বাংলা সাহিত্যের আকাশে কাজী নজরুল ইসলাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম, যার কবিতা, গান ও গজলে রয়েছে অন্যরকম এক ছন্দের দোলা। একেবারে মাটির কাছ থেকে উঠে আসা এই কবি পুরো দুনিয়াকে বানিয়েছিলেন পাঠশালা। তার লেখায় কখনো বিদ্রোহের ঝংকার ওঠে, আবার কখনো তা প্রেম-ভালোবাসায় মিশে একাকার হয়। সবার আমি ছাত্র হিসেবে একদিন কবি চুরুলিয়া থেকে বেরিয়ে পড়লেন। জগতের ধরাবাধা নিয়ম তাকে আটকাতে পারল না। পুরো পৃথিবী যার শিক্ষক, তাকে কে আটকাবে? কবি তার জীবন থেকে আহরণ করা জ্ঞান সাহিত্যে প্রয়োগ করলেন। হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের একজন যুগস্রষ্টা।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটা স্বীকার করতে হবে যে, বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় প্রথমদিকে গদ্যে যতটা দক্ষতা দেখিয়েছিল, পদ্যে তখনও ঠিক ততটা পারেনি। পেছন ফিরে তাকালে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে গোলাম মোস্তফা ও শাহাদাত হোসেনের কবিতাগুলোই দেখি। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় কবিতা অনেকাংশেই পূর্ণতা পায়। প্রায় একই সময়ে জন্মগ্রহণ করেও পরবর্তীতে পল্লী কবি জসিমউদ্দিনের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব এগিয়ে যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে একেবারে মেঠো পরিবেশ থেকে যুগস্রষ্টা নজরুলে পরিণত হলেন, তা বিস্ময়েরই বটে। অনেক গবেষকই তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। দিন দিন বেরিয়ে আসছে আরো অজানা তথ্য। সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদানকে সাধারণ পাঠক অনেকটা অলৌকিক দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করেন। অথচ এক স্কুলপড়ুয়া বালক কোন কষ্টিপাথরের স্পর্শে এসে খাটি সোনা হলেন তার সন্ধান কেউ করে না। শুধু কাজী নজরুল ইসলামই নন, পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত লোকের সফলতার পেছনেই রয়েছে একাগ্রতা, পরিশ্রম নামক শব্দগুলো। আমরা শুধু তাদের বাহ্যিক সফলতার হাসিটুকু দেখি এবং মুগ্ধ হই।
কাজী নজরুল ইসলাম বালক বয়স থেকেই কিছুটা বাউন্ডুলে ছিলেন, এটা আমরা সবাই জানি। নিজের ইচ্ছেমতোই জীবন চালিয়েছেন। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রবল আগ্রহ তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশ্ববিখ্যাত লেখক পাওলো কোয়েলহো তার আলকেমিস্ট বইয়ে বলেছিলেন, “And when you want something, all the universe conspires in helping you to achieve it.”
কাজী নজরুল ইসলাম চেয়েছিলেন বলেই পুরো পৃথিবী তার পাশে ছিল। স্কুলের শিক্ষক থেকে সৈনিকজীবন- সবখানেই তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ডুবে থাকতে পেরেছিলেন। তার কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত প্রকাশিত বই, শরৎচন্দ্রের সমস্ত লেখা, উল্লেখযোগ্য সকল মাসিক পত্রিকা থাকত। খবর রাখতেন পুরো পৃথিবীর হালচালের। কোনো কাজের প্রতি নজরুলের একাগ্রতা সম্পর্কে তার সৈনিক বন্ধু ও সহযোদ্ধা লিখছেন,
কাজী যে কাজ আরম্ভ করত তা শেষ না করে কখনও ছাড়ত না।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তার মধ্যে সৈনিকজীবন নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে। অথচ সৈনিকজীবন তাকে গড়ে তুলতে অনেক সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনির আর্টিলারি কোরের এক কর্মকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ লুৎফুল হক। ২০০৫ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসর নেন। বাঙালির সামরিক ইতিহাস এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিকজীবনের উপর ভিত্তি করে লিখলেন আস্ত এক বই। নাম দিলেন- ‘সৈনিক নজরুল’। কাজী নজরুল ইসলাম সৈনিক ছিলেন, এ তথ্য অনেকেই জানেন। কিন্তু তার পল্টন-জীবন কেমন ছিল, সৈনিক জীবনে তিনি কী কী করেছেন, সাহিত্যজগতে সেসবের প্রভাব কী- এসব তথ্য অনেকেরই অজানা। সাহিত্যে মুহাম্মদ লুৎফুল হকের আগ্রহ রয়েছে, এবং তার নিজের পেশাগত জীবন থেকেও গ্রন্থটি রচনায় অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিকজীবন, তথা অনেক অজানা বিষয় তার লেখার মাধ্যমে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন।
লেখক কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিকজীবনের বন্ধু ও বালক বয়সের বন্ধুদের বয়ানে চিত্রপট আঁকতে চেয়েছেন। মুহাম্মদ লুৎফুল হক নিজে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকার কারণে কাজগুলো সহজ হয়েছে। শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, পুরো বিশ্বসাহিত্যেই সৈনিক কবির সংখ্যা হাতেগোনা। তাই এই কবির সৈনিকজীবনের অবশ্যই একটি সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে। তবে গ্রন্থে তার তথ্যগুলো কাজে লাগিয়ে যে কেউ আবার নতুন গবেষণার খোরাক পাবে। ফলে আমরা হয়তো আরো বিশদভাবে নজরুলকে জানতে পারব, তার সৈনিক জীবন জানতে পারব, বাঙালি পল্টন সম্পর্কে জানতে পারব।
কাজী নজরুল ইসলামের পল্টনে যোগদান সম্পর্কে লেখক শৈলজানন্দের বরাত দিয়ে লিখেছেন- ঐদিন নজরুল তাকে একটা মজা দেখানোর জন্য রেলস্টশনে নিয়ে আসেন, এবং তারা ট্রেন আসার অপেক্ষায় থাকেন। দেখতে দেখতে ট্রেন এসে প্লাটফর্ম কাঁপিয়ে দাঁড়াল। সামনের কামরায় বাঙালি পল্টনের দল। খাকি পোষাকে নানা বয়সী ছেলেরা যুদ্ধে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে, রক্ত তাদের নেশায় বিভোর, কন্ঠে স্লোগান। যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের কাছেই তা লোভনীয়। নজরুল হঠাৎ হাত তুলে বলে উঠলেন, “বন্দেমাতরম।” এরপর ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালায় মুখ বের করে হাত নেড়ে রুমাল নেড়ে পল্টন-ছেলেরা চলে গেল। কাজী নজরুল ইসলাম স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। কথার একসময়ে নজরুল তার বন্ধুর হাত আলতোভাবে চেপে ধরে বললেন, “যাবে?” শৈলজানন্দও তার সাথে গলা মিলিয়ে বললেন, “যাব।” তখনই দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে পাঠকের মনে তখনকার চিত্রপট ভেসে ওঠাই স্বাভাবিক। লেখক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাঙালির পল্টনে যোগদানের অনেকগুলো কারণ বের করেছেন। সেখানে যেমন রোমাঞ্চ ও ভীরুতার অপবাদ কাটানোর কথা রয়েছে, ঠিক তেমনই প্রেমে ব্যর্থতা ও পারিবারিক কারণও আছে। তবে লেখক কাজী নজরুল ইসলামের পল্টনে যোগদানের কারণ বিশদভাবে তুলে আনার চেষ্টা করে আবার পাঠকদের রহস্যাআবৃত করে ফেলেছেন। নজরুল-গবেষক আব্দুস সামাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যর্থ প্রেমকেও কারণ হিসেবে টেনে এনেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থখানি এক কিশোরীকে উৎসর্গ করে লিখলেন,
মানসী আমার, মাথার কাঁটা চেয়েছিলাম, দাওনি বলে বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করলুম।
তবে এতে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম পেশাগত জীবনেও সফল ছিলেন। মাত্র ৩০ মাসের পল্টন-জীবনে তিনি সৈনিক পদ থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে (ওয়ারেন্ট অফিসার দ্বিতীয় শ্রেণি) উন্নীত হন। কোয়ার্টার মাস্টার শাখার কাজ হলো সৈনিকদের থাকা বা বাসস্থানের ব্যবস্থা, খাওয়া বা রেশন সরবরাহ, ইউনিফর্ম বা পোশাকের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ, স্বাস্থ্যরক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদির তত্ত্বাবধান করা। এতে কাজী নজরুল ইসলাম নিজের মতো করে সাহিত্যচর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধের যাবতীয় প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি তাকে নিতে হয়েছিল।
শুধু কাজী নজরুল ইসলামের সৈনিকজীবনই নয়, ঘটনার অন্তরালে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাঙালি পল্টনের ইতিহাস এবং কার্যক্রমও দেখতে পাই। এমনকি, সৈনিকবেশে কাজী নজরুল ইসলামের ছবিটি ছিল তখনকার বাঙালি পল্টনের সৈনিকদের জন্য একটি দুর্লভ ছবি। তাই নজরুলের সৈনিক জীবনের সাথে বাঙালি পল্টনের ইতিহাসও জড়িয়ে অছে। লেখক গ্রন্থের শেষে এই বিষয়ে একটি পরিশিষ্টও যোগ করেছেন। কিন্তু তথ্যের অপ্রতুলতায় কিছু তথ্যের পূনরাবৃত্তি ঘটেছে। বিষয়টি লেখক নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু-সহযোদ্ধা, শৈলজানন্দ, মাহবুব-উল-আলম, শম্ভু রায়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। নজরুলের সৈনিকজীবনের বন্ধু এই শম্ভু রায় নজরুলকে “শাপভ্রষ্ট দেবতা” বলে উল্লেখ করেছেন। আর মুহাম্মদ লুৎফুল হক তার ‘সৈনিক নজরুল’ গ্রন্থের মাধ্যমে শাপভ্রষ্ট এই দেবতার অজানা অধ্যায়গুলো বলে গেলেন, এবং সৈনিক-পূর্ব জীবন এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত না লিখে বইয়ের শিরোনামের কার্যকারিতা ধরে রাখলেন। এক্ষেত্রে লেখক সাধুবাদ পাবেন। কাহিনির বর্ণনায় অতি নাটকীয় কোনো ধারা নেই, অটুট ছিল সাহিত্যিক মূল্য।
কাজী নজরুল ইসলাম এমন একসময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, যখন বাঙালির কোনো যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি তার স্কুলজীবন শেষ করার পূর্বেই পল্টনে যোগদান করেন। পরবর্তী জীবনে যখন বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেন, তখন কেন জানি তার সৈনিকজীবন ঢাকা পড়ে যায়। আর কোনো কিছু যখন অন্তরালে থাকে, তখনই অস্পষ্টতা তৈরি হয়। মুহাম্মদ লুৎফুল হকের বই ‘সৈনিক নজরুল’ অনেক অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করে তুলবে। কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে জীবনের প্রতিটি পর্যায় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছেন তা পাঠকের সামনে উঠে আসবে।
সর্বোপরি, পাঠকের মনে একটি উপলব্ধি তৈরি হবে যে- নজরুলকে পূর্ণাঙ্গ ও গভীরভাবে আবিষ্কার করতে হলে তার জীবনের সৈনিকপর্ব ভালোভাবে জানা এবং বোঝা প্রয়োজন। সৈনিক জীবন ও তার শিক্ষা গ্রামের একজন সাধারণ তরুণ নজরুলকে অসাধারণ করে তুলেছিল। পরবর্তী জীবনে এই শাপভ্রষ্ট দেবতাই হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।