জলপিপি: বাংলা সাহিত্যের নতুন ডিটেকটিভ‘অলোকেশ রয়’

গোয়েন্দা কাহিনীর প্রতি আগ্রহ অনেক পাঠকের। জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে গোয়েন্দা কাহিনীর অবস্থান সবার উপরে। এ গল্পগুলো মানুষকে যেমন আনন্দ দেয় তেমনই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেরও কাজ হয় এদের দ্বারা।

প্রায় সময়ই এক বা একাধিক খুনকে কেন্দ্র করে গোয়েন্দা উপন্যাসগুলোর মূল প্লট গড়ে ওঠে৷ তবে খুনের বাইরেও বিচিত্র ঘটনা যেমন- গুম, দুর্ঘটনা, এটেম্পট টু মার্ডার কিংবা আরো জটিল কোনো বিষয় নিয়েও গোয়েন্দা কাহিনী রচিত হয়।  কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীর মূল আকর্ষণ অন্য জায়গায়। কাহিনীতে সংঘটিত অপরাধকে ঘিরে যে সাসপেন্স তৈরি হয়, সেখানেই  মূল আকর্ষণ। কেউ যখন কোনো গোয়েন্দা কাহিনী পড়া শুরু করে, এই সাসপেন্সকে কেন্দ্র করেই পাঠক ঘুরপাক খেতে থাকে এবং সাসপেক্টকে বের না করা পর্যন্ত উৎকণ্ঠায় পাঠে নিবিষ্ট থাকেন।

বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ শব্দটা উচ্চারণ মাত্রই যেন ডিটেকটিভ ফেলুদার চিত্র কল্পনায় ভাসে। আবার এই ফেলুদার একজন আদর্শ আছেন। বিখ্যাত শার্লক হোমসই ফেলুদার আইডল। মজার ব্যাপার হলো, অরুণ কুমার বিশ্বাসের আবিষ্কার ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়ের আদর্শ ফেলুদা এবং শার্লক হোমস- দুজনই। যেমন আমরা শার্লক হোমসের ডা. জন ওয়াটসন, ফেলুদার তোপসে নামক বন্ধু দেখতে পাই, তেমনি ডিটেকটিভ অলোকের বন্ধু শুভকেও দেখতে পাই। যদিও শার্লক হোমস, ফেলুদা এবং অলোক- একেকজনের প্রেক্ষাপট একেক রকমের, একেক ধরনের।

অরুণ কুমার বিশ্বাসের গোয়েন্দা কাহিনী নির্ভর উপন্যাস ‘জলপিপি’। জলপিপি একটা পাখির নাম। পাখিটার কার্যক্রমও একজন গোয়েন্দার মতোই। তাই ডিটেকটিভ উপন্যাসের নামের সাথে জলপিপি নামটা বেশ মানানসই বলা চলে।

‘জলপিপি’ বইটির প্রচ্ছদ; Image source: pinterest.com

পুরো উপন্যাস জুড়ে আবর্তিত হয়েছে গগন চৌধুরীর মৃত্যু রহস্য। এটা কি কোনো হত্যাকাণ্ড নাকি স্রেফ আত্মহত্যা? এ প্রশ্নকে ঘিরেই একের পর এক ঘটনা এবং শহুরে সমাজের সাংসারিক জীবনের চরম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। গগন চৌধুরীর মৃত্যু রহস্য সমাধান করার দায়িত্ব ঝানু গোয়েন্দা অলোকেশ রয়ের।

গগন চৌধুরীর মৃত্যুর মতো লোকটির জীবনটাও যেন রহস্যময়। কারো কাছে তিনি পরম দয়ালু, কারো কাছে তিনি কর্পোরেট দুনিয়ার আইডল, কিংবা কারো কাছে তিনি চরম কুলাঙ্গার। আমাদের সমাজে হরহামেশাই এসব চরিত্রের সন্ধান মেলে। কিন্তু মুখ ফোটে না কারো, শত অত্যাচারেও। কীভাবেই বা এমন মানুষগুলোর আসল রূপ সমাজে ধরা দেবে? ওদের হাত যে বিশাল লম্বা! পরম মানবতার কাজকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে কতশত অনৈতিক কাজে লিপ্ত এমন গংদের সংখ্যা বেশ লক্ষণীয়। গগন চৌধুরীদের ঘরে বাইরে প্রচুর স্ত্রীলোক থাকতে হয় রাখতে হয়। এমনকি স্ত্রীলোকের বাইরেও নানান গলিঘুপচিতে ওদের যাতায়াত হয়৷ প্রয়োজন শেষে গগন চৌধুরীদের মাধ্যমে নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়৷ যার বিচারকার্য কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে সাহস পায় না। জলপিপিতে অহনার নির্মম মৃত্যু যেন সেই দৃশ্যটিরই জানান দেয়। 

অর্থে বিভোর চরিত্রহীন এই সমাজে গগন চৌধুরীদের স্ত্রীরাও ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কোনো অংশেই কম যান না। একজনের ঘরে থেকে অন্যঘরে সংসার জুড়ানো। গগনের সুদর্শন স্ত্রী আনিলা কিংবা ভদ্র মহিলা আরজু বেগম আধুনিক শহুরে সংসারের আড়াল বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ। অপেক্ষায় থাকেন সুযোগের- এই সংসারটা কখন বুমেরাং করে অন্যত্রে তরী ভেড়ানো যায়। যার বাংলা সংজ্ঞায়ন করা হয় ‘পরকীয়া’ শব্দে। জলপিপি- একটি গোয়েন্দা নির্ভর উপন্যাস হলেও লেখক সমাজে বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই যে উপাখ্যান তৈরি করেছেন- তা প্রশংসার দাবিদার। 

‘মানবিক সম্পর্কগুলো ইদানীং কেমন খসে পড়েছে। কারও প্রতি কারও যেন অন্তরের টান নেই।’ (জলপিপি, পৃ: ৯১)

বইয়ের লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাস; Image: Facebook

দুটো মানব মনের পারস্পরিক ভালোবাসা কিংবা আকর্ষণের বর্ণনা এতোটা নির্মোহভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা এর অনন্য একটি আকর্ষণও বটে। ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়ের সাথে আর্কিটেক্ট উর্বীর পারস্পরিক সম্পর্ক, মনোভাব, চাওয়া পাওয়া- কতটা পরিচ্ছন্নতার পরিচয় বহন করে তা সত্যিই লেখকদের জন্য অনুসরণীয়। 

জলপিপিতে যেমন দুটি মানব মানবীর সম্পর্কের গল্প পাওয়া যায়, তেমনি মানবিক প্রেমেরও একটি অসামান্য আখ্যান পাওয়া যায় ইন্সপেক্টর নাজির সাহেবের মাঝে। গগন চৌধুরীর সন্তান কাজল- স্পেশাল চাইল্ড। যাদেরকে সমাজের ‘বোঝা’ মনে করা হয়। মিস্টার গগন চৌধুরীও বাদ যাননি এই তালিকা থেকে। নিজ সন্তানকেই কিনা অস্বীকার করতেন! ঘটনার এক পর্যায়ে এসে কাজল যখন একাকী হয়ে যাবে, এ চিন্তায় অস্থির হয়ে কাজলকে নিজের পুত্র হিসেবে গড়ে তুলতে এককথায় রাজি হয়ে যান ইন্সপেক্টর নাজির। একটা স্পেশাল চাইল্ডকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়ে তার ভার বহন করাটা চাট্টিখানি কথা নয়! জলপিপি বইটিতে এই  মানবিক অনুভূতি জাগ্রত করার কিছু অনন্য চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে, যা মানব মনকে ভাবতে শেখায়।

ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি এক প্রকার চ্যালেঞ্জিং বিষয়ই বলা চলে। কিন্তু কেন চ্যালেঞ্জিং? কারণ পাঠক তার কল্পনায় ডিটেকটিভকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেন। ডিটেকটিভের গোয়েন্দাগিরি, তার লাইফ স্টাইল- এসব অনুকরণে বিশেষ করে তরুণ পাঠকের আগ্রহের শেষ থাকে না! তবে একজন গোয়েন্দার মূল আকর্ষণের জায়গা হলো তার ঘটনাকে নিরূপণ করা, তদন্ত কাজে সহায়তা করা এবং সবশেষে মূল হোতাকে শনাক্ত করতে সহায়তা করা৷ বুদ্ধি দিয়েই এসব হিসেব নিকেশ করে নেন একজন ডিটেকটিভ।

ডিটেকটিভ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সরকারি, বেসরকারি ডিটেকটিভ। অলোকেশ রয় একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। জলপিপির ডিটেকটিভ অলোকেশের বুদ্ধিমত্তা, পরিস্থিতিকে সামাল দেয়া, তথ্য সংগ্রহের কৌশল অবলম্বন, সবকিছুকে বিশ্লেষণ করে সমাধান প্রকল্পে অর্থাৎ মূল ক্রিমিনালকে শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা এসবের অনন্য পরিচয় মেলে। কিন্তু তার কর্তব্যপরায়নতা অসামান্য । সফল ডিটেকটিভ তো তাকেই বলা যায়, যে সংঘটিত ঘটনার সারমর্ম এবং খুনিকে এমনভাবে তুলে ধরেন যেন তিনি নিজেই সেখানে হাজির ছিলেন। ডিটেকটিভ অলোকেশের ক্ষেত্রেও আমরা তেমনটি দেখতে পাই।

কারণ আমরা দেখতে পাই- “উর্বী অলোকের কাণ্ড দেখে বিস্মিত হয়। ভেবে পায় না, এতসব কাণ্ড-কীর্তি সে জানল কী করে! নাকি ঘটনার সময় অকুস্থলে সে উপস্থিত ছিল!”

একটি ঘটনার সমাধান প্রকল্পে অবশ্য একজন ডিটেকটিভই সব ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হন না, তার জন্য প্রয়োজন সহায়ক কিছু মানুষ, যারা ডিটেকটিভকে সর্বতোভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাবে। অলোকের বন্ধু শুভ, ইন্সপেক্টর নাজির, আর্কিটেক্ট উর্বী- মূল সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলো। তাদের একান্ত আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা পুরো ঘটনার সমাধানে পৌঁছাতে যথেষ্ট ছিল৷ যা একদিক থেকে গোয়েন্দাগিরির কাজকে পূর্ণতা দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সময় হাস্যরসের মাধ্যমে পাঠক মনের একঘেঁয়ামিও দূর করে দিচ্ছে। 

অনেক গোয়েন্দাকাহিনীই রচিত হয় অবাস্তব প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। যেগুলোর সাথে সমাজ ও সমাজের মানুষের তেমন একটা যোগাযোগ থাকে না। ফলে এসবে হয়ত শুধুই গোয়েন্দাগিরির স্বাদটুকু দিতে পারে, কিন্তু মানবিকবোধ জাগাতে, সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুল ধরতে  ও সাবলীলভাবে রোমাঞ্চের বর্ণনা করতে অনেকটাই ব্যর্থ। অথচ সেখানে ‘জলপিপি’ বেশ সার্থক ই বলা চলে। এসবের উপস্থিতি একই সাথে সাহিত্য স্বাদ যেমন দান করে, মনুষ্যত্ব জাগাতেও তেমনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

বাংলাসাহিত্যে নতুন ডিটেকটিভ হিসেবে প্রবেশ করলো অরুণ কুমার বিশ্বাসের ‘আলোকেশ রয়’। ডিটেকটিভ অলোকেশ রায়কে স্বাগতম এই জগতে,  সেও তার আইডলদের মতো অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাক।

বই : জলপিপি ||  লেখক : অরুণ কুমার বিশ্বাস
প্রকাশনা : অন্যপ্রকাশ ||  প্রকাশকাল : ২০১৮
অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

This Bangla article is a review of a book named Jolpipi by Arun Kumar Biswas.

Featured Photo: newsgram.com

RB-RF/SM

Related Articles

Exit mobile version