতি বই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জেমস রোলিন্সের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘উইচ ফায়ার’। তার প্রথম থ্রিলার উপন্যাস ‘সাবটেরানিয়ান’ প্রকাশিত হয় হয় ১৯৯৯ সালে। ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের প্রথম বইয়ের নাম ছিল ‘স্যান্ডস্টর্ম’। এটি প্রথম ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। গোপন বিভাগ ‘সিগমা ফোর্স’ গঠিত হয়েছে আর্মি ট্রেনিং থাকা এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ডক্টরেট করা দক্ষ সদস্যদের নিয়ে, যারা মূলত আমেরিকার প্রযুক্তি ও নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন মিশন নিয়ে কাজ করে। কমান্ডার গ্রের বন্ধু মঙ্ক অবশ্য মজা করে সিগমাকেকে ‘খুনে বিজ্ঞানীর দল’ বলে থাকেন। এ পর্যন্ত ‘সিগমা ফোর্স’ সিরিজের মোট ১৩টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। জেমস রোলিন্সের স্ট্যান্ড এলোন গ্রন্থগুলোও দারুণ জনপ্রিয়। ‘সাবটেরানিয়ান’, ’আমাজনিয়া’, ’আইস হান্ট’, ’অল্টার অব দ্য ইডেন’, ’এক্সকাভেশন’ প্রভৃতি তার রচিত জনপ্রিয় উপন্যাস। যারা ইংরেজিতে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাদের জন্য সুসংবাদ হচ্ছে ‘দ্য জুডাস স্ট্রেইন’এর বাংলা অনুবাদও রয়েছে। ওয়াসি আহমেদের সাবলীল অনুবাদ করা বইটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। বইটিতে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের জটিল ব্যাখা-বিশ্লেষণকে সহজ করে বলা হয়েছে। ৪০০ এর বেশি পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে শুরু করলে এর বিশাল কলেবরও একদমই কম মনে হয়। শ্বাসরুদ্ধকর এই থ্রিলারটি অনায়াসে আপনাকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ধরে রাখবে। বইটি পড়ে শুধু মজাই পাবেন না, সাথে দুর্লভ অনেক জ্ঞানও আহরণ করতে পারবেন। তাই, অনন্যসাধারণ এক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে আজই পড়ে ফেলুন বইটি।
বইয়ের নাম: দ্য জুডাস স্ট্রেইন
লেখক: জেমস রোলিন্স
ক্যাটাগরি: থ্রিলার,অ্যাডভেঞ্চার,সায়েন্স ফিকশন
পৃষ্ঠা: ৪৬৪
প্রথম প্রকাশ: ২০০৭
গুডরিডস রেটিং: ৪.১৫