মাতৃত্ব এক পাহাড়সম বোঝা।
কোনো মায়ের মুখে কি এমন কথা মানায়? লেডার উক্তির সময় তার পাশে থাকা মানুষদের অভিব্যক্তিতেও ঠিক এই প্রশ্নই ফুটে ওঠে। এমনই বেমানান এক মায়ের গল্প ফুটিয়ে তুলেছেন ম্যাগি গিলেনহাল, নিজের ডিরেক্টরাল ডেব্যুতে।
লেডার আচার-আচরণ খাপছাড়া। সে এরকম কেন- এই প্রশ্ন প্রথমেই এসে হানা দেয় দর্শক এবং তার আশপাশের চরিত্রদের মনে। একাধারে অধ্যাপক এবং অনুবাদক এই নারীর নাম এসেছে যেন ইয়েটসের কোনো কবিতা থেকে। তাকে যখন আমরা প্রথমবার দেখি, তখন সে গ্রীসে ছুটি কাটাতে এসেছে।
কিন্তু তার আগমনের সাথে সাথে সমুদ্রতীরবর্তী ছোট্ট শহরে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। আর তার আচরণ তাকে এসব ব্যাপারের কেন্দ্রে নিয়ে যায়। যেকোনো ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া সবাইকে অপ্রস্তুত করে দেয়। ‘দ্য লস্ট ডটার’ নির্মিত এলেনা ফারান্তের ২০০৬ সালে প্রকাশিত একই নামের উপন্যাস থেকে। ক্যামেরার পেছনে নিজের অভিষেকে ম্যাগিও করলেন বাজিমাত। প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকদের জন্য বানানো সিনেমাটি একাধারে কষ্টদায়ক, মর্মভেদী, এবং অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ।
ড্রামা/সাইকোলজিক্যাল ড্রামা ঘরানার চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে অসাধারণ দিক সম্ভবত পরিচালকের জেদি মনোভাব। তিনি মূল চরিত্রের রহস্যময় আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করতে চান না। প্রচুর ব্যাকস্টোরি আমরা জানতে পারি। কিন্তু এসব তথ্য থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দুষ্কর। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে ভোগা লেডা বুঝতেই পারে না সে কী করছে। দিনের অনেকটা সময় তার ব্যয় হয় নিজের সাথে যুঝতে। দ্য লস্ট ডটারের গল্পের আবর্তন অত্যন্ত বন্ধুর এক পরিমণ্ডলে। মূল উপন্যাসের মতোই ম্যাগি গল্প বলিয়েছেন প্রথম পুরুষের জবানীতে, পাখির চোখে দেখেছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রকে। যার ফলে কখনো কখনো অস্বস্তি, এবং ভীতিকর আবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মনেও প্রশ্ন জেগেছে, বর্ণনাকারী হিসেবে লেডা কি বিশ্বাসযোগ্য?
সংক্ষেপে ১২৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের মুভিটির কাহিনী বলে নেওয়া যাক এবার। বেড়াতে এসে থিতু হয় লেডা (অলিভিয়া কোলম্যান)। সৈকতে গিয়ে বই পড়ে, সাঁতার কেটে, এবং নিকটবর্তী বাতিঘরের আলোয় উদ্ভাসিত ঘরে ঘুমানোর চেষ্টা করে সময় কেটে যায় তার। ভাড়া বাসায় কেয়ারটেকার লাইল (এড হ্যারিস) উপকারী এবং মিশুক প্রকৃতির। কিন্তু তার সাথে লেডার মিথস্ক্রিয়া আন্তরিকতাশূন্য। এমনিতে সে বিনয়ী, কিন্তু সামাজিক কুশলাদি বিনিময়ে অক্ষম। অন্যের সাথে কথোপকথন উপভোগের বদলে সহ্য করে সে। আর অপেক্ষা করে কখন অন্যজন কথা বলা বন্ধ করবে।
দিন দুয়েক এভাবে কেটে যায়। সৈকতে আগমন ঘটে বৃহদাকার, তারস্বরে হৈচৈ করা এক পরিবারের। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে বইয়ে মনোযোগ দিতে পারে না লেডা। ফলে সে দেখতে থাকে ঐ পরিবারকে, অনুমান করে এসব লোকজনের কে কেমন হতে পারে। তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিনা (ডেকোটা জনসন), এবং তার বাচ্চা মেয়ে। কিন্তু তার এই আকর্ষণ স্বাভাবিক বলে মনে হয় না আমাদের কাছে। তার চোখ কেবল তাদেরই অনুসরণ করে।
লেডা যখন মা-মেয়েকে মনোযোগের সাথে দেখছিল, তখন ছন্দপতন ঘটায় ক্যালি (ড্যাগমারা ডমিনচিক) নামে ঐ পরিবারের এক সদস্য। বেশি বয়সে গর্ভধারণ করা ক্যালি লেডাকে একটু সরে বসতে বলে, যেন তাদের পরিবারের সবাই একসাথে বসতে পারে। তাকে অবাক করে দিয়ে লেডা সরে বসতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে সারাদিন ঐ পরিবারের লোকেরা তার দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকায়, আর দিনটা মাটি করে দেয়। ফলে সে ফিরে যায় ঘরে। যদিও পরদিন আবার একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়।
রহস্যময় এবং সনির্বদ্ধ এ সকল বর্তমানের দৃশ্যের সাথে গিলেনহাল জুড়ে দিয়েছেন কিছু বিক্ষিপ্ত দৃশ্য। যেগুলোতে প্রতীয়মান হয় লেডার জীবনের ২০ বছর আগেকার ঘটনাবলী। এগুলোকে ফ্ল্যাশব্যাক বলা চলে না। বরং এগুলো প্রবাহিত হয় একটি সমান্তরাল স্রোতে, যা জন্ম দেয় এক সংবেদনশীল দুর্বোধ্যতার। লেডার তরুণী বয়সের চরিত্রে দেখা গেছে জেসি বাকলিকে। কম বয়সের লেডা বিরক্ত, ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত। ক্যারিয়ার আর মাতৃত্বের দোটানায় সে সর্বক্ষণ নিষ্পেষিত। সে এসব চাপ আর দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তি চায়, উড়তে চায় মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায়। এমতাবস্থায় তার কাজে আগ্রহ দেখায় বিখ্যাত স্কলার, প্রফেসর হার্ডি (পিটার সার্সগার্ড), যা তার ভারসাম্যহীন জীবনকে আরো ভারসাম্যহীন করে দেয়।
একসময় লেডার সাথে নিনার বন্ধুত্ব হয়। তাদের বন্ধুত্বে লেডা মাতৃরূপে পরিলক্ষিত হয়, যাকে নিনা স্বরণ করিয়ে দেয় ফেলে আসা দিনের কথা। তবে তার অন্যান্য সব সম্পর্কের মতো লেডার এই সম্পর্কও স্বাভাবিক বলে মনে হয় না আমাদের কাছে। তার আগ্রহ একটু বেশিই প্রবল, যা গোলমেলে রুপে ধরা দেয়। নিনার যে ধরনের আচরণ, সময়ের সাথে তার পেছনের কারণ খোলাসা হয়। তাদেরকে সবসময় চোখে চোখে রাখে ক্যালি। ঝামেলা থেকে বাঁচতে চাইলে ক্যালির চেয়ে যতটা দূরে থাকা যায়, ততটাই মঙ্গল।
দ্য লস্ট ডটারকে শেষপর্যন্ত লেডার অনুপুঙ্খ ক্যারেক্টার স্টাডি বলা চলে। সর্বদা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এই কেন্দ্রীয় চরিত্রের আচরণ নার্সিসিজমের কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যদেরকে তার সবসময় খারাপ বলে মনে হয়। কেউ ভালো আচরণ করলেও তার সন্দেহ যায় না, যা তার ইনসিকিউরিটি, এবং নিজেকে নিজে মেনে নিতে না পারার পরিচয়ই বহন করে। তার মনে হয়- সবাই মনে মনে তার ক্ষতি করতে চায়, চায় কোনো না কোনোভাবে তার থেকে ফায়দা লুটতে। এসব বিষয় পরিষ্কার হয় সদা বন্ধুবৎসল লাইলের সাথে তার আচরণে। ছেলের বয়সী বিচ ক্লাবের কর্মচারীও তার রুঢ় আচরণ থেকে নিস্তার পায় না। সে কেন এমন, আর মানুষের সাথেই বা কেন এমন আচরণ করে- তা আমরা জানতে পারি সিনেমার পরবর্তী অংশে।
রিলেটিবিলিটি বা কাল্পনিক চরিত্রের সাথে দর্শকের নিজেদের মিল খুঁজে পাওয়া- এই ব্যাপারটি সিনেমার বাণিজ্যিক সফলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রায়শই রিলেটেবল না হওয়ার কারণে দর্শক কোনো চলচ্চিত্র থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু কখনো কখনো এমন সব শিল্পকর্ম তৈরি হয়, যেগুলো রিলেটিবিলিটির ধার ধারে না। কাল্পনিক চরিত্রের ভেতর দিয়ে এসব শিল্প চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে আমরা কতটা অসার। দেখিয়ে দেয় আমাদের চরিত্রের ইনসিকিউরিটি এবং অন্ধকার দিকসমূহকে, যেগুলোকে আমরা গোপন করতে বদ্ধপরিকর। দ্য লস্ট ডটার ঠিক এমনই এক কাজের উদাহরণ। এটি সমাজের দৃষ্টিতে খারাপ একজন ‘মা’-এর গল্প বলে। মেনে নেয় সেই মায়ের কদর্য দিকসমূহ, দেয় তার চরিত্রের পরিস্ফুটনের পর্যাপ্ত সময় এবং অনুকূল পরিবেশ। বাধ্য করে না বর্ণচোরা হয়ে সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে।
বাণিজ্যভাবে অতটা ভালো করতে না পারলেও দ্য লস্ট ডটারকে সমালোচকরা গ্রহণ করেছেন সাদরে। ৯৪ তম অস্কারে সেরা অভিনেত্রী (অলিভিয়া কোলম্যান), সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী (জেসি বাকলি), এবং সেরা চিত্রনাট্য (ম্যাগি গিলেনহাল) বিভাগে মনোনয়নই তার প্রমাণ। পরিচালকের অনবদ্যতার পাশাপাশি সিনেম্যাটোগ্রাফার এলেনা লুবঁ এবং সংগীত পরিচালক ডিকন হিঞ্চক্লিফও বাহবা পাবেন এজন্য। তাদের মুন্সিয়ানায় সিনেমার মেজাজ স্থানান্তরিত হয়েছে দর্শকের মাঝে।
বিষয়বস্তু আর তার ব্যবহারের ধরনের কারণে সিনেমার শেষে হয়তো আপনি অস্বস্তিতে পড়বেন। তবে সব শিল্পকে দর্শকদের মাঝে ভালো অনুভূতির জন্ম দিতে হবে, ভালো মানুষের গল্প বলতে হবে- এমন নিয়মই বা কোথায় লেখা আছে! তাই আগ্রহ জাগলে পাঠকও দেখতে পারেন দ্য লাস্ট ডটার, সুঅভিনেত্রী ম্যাগি গিলেনহাল পরিচালনায় অভিষিক্ত হন যে সিনেমার মাধ্যমে।